বাংলা নাটক-সিনেমায় শক্তিশালী কিছু নারী চরিত্র

৫১৩৯ পঠিত ... ২২:৫৭, সেপ্টেম্বর ২১, ২০২১

 

স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের দেশে টিভি বা সিনেমায় যে শক্তিশালী চরিত্রগুলো মানুষের মনে দাগ কেটে গেছে, তার অধিকাংশই পুরুষ- তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই পুরুষচরিত্র কেন্দ্রিক মুভি বা নাটকের মাঝে মাঝেও উঠে এসেছে বহুদিন মনে রাখার মতো কিছু শক্তিশালী নারী চরিত্র। তেমনই কিছু নারী চরিত্র নিয়ে আজকের ফিচার। চলুন একনজরে দেখে নেয়া যাক...

 

strong female character

 

সাবিলা

লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান

কর্মক্ষেত্রে নারী বৈষম্য, পুরুষ বসদের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকারের ঘটনায় একজন মেয়েকে এর জন্য বিচার পেতে হলে বিচারব্যবস্থার কাছে কীভাবে হেনস্থা হতে হয় তার প্রমাণ মেলে সাবিলার জীবনের নানা ঘটনার মধ্যে দিয়ে। তারই সাথে শুধুমাত্র পুরুষদের অতি ভঙ্গুর ‘ইগোর’ বদৌলতে খায়রুলদের মত কত বস বিচার পাওয়ার বদলে চিরমুক্তি পেয়ে যায় এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সাবিলারাও যে বিচার না পেয়ে সারাজীবন অতৃপ্ত থেকে যায় তা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে আট পর্বের এই থ্রিলার ঘরানার ধারাবাহিক টিভি সিরিজটিতে।  

 

শিরিন, মিলি ও নূরী 

পালাবি কোথায় 

সিনেমাটিতে তিন স্তরের তিনজন কর্মজীবী নারী কিভাবে পারিবারিক বৈষম্য ও কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হয় তা তুলে ধরা হয়। অফিসে উপরমহলের লম্পট পুরুষ কর্মকর্তাদের দ্বারা নারীরা কিভাবে হেনস্থা হয় এবং অন্য নারীরাও যে নারীদের হেনস্থা করতে ছাড়ে না তার উদাহরণ পাওয়া যায়। কমেডি ঘরানার সিনেমা হলেও শিরিন, মিলি ও নূরীর মত সাহসী নারী চরিত্রের মাধ্যমে সিনেমাটিতে দেখানো হয় নারীরা একত্রিত হলে, একে অন্যকে সাহায্য করলে, কেউ একচুলও ছাড় পেয়ে পালাতে পারবে না। 

 

আয়েশা

ন ডরাই 

ভয়কে জয় করা এক নারীর গল্পে নির্মিত চলচ্চিত্র 'ন ডরাই'।

গল্পের পটভূমি সমুদ্রের উত্তাল জলরাশি, সার্ফিং আর ভয়ডরহীন এক জলকন্যা আয়েশা। সব বাঁধা পেরিয়ে যার স্বপ্ন ছুটেছে সার্ফিং এর গতিতেই। জীবনের যে চিত্রনাট্যে এই সমুদ্রকন্যাকে দমাতে পারেনি সমাজ কিংবা পরিবারের রক্তচক্ষু। বাংলাদেশের প্রথম নারী সার্ফার নাসিমা আকতারের জীবন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি সিনেমাটিতে রয়েছে সংসারের শিকল ভেঙে একজন নারীর স্বপ্নজয়ের গল্প। 

 

হুরমতি 

সংশপ্তক

সংশপ্তক নাটকে ফেরদৌসি মজুমদার অভিনীত হুরমতি চরিত্রটি গত তেত্রিশ বছরেও ভুলতে পারেনি দর্শক। গ্রাম্য পটভূমিতে অসহায়ত্বের বিপরীতে নারীকে আত্মরক্ষার জন্য হতে হয় বেপরোয়া, অবলম্বন করতে হয় নানা কৌশল। এরই প্রকাশ আমরা দেখতে পাই সংশপ্তক নাটকে হুরমতি যখন রমজানের কান কেটে দেয় তখন। বিত্তবানদের লালসার শিকার হয়ে হুরমতির গর্ভে যখন সন্তান আসে তখনও হুরমতি থেমে যায়নি, এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে, প্রতিকার খুঁজেছে। 

 

থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার 

রুবা হক 

স্বাধীনচেতা নারী রুবা হককে ঘিরে গল্পের আবর্তন। আমাদের দেশে মেয়েদের বাবা-মা’র ঘর থেকে যেতে হয় স্বামীর ঘরে। এই দু’টো ঘর যাদের থাকে না, তাদের পড়তে হয় নানা সমস্যার বেড়াজালে। একা একটি মেয়ের এদেশে নিজের আশ্রয় খুঁজে পাওয়াটাও যেন সংগ্রাম। তবে রুবার জীবনের লড়াইয়ে এটি ছিল সবচেয়ে ছোট্ট সমস্যা। স্বাবলম্বী হওয়া, নানা ঘটনার মোড়ে মোড়ে একজন নারীর বিবেক আর ইচ্ছের দোলাচলে নিজের সাথে যুদ্ধ করা, প্রতিষ্ঠিত হতে গিয়ে পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর ভয়ঙ্কর বক্তব্য শুনে নারীদের নিয়মিত নিজের সাথে, সমাজের সাথে, পরিবারের সাথে নানা যুদ্ধ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সিনেমাটিতে। 

 

বুড়ি

হাঙর নদী গ্রেনেড 

গ্রামের প্রতিবাদমুখর দুরন্ত কিশোরী বুড়ির বিয়ে হয় তার দ্বিগুণ বয়সী গফুরের সঙ্গে। গফুরের আগের ঘরের দুই সন্তানকে বুড়ি ভালোবাসলেও নিজ সন্তান চাইতো সে। অনেক সাধনার পর যে সন্তান বুড়ি পায়, সে হয় বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী। এর মাঝে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এক ছেলে চলে যায় যুদ্ধে, আরেক ছেলেকে বুড়ির সামনে হত্যা করে পকিস্তানিরা। কিন্তু বুড়ি ভয় পায় না। বুড়ি বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেয়। পাকিস্তানিরা খুঁজতে এলে বুড়ি দেশপ্রেমের অগ্নিপরীক্ষায়, মুক্তিযোদ্ধাদের বাঁচাতে তার নিজের সন্তানকে তুলে দেয় পাক বাহিনীর বন্দুকের নলের মুখে। নিজ সন্তানকে বলি দিয়ে বুড়ি হয়ে ওঠে পুরো একটি দেশের মা। 

 

মুনা

কোথাও কেউ নেই 

আর দশটা মেয়ের মতোই তো স্বাভাবিক ছিলো মুনার জীবন। মামা বাড়ির সংসার, নিজের চাকরি, প্রেমিক; যার সাথে কিছুদিন পরেই বিয়ের কথা। হঠাৎই জীবনে যেন একটার পর একটা নেমে আসে দুর্যোগ। সেই দুর্যোগ সামলাতে মুনা পাশে পায় এলাকার মাস্তান বাকের ভাইকে। সেই বাকের-মুনার কড়া-মিঠে রসায়নেই যেন বুঁদ হয়ে ছিলো তামাম দেশবাসী। 

শেষ পর্বের শেষ দৃশ্যে বাকেরের লাশ নিতে মুনা যখন গেলো কেন্দ্রীয় কারাগারে, ‘বাকের তোমার কী হয়’ এর জবাবে মুনা যখন মাথা নাড়িয়ে বললো, ‘কেউ না, বাকের আমার কেউ না’... সেসময় চোখের পানি ক’জন আটকাতে পেরেছিলেন সেটা হাতে গোনা যাবে। অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন সুবর্ণা মুস্তাফা মুনা চরিত্রে। 

 

নবিতুন 

সারেং বউ 

সিনেমায় গ্রামের মোড়লের ষড়যন্ত্রে বিদেশে থাকা স্বামী কদম এর কাছ থেকে সারেং বাড়ির বউ নবিতুনকে আলাদা করার নানা ঘটনা চলতে থাকে। স্বামীর দেওয়া টাকা গোপনে হাত করে নেয় মোড়ল। এরপর চলতে থাকে নবিতুনের সংগ্রাম। একা পেয়ে নবিতুনকে হেনস্থা ও ধর্ষণের চেষ্টাও করে মোড়ল। একসময় জোর করে মোড়ল তাকে বিয়ে করতে নিলে, ফিরে আসে নবিতুনের স্বামী। কিন্তু সেও নবিতুনকে ভুল বোঝে। শ্রেণি, ধর্ম, বর্ণ - যাই হোক না কেন নারীকে লড়ে যেতে হয় সব খানে, সব সময়। তবু নারীই পারে সব সংস্কারকে পায়ে দলে জীবনের জয় ঘোষণা করতে। পুরুষশাসিত সমাজে নারীর এই বেঁচে থাকার এবং নতুন সমাজ গড়ার পথে এগিয়ে যাওয়ার গল্প বলে ‘সারেং বউ’। 

 

বিলকিস বানু

গেরিলা 

বিলকিস বানুর সাংবাদিক স্বামী হাসান ২৫শে মার্চ রাতে নিখোঁজ হয়ে গেলে নিজের ব্যাংকের চাকরি, অসুস্থ শ্বাশুড়ির দেখাশোনার পাশাপাশি হাসানের খোঁজে ছুটতে ছুটতে গেরিলাযোদ্ধাদের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে বিলকিস। এরপর সেলুলয়েডে ফুটে ওঠে গেরিলাদের সঙ্গে বিলকিসের দুঃসাহসী এক অভিযান। কিন্তু নানা ঘটনার পর বিলকিস ধরা পরে গেলে বীরের মত নিজের সাথে উড়িয়ে দেয় একটি গোটা মিলিটারী ক্যাম্পকে। 

 

সূর্যকন্যা 

সূর্যকন্যা 

সিনেমার মূল চরিত্র লেনিন নামের এক স্বপ্নবিলাসী শিল্পী। সিনেমার শুরুর দিকেই লেনিনের কাল্পনিক প্রেমিকা সূর্যকন্যার মুখ থেকে শুনতে পাওয়া একটি সংলাপ হলো, ‘চারটা বেজে গেল যে! ভোরের আলো দেখার অধিকার যে এখনও পাইনি।’ খুব সাধারণভাবে বলা এই কথার মাঝে যেন লুকিয়ে আছে সহস্র বছর ধরে অন্ধকারে থাকা নিরুপায় নারীদেরই দীর্ঘশ্বাস। কিন্তু সেই কল্পনার সূর্যকন্যা জীবন্ত নারীতে রুপ নেয় একদিন। সূর্যকন্যা বলে ওঠে, ‘তারপরের  ইতিহাস এক ভয়াবহ দাসত্বের ইতিহাস। তাই আজ আমাদের নেই কোন স্বকীয়তা। আছে কেবল আধা মনুষ্যত্ব। আমরা কেবল সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র। ভোগের সামগ্রী।’ ১৯৭৫ সালে মুক্তি পাওয়া সূর্যকন্যা সিনেমাটি ছিল নারীমুক্তির বার্তাবাহী এবং কাহিনীর দিক দিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী।   

 

জয়গুন

সূর্য দীঘল বাড়ি 

কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি, পুরুষতন্ত্রের নির্যাতন ও ধনীর শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট গ্রামীণ বাংলাদেশের এক নারীর জীবন সংগ্রামের অনবদ্য দলিল ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’। স্বামীর ঘর থেকে বিতাড়িত হওয়া জয়গুন ছেলেমেয়ে নিয়ে ওঠে তার সূর্যদীঘল বাড়িতে। নিজের চেষ্টায় টাকা উপার্জন শুরু করে জয়গুণ। কিন্তু খল চরিত্র রুপে উদয় হয় গ্রামের মোড়ল। কুসংস্কার ও অজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে কিভাবে শোষণ চালায় মোড়লশ্রেণীর মানুষ তা তুলে ধরা হয়। সমাজে দরিদ্র নারী দ্বিমুখী নির্যাতনের শিকার। দরিদ্র বলে এবং নারী বলে তার ওপর চলে ক্রমাগত নিপীড়ণ। তবু এই নিপীড়নকে পায়ে দলে এগিয়ে যায় জয়গুনের মতো সাহসী নারীরা। 



৫১৩৯ পঠিত ... ২২:৫৭, সেপ্টেম্বর ২১, ২০২১

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top