'বয়কট ফ্রান্স' বলবেন না ফ্রান্স?

৮১৮ পঠিত ... ১৩:৪৩, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২২

France-boycott

ফ্রান্সে থাকা এক বন্ধু সেদিন বলছিল, গত বছর ডিসেম্বরের ২০ তারিখে ক্রিসমাসের আগে নাকি ফ্রান্স সরকার পরিবার প্রতি মিনিমাম ২০০ ইউরো অতিরিক্ত বোনাস যার যার অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দিয়েছিল। সেই টাকা পেয়ে সবাই মহানন্দে ক্রিসমাসের বাজার করেছে। 

বন্ধুর বক্তব্য হচ্ছে, ‘স্ক্যান্ডিনেভিয়া বা কানাডার মত না হলেও ফ্রান্স একটা মোটামুটি মানের ওয়েলফেয়ার কান্ট্রি। সেন্ট্রাল ইউরোপ, অসাধারণ ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। কৃষ্টি কালচারে অনন্য।’

অতি সত্য কথা। 

আমি বন্ধুকে বললাম, ফ্রেঞ্চ সরকার এই বাড়তি টাকা পায় তার এককালের আফ্রিকান কলোনী দেশগুলো থেকে। ১৪টা আফ্রিকার দেশ এখনো 'কলোনিয়াল ট্যাক্স' নামক এক বিদঘুটে কর দিয়ে থাকে ফ্রান্সকে। অনেকটা জিজিয়া করের মতোই। এবং এর পরিমাণ বছরে প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলার। 

এরা হচ্ছে, মালি, গ্যাবন, চাদ, নাইজার, সেনেগাল, বেনিন, টোগো, বারকিনা ফাসো, কঙ্গো, আইভরি কোস্ট, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, ইকুয়েটরিয়াল গিনি, ক্যামেরুন আর গিনি বিসাউ। 

এই দেশগুলোর ফরেন রিজার্ভের ৫০-৮৫% ফ্রেঞ্চ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রাখার বাধ্যবাধকতা রয়েছে, যেটা কন্ট্রোল করেন ফ্রান্সের অর্থমন্ত্রী! সেই টাকা তারা নিজেদের ইচ্ছামতো খরচও করতে পারে না। ফ্রান্সের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়৷ 

ফ্রান্স থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য এটা ছিল তাদের এক্সিট কন্ডিশন বা শর্ত। শুধু তাই নয়, ঔপনিবেশিক আমলে ফ্রান্স কর্তৃক তৈরি সকল স্থাপনা সমূহের নির্মাণ খরচ প্রদান করতে হবে; 

  • এসব কলোনীতে পাওয়া খনিজ সম্পদ সবার আগে ফ্রান্স কিনতে পারবে, তা-ও ফ্রান্সের নির্ধারিত দামে; 
  • ফ্রেঞ্চকে তাদের অফিসিয়াল ভাষা রাখতেই হবে;
  • ফরাসি মুদ্রা 'ফ্রাঙ্ক' কে বিনিময় মাধ্যম ধরে নিজেদের মুদ্রাব্যবস্থা সাজাতে হবে; 
  • সিনিয়র মিলিটারি অফিসারেরা ট্রেনিং নেবে ফ্রান্সে নিজেদের খরচে; 
  • ফ্রান্সের অনুমতি ছাড়া কোনও সামরিক চুক্তি করতে পারবে না;

এরকম বেশ কিছু আজগুবি শর্ত ছিল এবং আছে 'কলোনিয়াল প্যাক্ট'-এ। 

১৯৫৮ সালে সর্বপ্রথম যখন তারা আফ্রিকান দেশ গিনি'কে স্বাধীনতা দিয়ে চলে যাচ্ছিল তখন সেখানের বিল্ডিং, রাস্তাঘাট, স্থাপনাগুলোকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। লাইব্রেরি থেকে বই বের করে এনে স্তুপ করে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল। 

ফরাসি ঔপনিবেশিক সরকার, তাদের বহনযোগ্য সম্পত্তি নেওয়ার পাশাপাশি মজুতকৃত খাদ্য, গবাদি পশুর খামার, সবকিছুই নষ্ট করে দিয়ে যায়।

এক ধাক্কায় ৪০০০ জন সিভিল সার্ভেন্টকে তারা রাতারাতি প্রত্যাহার করে নিয়েছিল সেদেশ থেকে, যেন প্রশাসন পুরোপুরি অচল হয়ে যায়। উদ্দেশ্য ছিল, বাকী উপনিবেশ দেশগুলোকে একটা কঠোর বার্তা দেয়া। ওইযে, হিন্দিতে বলে না- কায়দে মে রাহো গে, তো ফায়দে মে রাহো গে? বেচাল চললেই এই অবস্থা করা হবে। 

এগুলো ছিল তাদের পরিকল্পিত স্যাবোটাজের অংশ। তারা এটাকে মজা করে বলত, খোরপোশ ছাড়া তালাক, A Divorce without Alimony. 

১৯৬৩ সাল থেকে শুরু করে ২০১২ সাল পর্যন্ত তারা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের প্রায় ২২ জন প্রেসিডেন্ট হত্যা করেছে। একের পর এক প্রেসিডেন্ট হত্যা, ‘ক্যু ডেটা’ (জোরপূর্বক ক্ষমতা দখল)-এর ফলে আফ্রিকার দেশগুলো উক্ত চুক্তি মানতে বাধ্য হয়। অর্জিত হয় “চুক্তিবদ্ধ স্বাধীনতা”।

প্রতিহিংসাপরায়ণ এবং ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ হিসাব করলে ১৯৭১ এর পাকিস্তানি হানাদারদের সাথে ফ্রেঞ্চদের মিল বেশি। বরং ব্রিটিশরা এদিক থেকে ওদের চেয়ে বেটার। তাদের তৈরি স্থাপনাগুলো আমরা এখনো চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। 

ফ্রান্স সম্পর্কে আরও একটা চমকপ্রদ তথ্য জানলে অবাক হবেন। ব্রিটেনের সব দাগী অপরাধীদের আগে যেভাবে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে 'কালাপানি' সাজা খাটার জন্য দ্বীপান্তরে পাঠানো হত, ফ্রান্স কোথায় পাঠাতো? 

আমেরিকায়!

১৭১৯ সালে প্যারিসের জেলখানায় থাকা কয়েদীদের দুইটা শর্তের বিনিময়ে ছেড়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়- তারা প্রত্যেকে প্যারিসের রাস্তায় ভ্রাম্যমাণ পতিতাদের বিয়ে করবে এবং জাহাজে চেপে সোজা আমেরিকার লুইসিয়ানা চলে যাবে। সেখানে তারা থাকবে, খাবে আর বংশবৃদ্ধি করবে। আর কাজ করবে ফরাসি সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে। দক্ষিণের স্টেট 'লুইসিয়ানা' প্রিডমিন্যান্টলি ছিল ফ্রেঞ্চ কলোনি। এর নামকরণ করা হয়েছে ফরাসি সম্রাট চতুর্দশ লুই এর নামানুসারে। বর্তমানে এই স্টেটের রাজধানীর নাম, ব্যাটন রুজ, ফরাসিতে যার অর্থ লাল দন্ড (Red Stick)। 

জিদান আমার অন্যতম পছন্দের খেলোয়াড়। শুধু খেলার জন্যই না, তার অসাধারণ ব্যক্তিত্বের জন্যও। প্যারিসের ঘেটোতে বেড়ে ওঠা জিদানের পিতৃপুরুষের দেশ আলজেরিয়া থেকে ফ্রান্স পারলে বিনা পয়সায় তেল ও গ্যাস আহরণ করে। ফ্রান্সের নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টরগুলোর জন্য যে ইউরেনিয়াম দরকার তার বেশিরভাগ-ই আসে গ্যাবন থেকে। 

এই ১৪টা আফ্রিকান দেশের ইকোনমি ফ্রান্সের কাছে 'জিম্মি'। ফ্রান্স এরকম 'স্যাটেলাইট ইকোনমি' বজায় রেখেছে যাদের কাজ হলো ফ্রান্সের অর্থনীতিতে সস্তায় কাঁচামাল সরবরাহ করা। তাই মাথাপিছু ২০০ ডলার বোনাস প্রদানের বিলাসিতা ফ্রান্স করতেই পারে। 

সবার তো আয় ইনকাম সমান না!

 

৮১৮ পঠিত ... ১৩:৪৩, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২২

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি


Top