মাশরাফির কৈশোর জীবনের ১১টি মজার ঘটনা

৭৫০১ পঠিত ... ১৬:০০, ডিসেম্বর ১৭, ২০১৭

আমাদের জাতীয় ক্রিকেট দলের ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফি কেমন দুরন্ত স্বভাবের, তা আমাদের সবারই কম বেশি জানা আছে। শৈশবে তাহলে তিনি কতটা দুরন্ত ছিলেন, ভাবুন তো! দুরন্তপনা এবং মজার পারিবারিক পরিমন্ডলে কেটেছে তাঁর শৈশব-কৈশোর। দেবব্রত মুখোপাধ্যায় রচিত 'মাশরাফি' বইটি থেকে মাশরাফির কৈশোরের এমনই কিছু মজার ঘটনা সঙ্কলন করা হলো eআরকির পাঠকদের জন্য। 

অলংকরণ: রাকিব রাজ্জাক

১. অন্য আর দশটা মানুষের পরিবারের সাথে মাশরাফি বিন মুর্তজার পরিবারকে মেলালে খানিকটা ভুল করা হবে। তাঁদের বাসায় এমন অনেকেই থাকেন যারা রক্তের সম্পর্কে কোন আত্নীয় নন, কিন্ত আত্নীয়ের থেকেও বেশি কিছু। মাশরাফির ইউসুফ মামাও ছিলেন এমন একজন মানুষ। মাশরাফির নানা-নানী ছোটবেলায় ইউসুফ সাহেবকে নিয়ে এসেছিলেন এই বাড়িতে এবং তখন থেকেই তিনি বাড়ির বড় ছেলের মতো বড় হয়ে উঠেছেন।মজার ব্যাপারটা এই ইউসুফ মামাকে নিয়েই।

মাশরাফি তখন ছোট। এক সকাল বেলায় ইউসুফ মামা দোকানে বসেছিলেন; হঠাৎ বাড়ী থেকে ডাক! কী সমাচার? যেয়ে শোনা গেলো, মাশরাফি খুব কাঁদছে, বেলা ম্যাডাম ইউসুফকে বলছেন একটু ডাক্তার ডেকে দিতে। শুনে ইউসুফ মামা খুব স্বস্তির সাথে “ডাক্তার লাগবেনা, আমার কাছে দেন, ঠিক করে দেবানি!” বলেই, কেরোসিনের বোতল থেকে এক ফোঁটা কেরোসিন দুই নাকে লাগিয়ে দিলেন। সবাই রে রে করে উঠলেও তিনি নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, 'এহ! পেটের ব্যথায় ডাক্তার লাগে নাকি! কেরোসিনের উপর ওষুধ নাই!'

২. বাচ্চাদের নিয়ে ইউসুফ মামার এমন আরো কিছু আবিষ্কার ছিলো, তার একটা শর্টলিস্ট এমন-
- দাঁত শক্ত করতে চাইলে ব্রাশ না করেই চা নাস্তা খেতে হবে।
- দিন শুরু করতে হবে চা দিয়ে; দুধ বা অন্য কোন খাবার নয়।
- দিনে দুবার ইটের খোয়া খেলে বড় হলে আর গ্যাস্ট্রিক হবে না।
- শরীর ফিট রাখতে রোজ কিছুটা বালু খেতে হবে।
- পেটে ব্যথার সেরা সমাধান কেরোসিন।

এসব আবিষ্কারের সময় মাশরাফির বয়স ছিলো মাত্র তিন। এবং বলাই বাহুল্য, ছোট্ট মাশরাফি এর সবকটাই বেদবাক্যর মতো মানবার চেষ্টা করতেন।

৩. মাশরাফির আরেকজন মামার নাম নাহিদ। ইউসুফ মামার মতো না অবশ্য, তিনি মাশরাফির নানা-নানীরই সন্তান। মাশরাফি ছোটবেলায় ছিলেন এই নাহিদ মামার ভক্ত। রাত-দুপুরে মাশরাফি যখন গলা ছেড়ে চিৎকার করলে বেলা ম্যাডাম আর সামলাতে পারেন না, তখন ডাক আসে নাহিদ মামার। এইভাবে একদিন হঠাৎ নাহিদ মামা মাশরাফিকে ঠান্ডা করবার এক অভিনব বুদ্ধি বের করে ফেললেন। রাত-বিরেতে মাশরাফি যখন ঘুম থেকে উঠে কান্না করবে, তার হাতে তখন একটা ফিডারের নিপল যাকে স্থানীয়ভাবে 'বোটা' ডাকা হয়, ধরিয়ে দিলেই ছোট্ট মাশরাফি চুপ হয়ে যান। প্রথম প্রথম ভালোই চলছিলো, কিন্ত কিছুদিন পর মাশরাফির দাবি বেড়ে, দুইটা নিপলে দাঁড়ালো। আরো কিছুদিন পরে তিনটা...চারটা। এরপর প্রায়শই রাতের নিত্যকার রুটিন হয়ে গেলো, ছোট্ট মাশরাফি রাতেবিরেতে চিৎকার করলেই নাহিদ মামা তার হাতে 'বোটা; ধরিয়ে দেবেন। মাশরাফি আধো-আধো বোলে দাবী জানাবে, “আমার আরেত্তা ফোঁটা কই?” আর মামা আবার এগিয়ে দেবেন একটা একটা করে সেই ঐতিহাসিক 'বোটা'!

৪. ছোটবেলা থেকেই মাশরাফি প্রচন্ড দূরন্ত এক বাচ্চা। প্রায়শই মাঠে খেলতে চলে যেতেন, সেখান থেকে ধরে আনতে হতো তাকে। রাস্তার ওপারে বিশাল মাঠ, এই নড়াইলের সবচেয়ে বড় খোলা মাঠ। মাঠের এ পাশে টেনিস বলে ক্রিকেট খেলা চলে। মাশরাফি ছুটে চলে যেতেন মাঠে। যেয়েই দাঁড়িয়ে পরতেন একদম উইকেটকিপারের পাশে। এতো ছোট মানুষ, গায়ে বল লাগলে ব্যথা পেতে পারেন এই ভেবে সবাই তাকে সরিয়ে দিতে চাইতো, কিন্ত তিনি জেদের বশে সরতে চাইতেন না। এই নিয়ে বাঁধতো শোরগোল, এই শোরগোলেই গোলাম মুর্তজা মানে মাশরাফির বাবা বুঝে যেতেন যে ছেলে আবার মাঠে নেমে পড়েছেন, হাতের কাছে যা পেতেন তা নিয়েই ছুটে যেতেন!

৫. মাশরাফির বয়স তখন আনুমানিক তিন-চার। একদিন হঠাৎ সকাল থেকে সে নিখোঁজ। আর কারো কাছে না হোক, অন্তত নাহিদ মামার কাছে খোঁজ থাকেই যে মাশরাফি কোথায় আছেন। কিন্ত সেদিন তিনিও জানেন না যে মাশরাফি কোথায়! হইচই পড়ে গেলো সারা এলাকায়, সবখানে খোঁজাখুঁজি চললো, সার্চ পার্টি বের হলো, কিন্ত না নেই। দিন পেরিয়ে রাত হয়ে গেলো, কিন্ত মাশরাফির কোন খোঁজ নেই। সবাই একসাথে মিলে যখন কথাবার্তা চলছিলো যে এরপর পুলিশ ডাকা হবে কি না, তখন নাহিদ মামা একটু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করবার জন্যে বাইরে এসে দাঁড়ালেন। হঠাৎ পাশ থেকে চিকন এক গলার ডাক ভেসে আসলো, 'মামা!' নাহিদ মামা তন্নতন্ন করে খুঁজে আবিষ্কার করলেন ডাকটি আসছে বাড়ির পাশের ড্রেনের ভেতর থেকে। বাসার ফিরতে দেরি হয়েছে বুঝে বাবার মারের ভয়ে এখানে লুকিয়ে রয়েছিলেন ছোট্ট মাশরাফি!

৬. নড়াইলে সেই ছোটবেলা থেকেই মাশরাফির বিশ-পঁচিশ জনের এক বিশাল 'দুষ্টু ছেলের দল' রয়েছে। এই দুষ্টু ছেলের দলের দৌরাত্ন্য করবার প্রধান জায়গা ছিলো চারটি। এদের মধ্যে একটি হলো, মাশরাফির মামাবাড়ির একেবারে কোলঘেঁষে তুলসী বাবুর বাগান। মাশরাফি তখন কিশোর বয়স। সবাই একদিন বিকেল বেলায় খেলা শেষে সেই তুলসী বাবুর বাগান দিয়ে ফিরছে, হঠাৎ সবার পানির পিপাসা পেয়ে গেলো। কিন্ত হাতের কাছে এতো নারকেল গাছ থাকতে কষ্ট করে কে এতো চাপকল থেকে পানি আনতে যায়। সিদ্ধান্ত হলো, মাশরাফি গাছে উঠে ডাব পেরে আনবেন, এরপর সবাই মিলে খাওয়া হবে। যথারীতি মাশরাফি উঠে পড়লেন গাছে। একটা একটা করে ডাব পেড়ে নিচে ফেলছেন আর তাঁর বন্ধুরা ডাবগুলো ক্যাচ ধরছেন। হঠাৎ একটা ডাব ফেলে তিনি বুঝতে পারলেন কেউ ক্যাচ ধরেনি। বিরক্ত মনে নিচে তাকাতেই তাঁর চোখস্থির হয়ে গেলো, নিচে দাঁড়িয়ে রয়েছেন বাগানের মালিক, তুলসী বাবু স্বয়ং!

৭. মাশরাফি ও তাঁর বন্ধুদের চিত্রা নদীতে গোসল করতে যাবার প্রক্রিয়াটা ছিল বেশ মজার। পায়ে হেঁটে যেতে কেউই রাজি হতো না, তাই সবাই গাছে উঠে, এক গাছ থেকে লাফিয়ে আরেক গাছে যেতো। এভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে, শেষ লাফটা দেয়া হতো চিত্রা নদীতে!

অলংকরণ: রাকিব রাজ্জাক

৮. খাদক হিসেবে মাশরাফি বিন মুর্তজার সুখ্যাতি ছোটবেলা থেকেই ছিলো, তবে সেটা কতোটুকু ভয়াবহ তা বোঝাতে নিচের এই দুইটি ঘটনাই যথেষ্ট-

ফুটবল খেলা হবে। পুরষ্কার হিসেবে জয়ী দল পাবে তিনকাঁদি কলা। কলা পাশের তুলসী বাবুর বাগান থেকেই ম্যানেজ করা হয়েছে আর কি! সব ঠিকঠাক, কিন্ত খেলার মাঝে দুইদলের তুমুল ঝগড়া লাগলো। সে ঝগড়া থামাতে থামাতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। সন্ধ্যার দিকে একজনের হুঁশ হলো, আরে কলা কই? একটু খোঁজ নিতেই দেখা গেলো সেই তিনকাঁদি কলা মাশরাফি একাই সাবাড় করে দিয়েছেন!

৯. মাশরাফির খাওয়া নিয়ে আরেকটা গল্প খুব চালু আছে। তারা একবার ফুটবল খেলে পাশের পাড়ার ক্লাবের সাথে ম্যাচ জিতলো। সেই আনন্দে পাড়ার বড় ভাইয়েরা পুরষ্কার ঘোষনা করলেন। হোটেলে পুরো দলকে নিয়ে গিয়ে বললেন, 'তোদের যা খুশি, খা!'
বেশি না, মাশরাফি সেদিন মাত্র নয় প্লেট ভাত খেয়ে ফেলেছিলেন!

১০. ছোটবেলার দূরন্তপনা মাশরাফির কিশোর বয়সে এসেও কমে নি। যেই ঘরের মানুষজন দুপুর বেলায় একটু ঘুমোত, এক ছুটে মাশরাফি চলে যেতেন মাঠে খেলতে। এক দুপুরের কথা, মাশরাফি পা টিপে টিপে বাড়ি থেকে বেরোতে যাবেন, ওমনি মাশরাফির নানী, বেলা ম্যাডাম মেঘস্বরে ডাক দিলেন যে মাশরাফি কোথায় যাচ্ছেন, মাশরাফি মিনমিন গলায় উত্তর দিলেন, 'এই যে একটু টয়লেটে!' বলেই লুঙ্গি মালকোচা করে এক দৌড়ে মাশরাফি চলে গেলেন মাঠে। মাশরাফির প্রথম ক্রিকেট অভিভাবক শরীফ মোহাম্মাদ এ ব্যাপারে একটি মজার কথা বলেছিলেন, 'কালো পলিথিনে ভরে ট্রাউজার আর জার্সি নিয়ে মাঠে আসত। আমরা দূর থেকে মাঝে মাঝে দেখতাম, মালকোচা দিয়েই হয়তো ব্যাট করছে। কোন কারণে হয়তো নানিকে লুকিয়ে পলিথিনের ব্যাগ আনতে পারেন নি!'

১১. নানী বাদের খেলায় মাশরাফির আরেকটা ভয় ছিলো বাবা গোলাম মূর্তজা। বাড়ির পাশেই তো মাঠ, যে কেউ যখন তখন দেখে ফেলতে পারে। আর দেখে ফেললেই বাসায় নালিশ চলে যাবে। সেই সমস্যার সমাধানও হলো, মাশরাফি ফিল্ডিং করবে টিনের ঘরের পেছনে। আশ্চর্যজনকভাবে মাঠের কোনায় একটা টিনের শেড রয়েছে। ঐ শেডে বসে অনেকে খেলা দেখেন। এই শেডটা তাঁর আত্ন্ররক্ষার কাজে লাগানোর বুদ্ধি হলো। মাশরাফির ফিল্ডিংয়ের স্থায়ী পজিশন হলো ঐ শেডের গায়ে। বাসা থেকে ওখানে কেউ দেখতে পারে না!

৭৫০১ পঠিত ... ১৬:০০, ডিসেম্বর ১৭, ২০১৭

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top