পূজা এলে ফেসবুকে যেভাবে নিজেকে অসাম্প্রদায়িক প্রমান করবেন

১১০১১ পঠিত ... ০৬:৪০, অক্টোবর ১৮, ২০১৮

আর্টওয়ার্ক: স্ক্রলড্রলের সৌজন্যে

পূজোর বাদ্য বাজছে; চারিদিকে আনন্দের ঘনঘটা। এই সময়টাতে "আমরা হিন্দু-মুসলমান হাজার বছর ধরে" একে অপরকে সম্প্রীতিতে জড়িয়ে রেখেছি এমন একটি আবহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিয়ে আসা অত্যন্ত জরুরি। 

এক্ষেত্রে প্রয়োজন হবে ডিএসএলআর ক্যামেরা অথবা স্মার্ট ফোন। ক্যামেরা নিয়ে ঘোরাঘুরি করতে হবে পূজো মণ্ডপগুলোতে। অপেক্ষায় থাকতে হবে দাড়ি ও টুপি পরা ভদ্রলোক কিংবা হিজাব পরা নারীদের কেউ মণ্ডপের সামনে দিয়ে হেঁটে যান কিনা। তাদের সামনে রেখে মণ্ডপের ছবি তুলে; সেই ছবিতে "ধর্ম যার যার; উৎসব সবার" শিরোনাম দিয়ে ছেড়ে দিলে হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মিথ একটা বাস্তব ভিত্তি পেয়ে যাবে দর্শকের মনে। 

অসাম্প্রদায়িক আবহের আবেগ সৃষ্টিতে শৈশবের পূজোর স্মৃতি চারণ সবচেয়ে জনপ্রিয় আঙ্গিক। এর অর্থ আপনি শুধু আজ পূজো বলেই নয়; শৈশব থেকেই পূজো এলে, অসাম্প্রদায়িকতা চর্চা করে আসছেন। শৈশব স্মৃতির বর্ণনাটি হতে পারে এরকম-- 

"আমাদের বাড়ির পাশেই ছিলো বন্ধু অনুপমের বাড়ি। পূজোর সময় ওদের পূজো মণ্ডপেই কাটতো দিনরাত। কাকীমার হাতের তিলের নাড়ুর স্বাদ আজো মুখে লেগে আছে। আর কী করে ভুলি লুচি-বুন্দিয়া-পাঁচফোড়ন দেয়া সবজির স্বাদ। এখনো মনে পড়ে, খাবার সময় কাকাবাবু পাতে রসগোল্লা তুলে দিয়ে বলতেন, পেট পুরে খাবে খোকা; পূজোর সময় অল্প খেতে নেই।"

এ ধরনের ছবিতে ছবিতে 'ধর্ম যার যার; উৎসব সবার' শিরোনাম দিয়ে ছেড়ে দিলে হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মিথ একটা বাস্তব ভিত্তি পেয়ে যাবে দর্শকের মনে। ছবি: রয়াল

অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির একটা চূড়ান্ত আবেগ জারিত করতে; আরেক ধাপ এগিয়ে গিয়ে লেখা যায়, "প্রতিমা বিসর্জনের দিনটিতে মনটা খারাপ হয়ে যেতো; বড়রা যখন প্রতিমা বিসর্জনের জন্য বড় নৌকায় উঠতো; আমরা তখন নদীর কূলে দাঁড়িয়ে কেঁদে আকুল হতাম। ফিরে আসার সময় মনে হতো আহারে পুজোটা শেষ হয়ে গেলো।" 

আজকাল আবেগমাখা লেখার ঝুঁকি হচ্ছে; মানুষ এসে প্রশ্ন করে, ও ভাই তারপর আপনার বন্ধু অনুপমের কী হলো; সে কোথায়! 

এ প্রশ্ন আসবেই। অনুপমের পরিণতি বিশ্বজিতের মতো, নাকি রসরাজের মতো, নাকি শ্যামল স্যারের মতো হয়েছে; সে প্রশ্ন আসবেই। এক্ষেত্রে আপনার অসাম্প্রদায়িক উত্তর হবে, "অসুরেরা আমাদের সুখের দিনগুলো কেড়ে নিয়েছে। অনুপম দেশান্তরী হয়েছে।" এক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠবে, অনুপমদের ভিটেটা কারা দখল করেছে ভাই! এটা একটা বিব্রতকর প্রশ্ন। অনুপমের বিপদের মুহূর্তে বন্ধু হিসেবে উপকার করার ছলে নামমাত্রমূল্যে বাড়িটার দখল নিয়ে থাকলেও আপনার ঘাবড়ানোর কোন কারণ নেই। আপনি বলবেন, "আজো যত্ন করে রেখে দিয়েছি ওদের ভিটের তুলসি তলাটি।" পুজোর ঘরটি ভেঙ্গে গাড়ির গ্যারেজ বানিয়েছেন; এ কথা যেন কাকপক্ষীতেও টের না পায়; সেদিকে সজাগ দৃষ্টি থাকতে হবে।

আমাদের সময় পত্রিকায় আবুল বারাকের গবেষণা গ্রন্থের খবর

অনুপমের বাড়ির দখল নেয়ার ব্যাপারটা জাস্টিফাই করতে নিয়ে আসতে পারেন, ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার ঘটনা; ইনকিলাব পত্রিকায় সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেবার রেফারেন্স। এরপর প্রবল আক্ষেপ ফুটিয়ে লিখতে পারেন দীর্ঘশ্বাসের চিঠি-- 

"এখন তুই কোথায় আছিস অনুপম; কী করে ভুলি একসঙ্গে স্কুলে যাবার; বিকেলে সবুজ মাঠে লাল ফুটবল খেলার স্মৃতি; গ্রীষ্মের ছুটিতে আমগাছে উঠে আম পেড়ে খাবার সুখ; শরতের কাশবনে লুকোচুরি খেলা; আজ সবই স্মৃতি।" 

আর অনুপমের বাড়ি আপনি দখল না করে থাকলে; অসাম্প্রদায়িকতার কর্তৃত্ব আপনার হাতে এসে গেলো পুরোপুরি। তখন বাড়ি দখলকারী সর্বদলীয় ঐক্যজোটকে মৃদু বকাঝকা করে তাদের "দুর্বৃত্ত" বলে অভিহিত করে; সবাইকে "আসুন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাতাবরণ গড়ে তুলি" বলে আপনিই শুরু করতে পারেন, "ব্রাদার অফ হিউম্যানিটি মুভমেন্ট"। উল্লেখ্য যে হিউম্যানিটির দোকানদারি এ যাবতকালের সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা।

ছবি: প্রথম আলোর সৌজন্যে

তবে সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রশ্ন করার সুযোগ উন্মুক্ত। কেউ জিজ্ঞেস করে বসতে পারে, দেশ বিভাগের পর একদিনও কী এমন গেছে; যেদিন সংখ্যালঘুরা দেশত্যাগ করেনি! সেটা ঠেকাতে পারলেন না; আজ এমন আদিখ্যেতা করছেন কেন! গাছের গোড়া কেটে আগায় পানি ঢেলে কী লাভ! 

এসময় আপনাকে চিৎকার করতে হবে, এই দেশে কোন সংখ্যালঘু নাই; এই দেশের আসল সংখ্যালঘু হচ্ছে জঙ্গীরা। আমরা তাদের পরাজিত করেছি। এখন অসাম্প্রদায়িকতার উতল হাওয়া বইছে! 

লোকজন নাসির নগরের হিন্দু পাড়ায় হামলার প্রসঙ্গ তুলবে; কথায় কথায় তাদের "-লাউন" বলে গালি দেবার বদ-অভ্যাসের কথা তুলবে। তখন আপনাকে ২০০১ সালে নির্বাচনে জেতার পর বিএনপি-জামাতের হিন্দু-নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরতে হবে। বলতে হবে, ভরসা রাখুন আর যেন মহিষাসুরেরা এ সুযোগ না পায়। 

প্রতিবছরই শোনা যায় পূজায় হামলা চালিয়ে মূর্তি ভেঙ্গে ফেলার ঘটনা। ছবি: সমকাল

পূজো নিয়ে শৈশব স্মৃতি আর অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে আবেগ থৈ থৈ শুকনো কথামালা দিয়ে সম্প্রীতির চিঁড়ে ভেজানো খুব কঠিন। অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাতের গবেষণায় সংখ্যালঘু সম্পত্তি দখলের যে তথ্য বেরিয়ে এসেছে; সেখানে দেখা যায়, ক্ষমতায় আসা কোন দলই পিছিয়ে নেই এই অকাজে। ব্যক্তি হিসেবে আমরা কতটুকু চেষ্টা করেছি বিপন্ন সংখ্যালঘুদের রক্ষায় সে তো বোঝাই যাচ্ছে সংখ্যালঘু বিতাড়নের পরিসংখ্যান দেখে। শত্রু সম্পত্তি আইনে হিন্দু সম্প্রদায়ের মূল মালিকানার ২৬ লাখ একর বেদখল বা ভূমিচ্যুত করা হয়েছে গত পাঁচ দশকে। দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন ১ কোটি ১৩ লাখ হিন্দু। এখন সেক্যুলারিজমের ঠোঁট সৈনিক হয়ে পুজো এলেই আশা করছেন, এখনো যে হিন্দুরা কষ্টে-সৃষ্টে টিকে আছেন; তারা ষাষ্ঠাঙ্গে প্রণাম করে করে পূজোর প্রসাদ খাওয়াবেন আপনাকে! 

তার চেয়ে ফেসবুক লাইভ করুন পূজোমণ্ডপের সামনে দাঁড়িয়ে। ঢাক-ঢোল-কাসরের আওয়াজে; বেদনার্ত মুখগুলো ঢেকে যাক অসাম্প্রদায়িকতার বিজ্ঞাপনে। আনন্দম।

১১০১১ পঠিত ... ০৬:৪০, অক্টোবর ১৮, ২০১৮

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি


Top