দরবেশ আজ সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন টক দই খেতে। দস্তগীর সাহেবের গৃহ থেকে ২৩ রকম মাছের তরকারি এসেছে; আর দরবেশের মায়ানগরী থেকে এসেছে টক দই। সবাই মিলে তৃপ্তি করে মাছ-ভাত খেয়ে তারপর টকদই খেতে খেতে সাজাহান খান তার সব্বোনেশে দাঁত বের করে বলেন, কলকাতায় পালিয়ে যাওয়া নেতারা শুনলাম টাকে চুল লাগাচ্ছে। খবরটা পড়েই আমার তৌফিক সাহেব আর অধ্যাপক কর্নেল সাহেবের কথা মনে পড়লো; উনারা ভারতে পালিয়ে যেতে পারলে আজ মাথায় রাজেশ খান্নার মতো চুল থাকতো তাদের।
একথা শুনেই খ্যাক খ্যাক করে হেসে ওঠেন বিচারপতি মানিক।
মেনন খ্যাস খ্যাস শব্দ করে ধমক দিয়ে বলেন, খবরদার বডিশেমিং করবেন না। এটা পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট ব্যাপার।
অধ্যাপক কর্নেল বলেন, উনারা আসলে জানেন না যে বল্ড হেড হালফ্যাশানের ব্যাপার। উনারা সেই রাজেশ খান্নার যুগে পড়ে আছেন। অথচ আমরা রয়েছি রাজেশ খান্নার ছেলে অক্ষয় খান্নার যুগে।
এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে আসেন শাহরিয়ার কবির, সঙ্গে দুটি লোক; তারা হাউমাউ করে কাঁদছে।
ইনু উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করেন, কী হয়েছে কবির ভাই? ওরা কাঁদছে কেন?
শাহরিয়ার কবির বলেন, আর কী হবে! অধ্যাপক কর্নেল শুনলাম মসজিদে গিয়ে ইরানি বিপ্লবের স্বপ্ন বুনে এসেছেন। সেই স্বপ্নবৃক্ষ বিষবৃক্ষ হয়েছে। চট্টগ্রামের ইসকনের এই দুটি ছেলেকে মুসলমান হবার জন্য ফুসলাচ্ছে মোল্লারা।
ইনু গর্জন করেন, আমি এজন্য আগেই বলেছিলাম, দাড়ি টুপি নির্মূল করতে; ওসব আগাছা কেটে সাফ করতে।
অধ্যাপক কর্নেল ছেলে দুটিকে জিজ্ঞেস করেন, ইসকন মহাশয়, আপনাদের ঠিক কি বলেছে ওরা।
–আমাদের ইসলামি বিপ্লবে যোগ দিতে বলেছে; বলেছে গরিবের আবার হিন্দু মুসলমান কী? চলো সবাই মিলে ইসলামি বিপ্লব করি।
মেনন খ্যাস খ্যাস করে বলেন, ও বাবা মোল্লারা দেখছি কমুনিস্টদের ডায়ালগ দিয়েছে।
অধ্যাপক কর্নেল বলেন, কম্যুনিস্ট মতাদর্শ আর মোল্লাদের মতাদর্শ তো খুব কাছাকাছি; গোপনে সংগঠন চালানো, কর্মী সংগ্রহ, শ্রেণী সংগ্রাম, বিপ্লবের প্রস্তুতি; প্রতিটি ধাপে ধাপে মিল এই দুটি কট্টর মতাদর্শের। কম্যুনিস্টরা ঈশ্বরহীন আর মোল্লারা ঈশ্বরযুক্ত। অবশ্য আমাদের কম্যুনিস্টরা বেশ খানিকটা হিন্দুত্ববাদী; আর এই জায়গাতেই ইসলামপন্থীদের সঙ্গে তাদের গোল বেঁধেছে।
শাহরিয়ার কবির খসখস খসখস করে প্রতিবাদলিপি লিখতে থাকেন, একাত্তরের পরাজিত শক্তি জোর করে হিন্দু জনগোষ্ঠীকে ধর্মান্তরিত করার গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে ক্ষমতাচ্যুত করে জিহাদিরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার পর থেকে হিন্দু জনগোষ্ঠীর ওপর তারা চড়াও হয়েছে। আমরা ২৩ জন বিশিষ্ট নাগরিক সংখ্যালঘুর অধিকার রক্ষায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
লেখা শেষ হলে উনি কাগজটা এগিয়ে দেন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের স্বাক্ষরের জন্য। সবার স্বাক্ষর হয়ে গেলে শাহরিয়ার কবির, ও মুকুল এটা পত্রিকা অফিসগুলোতে ফ্যাক্স করে দে বলেই; তারপর স্তব্ধ হয়ে যান। বিড় বিড় করে বলেন, ওহ আমি তো এখন কারাগারে। এই ইসকন সদস্যরা চলো আমার সঙ্গে, কারাপ্রধানের কাছে এই বিবৃতি আর তোমাদের সাক্ষ্য জমা দিয়ে জঙ্গি বিরোধী অভিযানের দাবি জানাই।
জেলখানায় জঙ্গী অভিযান চালিয়ে শরিয়ত উল্লাকে জ্যান্ত ধরে আনা হয়। কারণ ইন্টেরিম সরকারের সময় ক্রসফায়ার করা নিষেধ। আর জঙ্গি অভিযান ও ক্রসফায়ারের চিত্রনাট্য লেখক বিশিষ্ট কথাশিল্পী জাবেদ পাটোয়ারী পলাতক।
কারাপ্রধানের কক্ষে শরিয়তকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। অধ্যাপক কর্নেল জিজ্ঞেস করেন, শরিয়ত ভাই আপনি কি জগন্নাথকে জগলুল আর শিবব্রতকে শরাফত হতে বলেছেন?
–না স্যার, আমি কেবল তাদের ইনকিলাবের দাওয়াত দিয়েছি।
এবার অধ্যাপক কর্নেল জগন্নাথ ও শিবব্রতকে জিজ্ঞেস করেন, শরিয়ত সাহেব কি আপনাদের ইনকিলাবের দাওয়াত দিয়েছেন নাকি ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন?
জগন্নাথ বলেন, ইনকিলাব আর ইসলাম একই।
শিবব্রত বলেন, ইনকিলাব ইসলামি শব্দ, আর দাওয়াত মানেই ধর্মান্তরিত করার ফাঁদ।
শাহরিয়ার কবির বলেন, বিপ্লবের ডাক দিলেই তো এমন কনফিউশন হতো না। যা হোক জেলখানায় হিন্দুদের নিরাপত্তা জোরদার করা হোক; দাড়ি টুপিওয়ালা লোকেরা যেন অযথা গেরুয়াদের বিরক্ত না করে সেদিকে কারারক্ষকদের সজাগ থাকতে হবে।
অধ্যাপক কর্নেল বলেন, কিন্তু এভাবে গরিব হিন্দু-মুসলমানকে আলাদা করে রাখলে তারা একযোগে শ্রেণী সংগ্রাম করতে পারবে না।
কারারক্ষক বলেন, ঐটাই তো শত শত বছর ধরে চলছে স্যার। ধনী-গরীবের ব্যবধান ও বৈষম্য নিয়ে গরীবেরা যেন ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে সেজন্য হিন্দু-মুসলমান বিভাজন বিদ্বেষ দিয়ে গরীবদের বিচ্ছিন্ন করে রাখা হচ্ছে।
অধ্যাপক কর্নেল জিজ্ঞেস করেন, জেলার মহোদয়, আপনি কি সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র নাকি!
এমন সময় সুচরিতাসু এসে উঁকি দেয়, ভেতরে আসতে বললে সে অধ্যাপক কর্নেলের কাছে এসে বলে, স্যার আজ একটা নতুন গান প্র্যাকটিস করেছি। আপনাকে শোনাতে চাই, একটু বাগানে আসবেন।
মন্ত্রমুগ্ধের মত উঠে অধ্যাপক কর্নেল সুচরিতাসুর পেছনে পেছনে হাঁটতে থাকেন। সুচরিতাসু গুন গুন করে গেয়ে ওঠে,
প্রিয় এমন রাত যেন যায় না বৃথাই
পরি চাঁপা ফুলের শাড়ি খয়েরিটিপ,
জাগি বাতায়নে জ্বালি আঁখি প্রদীপ,
মালা চন্দন দিয়ে মোর থালা সাজাই।।
পুনশ্চ: অতীতে সফদার ডাক্তার মাথা ভরা টাক তার, ক্ষিদে পেলে পানি খায় চিবিয়ের যুগে; টাক ছিলো খানিকটা হাসাহাসির পাত্র। কিন্তু সমকালে পশ্চিমে হেয়ার ডু হিসেবে হেড শেভিং খুব স্টাইলিশ ফ্যাশান হিসেবে সমাদৃত। হলিউডের সুদর্শন অভিনেতা কেভিন কস্টনার থেকে জেসন স্ট্যাথাম, ভিন ডিজেল এই ফ্যাশানে নতুন মাত্রা এনেছেন। অনেক আগে টিভি সিরিজ কোজাকেও আমরা দেখেছি এই ফ্যাশানের শুরুটা। পশ্চিমা এই ফ্যাশান বাংলাদেশে প্রচলন করেছেন যারা, তাদের মধ্যে অধ্যাপক কর্নেল কলিমুল্লাহ অন্যতম। এটা তার অগ্রসর চিন্তার সূচক।
(চলবে)
পাঠকের মন্তব্য