একটি প্রতিশ্রুতি ভাঙ্গার গল্প

২১৬ পঠিত ... ০৯:৪৬, এপ্রিল ২৯, ২০২৩
লেখা: জাভেদ ইকবাল 
Protisruti
আমি প্রায়ই স্বপ্নে গেইটটা দেখতাম। ধুসর, বালুময় পথ, পাশের মাটির রঙ ও কেমন জানি। ঘাসের রঙ বাংলাদেশের সবুজ না, কেমন যেন ভিনদেশী একটা সবুজ। স্বপ্নেই দুশ্চিন্তা পেয়ে বসতো, কেমন যেন দম বন্ধ করা, বুকের ওপর ১০০ মন চালের বস্তা চাপিয়ে দেয়া একটা দুশ্চিন্তা--ঐ গেইটের ওপারে কী আছে? অশুভ একটা অনুভূতি নিয়ে ঘুম ভাংতো, দেখতাম শীতের রাতেও ঘেমে গিয়েছি। আমি জানতাম না, একদিন ঐ গেইট আমাকে পার হতে হবে।
 
নন্দিনী আমাদের ভাড়াটিয়ার মেয়ে। গল্পের রাজকন্যাদের চামড়া এতো হালকা হতো, পান খেলে লাল পিক তাদের গলা দিয়ে নামতে দেখা যেতো। নন্দিনীকে দেখলে আমার তাই মনে হয়। তাকে দেখলে আমার রক্তে জোয়ার জাগে, বুক ধুকপুক করে, নিজেকে অপরিচিত মনে হয়। কিন্তু নন্দিনী আমাকে পাত্তা দেয় না। নিজের হাত কেটে আমি N লিখেছি, সেটার ছবি পাঠিয়েছি মেসেঞ্জারে, সিন করে রেখে দিয়েছে, কোন উত্তর বা রিঅ্যাক্ট দেয় নি। সে প্রেম করে জাফর নামে একটা লাফাঙ্গা ছেলের সাথে। কোচিঙে যাওয়ার নাম করে বাসা থেকে বের হয়ে পাঠাও এর রাইড নেয়ার নাম করে সে জাফরের ইয়ামাহাতে ওঠে। প্রতিদিন যে একই মোটরসাইকেল আর রাইডার আসে, সেটা তার বাসার আর কেউ না খেয়াল করুক, আমি করেছি, এবং দুইয়ে দুইয়ে চার করতে আমার কোন অসুবিধা হয় নি। কোচিং দূরে থাক, কলেজও ফাঁকি দিচ্ছে নন্দিনী। ও পাশ করবে কীভাবে? আচ্ছা, নন্দিনী কি বুঝতে পারছে না, এই ছেলে তার কত ক্ষতি করছে?
 
তাই এক শনিবার সকালে আমি ঠিক করলাম, নন্দিনীর এত বড় ক্ষতি আমি হতে দেব না।
 
আমাদের বাসা ছয়তলা থেকে আট তলা হচ্ছে। রাজউকের অনুমতি নেই, তবে সেটা এই এলাকার কারুরই নেই, সবাই ইচ্ছামত বাসায় ফ্লোর বাড়াচ্ছে।
 
জাফর এমনিতে কখনই হেলমেট খোলে না। তবে ইদানিং চৈত্রের কাঠ ফাটা গরমে সে হেলমেট খুলে একবার মাথা মোছে। আমিও অপেক্ষা করে ছিলাম। সাততলার ছাদ ঢালাই হওয়ার সময় যোগালিদের মাল টানা দেখে বুদ্ধিটা এসেছিল। জাফরের মাথাটা আমার ঠিক নিচে; একটা দশ ইঞ্চি ইটে জাফরের মাথার ঠিকানা লিখে ৭০ ফিট ওপর থেকে ছেড়ে দিয়েছিলাম। তারপর সোজা নিজের ঘরে ঢুকে এসির মধ্যে ঘুম; বাইরে কী হচ্ছে না হচ্ছে সেগুলি আমি কিছুই জানি না।
 
ইফতারের সময় শুনলাম, পুলিশ এসেছিল, আব্বা থানায়। উনি প্রভাবশালী মানুষ, আমি জানি কিছু হবে না কারন একটা চালচুলাহীন পাঠাও রাইডারের কী হলো না হলো সেটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাবে না। নন্দিনী কয়েক দিন কান্নাকাটি করবে, এর এই সুযোগে আমি তার কষ্ট শেয়ার করার জন্য তার বন্ধু হয়ে যাব। ফেইসবুকে ঢুকে দেখলাম নন্দিনী কোন স্ট্যাটাস দিয়েছে নাকি; দিলে একটা care রিঅ্যাক্ট করতাম। আশ্চর্য, এত বড় ঘটনা ঘটে গেল, মেয়েটা কোন স্ট্যাটাস দিল না!
 
সেহরি খেতে উঠে জানলাম, আমাদের ছাদ থেকে একটা ইট খসে পড়েছে নন্দিনীর মাথায়, সে এখন নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের আইসিইউতে, কোমায়। জ্ঞান ফিরবে কি না কেউ জানে না। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ইট ফেললাম জাফরের মাথায়, নন্দিনীর মাথায় পড়ল কীভাবে? নাকি আমি ইট ফেলেই দৌড় দেয়ার পরেই নন্দিনী বাসার গেইট খুলে বের হয়ে এসেছিল?
 
পাগল পাগল লাগছে, আজকে আর ঘুমাতেই পারব না। অথচ ফজরের আজান শুনতে শুনতেই আমার দুচোখ বন্ধ হয়ে এলো, এবং সাথে সাথে স্বপ্নের গভীরে ঢুকে গেলাম আমি। গেইটটা মনে হচ্ছে এবার অনেক কাছে, হাত বাড়ালেই আমি দেয়ালটা ছুতে পারব। আর গেইটের ওপারে... ওটা কি নন্দিনী? সাথে ১২-১৩ বছর বয়সের ছেলেটা কে?
 
আমি দ্বিধা না করেই গেইট পার হয়ে এলাম। অজস্র কণ্ঠ ফিশফিশ করে বলছিল, "যাইস না বাবা, যাইস না"। একটা পোড়া, বোটকা গন্ধও নাকে এলো।
 
কিন্তু আমি সেগুলি গ্রাহ্য করলাম না। ওপারে যে নন্দিনী বসে আছে আমার জন্য।
 
"কেন তুমি আমাকে মেরে ফেললে?"
 
নন্দিনীর প্রশ্নটা চাবুকের মত আমার কানে পড়ল। "আমি... আমি তোমাকে মারতে চাই নাই। আমি জাফরকে..." আমার কথা আটকে গেল।
 
"তুমি কি আসলেই নন্দিনীকে ভালোবাসো? তুমি কি তাকে চাও?" ছেলেটা এবার অদ্ভুত সুন্দর গলায় কথা বলে উঠলো। "তাহলে তুমি এটা খাও, নন্দিনী তোমার জন্য পাগল হয়ে যাবে"।
 
দেখলাম, ছেলেটা একটা ফল ধরে আছে। দেখতে কিছুটা আপেলের মত, কিন্তু গায়ে আনারস বা কাঁঠালের মত কাঁটাকাঁটা। "এটা অনেক, অনেক প্রাচীন একটা গাছের ফল, এত সুস্বাদু, এত মজার জিনিস কোটি কোটি বছর কেউ খায় নাই। এটা খেলে তুমি যে শুধু নন্দিনীকে পাবে তাই না, তোমার বুদ্ধিমত্তা আকাশছোঁয়া হয়ে যাবে, শুধু বাংলাদেশ না, বিদেশের যে কোন ইউনিভার্সিটিতে অ্যাডমিশন পাবে, বিসিএস দিলে নিজের ইচ্ছামত ক্যাডারে প্রথম হতে পারবে। এমপি, মন্ত্রী এমনকি তারও বেশি যা ইচ্ছা তাই হতে পারবে। আর সাথে পাবে তোমার নন্দিনীকে। খাও, খাও না"।
 
"তুমি কি ইবলিশ? এটা কি, এটা কি সেই ফল?" কোনক্রমেই আমি ফলটার নাম মনে করতে পারছিলাম না।
 
"ধুর, আমি ইবলিশ হব কেন? দেখছো না আমি একটা বাচ্চা ছেলে?" ছেলেটা আবার তার সুললিত গলায় বলল।
 
ফলটা আমি খেয়েছিলাম। আসলেই ফলটা অতি, অতি সুস্বাদু, মুখে এখনো টেস্ট লেগে আছে।
 
পরের দিন নন্দিনীর কোমা ভাঙল। আব্বা তার আগেই নন্দিনীর বাবাকে বলেছিলেন, উনি চিকিৎসার সব খরচ দেবেন। নন্দিনীর কোমা ভাঙ্গার পরের সপ্তাহে আব্বা আমাকে ডেকে বললেন, নন্দিনীকে আমার বিয়ে করতে হবে, নন্দিনী নাকি তার মা-বাবাকে বলেছে আমাকে ছাড়া সে বাচবে না। মেয়েটা কোমা থেকে ফেরার পরে কেমন জানি হয়ে গিয়েছে, মাঝে মাঝে "গেইট! গেইটটা বন্ধ কর!" বলে চিৎকার করে, কিন্তু আর সব ঠিক আছে। সবাই ভাবে নন্দিনী বাসার গেইটের কথা বলছে, কিন্তু আমি তো জানি।
 
আমিও খুশি। ছেলেটার কথার দাম আছে, তার ওপর বিশ্বাস রাখা যায়।
 
আজকাল আমি প্রায় রাতেই গেইট পার হয়ে ওপারে যাই। ছেলেটার আব্বার সাথেও পরিচয় হয়েছে। মূলত তার সাথে কথা বলার জন্যই যাই। মানুষ তার নামে উলটাপালটা অনেক কথা বলে, কিন্তু ওনাকে দেখলে কেউ সেগুলি বিশ্বাসই করবে না। ছাগল দাড়ি, কিন্তু অত্যন্ত সুদর্শন ভদ্রলোক, অতি মার্জিত ব্যবহার।
 
উনি আমাকে বলেছেন, আমি নাকি অনেক দূর যাবো। আমাকে নিয়ে ওনার অনেক বড় প্ল্যান আছে, ধীরে ধীরে সেটার বাস্তবায়ন হবে।
আপাতত ওয়ার্ড কমিশনার পদে নির্বাচন করছি, কারন এটাই প্রথম ধাপ। আব্বাও খুব খুশি আমি পলিটিক্সে ঢোকায়। আমি জিতব জানি, কারন আমার মেন্টর আমাকে নিশ্চয়তা দিয়েছেন। তাও লোক দেখানোর জন্য ক্যাম্পেইন করাই লাগছে।
 
পাঁচ বছর পর ঢাকা ইস্ট এর মেয়র, তারপর আমার উপদেষ্টা চাহেন তো ঢাকা-২৩ আসনের এমপি হিসাবে দেখা যাবে আমাকে।
 
আর গেইটটা? গেইটটা আগের মতই আছে। ধুসর, বালুতে ঢাকা পথ, একটু পোড়া গন্ধ, কোটি কোটি গলায় সাবধানবানী, "যাইস না, যাইস না"।
 
(এই ছবিটা বাংলাদেশের একটা অসমাপ্ত ব্রিজের। ছবিটা দেখার পর থেকেই একটা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের গল্পের কথা ভাবছিলাম, কিন্তু লিখতে বসার পর গল্পটা একদম অন্য দিকে টার্ন নিল)
২১৬ পঠিত ... ০৯:৪৬, এপ্রিল ২৯, ২০২৩

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top