পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় গৌতম বুদ্ধের অন্তর্গত শক্তিই যথেষ্ট হওয়া উচিত। কারণ সেখানে বসবাসকারী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বুদ্ধের আদর্শে উজ্জীবিত।
কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে জনমানুষের অধিকার লঙ্ঘিত হলেই মা দুর্গা চলে আসেন উত্তর ভারতের অবয়ব আর পশ্চিমবঙ্গের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। অথচ পার্বত্য এলাকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তো দেবী দুর্গার অনুসারী নন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকার প্রতিষ্ঠায় যে শিল্পীরা ছবি আঁকেন; তারা দেবী দুর্গার ছবি আর অসুরের ছবি আঁকতে শিখেছেন। ফলে তাদের প্রতিবাদী রেখাচিত্রে গৌতম বুদ্ধের দেখা নেই।
আমরা পূর্ববঙ্গের কালো মানুষ। কিন্তু আমাদের আর্য আকাঙ্ক্ষার ধলা মানুষের কল্পনা প্রবল। দেবী দুর্গার উত্তর প্রদেশের গৌর বর্ণ, টিকোলো নাক। আর আমাদের নিজের মতো গায়ের রঙ অবয়ব মানেই অসুর। মঙ্গল শোভাযাত্রায় তাই আমরা আমাদের বাপের চেহারার অসুরের মোটিফ এঁকে নিজেরা বড্ড শিবাজীর পুলক পেয়েছি। টডের তরবারিতে অসুর নির্মূল কমিটি করেছি।
ফলে আমাদের চারুকলা মানেই শিবাজীর তুলি। আমরা সকল রোগের মহৌষধ হিসেবে মা দুর্গার ত্রিশূল ও বর্শাকে চিনি।
এই আর্য অহম আমাদের অনেক পুরোনো। সেই সেন আমলে আমরা নালন্দা থেকে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের তাড়া করতে করতে চট্টগ্রামে পৌঁছে দিয়েছিলাম।
পরে নবাবী আমলে শিবাজী ভক্তরা বর্গির বেশে হানা দিয়ে আমাদের দুর্গা দেবীর পূজাটা ঘটা করে করতে শেখায়। আর নবাবদের উৎখাত করে ব্রিটিশেরা এলে আমরা তাদের তেলাঞ্জলি দিতে দুর্গা মায়ের মুখাবয়বে রাণী ভিক্টোরিয়াকে ফুটিয়ে তুলি।
আমাদের আর্য আকাংক্ষাটা এত প্রবল যে, উচ্চশিক্ষিত হয়েও আমরা প্রেম, পরিণয়ের জন্য এমন মেয়ে খুঁজি; যার মুখখানা দুর্গার মতো চাঁদপানা।
ব্রিটিশের সেরেস্তাদার, মুন্সী, চাপরাশি চিরস্থায়ী জমিদারি পেলে; তারা জমিদার বাড়িতে ঘটা করে দুর্গা পূজা করতে শুরু করেন। মা দুর্গার দাপটে বিদ্যা দেবী সরস্বতী আর শক্তির দেবী কালী তেমন জনপ্রিয় হতে পারেননি। ছোট করে একটা পূজা করে ছেড়ে দিই। তেমন ছুটি-ছাটা নেই।
বেচারা দুর্গা দেবী ব্রিটিশ আমল থেকেই পলিটিসাইজড হয়ে গেলেন। প্রথমে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার মতো করে দুর্গা প্রতিমার মুখখানি নির্মাণ। এরপর ক্রমে ক্রমে ইন্দিরা গান্ধী থেকে মমতা ব্যানার্জির মুখমণ্ডল। আর মনের অজান্তে শেখ হাসিনার মুখের আদল ফুটিয়ে তুলেছেন আমাদের চারু ও কারু শিল্পীরা।
ভারতে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর, অসুরের মুখাবয়বে গান্ধীজী, এ বছর ট্রাম্প, ইউনূস ও শাহবাজ।
আর অগ্নি দাদা ত্রিপুরা ও মিজোরাম দিয়ে মা দুর্গাকে নিয়ে পৌঁছে গেছেন পার্বত্য চট্টগ্রামে। সেখানে অসুর হিসেবে আঁকা হয়েছে সেনাবাহিনীকে। কারণ পুলিশ ও বিজিবির কেউ কেউ প্রসাদ পেয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলেও সেনাবাহিনী আগুনের হোলি খেলতে দেয়নি অগ্নি দাদাকে।
শতকের পর শতক আর্য কল্পনার উচ্চবর্ণদের অত্যাচার নির্যাতন সয়ে অবশেষে সাম্যের খোঁজে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলমানেরা চোখের বদলে চোখ নীতিতে সংখ্যায় কম হিন্দু ও বৌদ্ধদের ওপর চড়াও হয়। ভারতে যেমন সংখ্যায় বেশি হিন্দুরা মুঘল শাসনামলের প্রতিশোধ স্পৃহায় সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর চড়াও। মায়ানমারে যেমন সংখ্যায় বেশি বৌদ্ধরা সংখ্যায় কম মুসলমানদের ওপর চড়াও। এ এক অভিশপ্ত ভূগোল।
অন্য কোনো ইজম জমাতে না পেরে হিন্দুইজম, মুসলমানিজম ও বৌদ্ধ ইজমের খেলা চলছে হরদম। এক সময়ের অত্যাচারিত ক্ষমতা পেলে অত্যাচারী হয়ে উঠছে। ফলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দুষ্টচক্রটা থামছে না কিছুতেই।
এবারের দুর্গা পূজার সময়টাতে সাধারণ হিন্দু-মুসলমানের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল আশা জাগানিয়া। অগ্নি দাদার এত উস্কানিতেও মোটামুটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশে দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হলো।
এ লেখার শেষে একটা ছবির বর্ণনা যুক্ত করছি। শাপলা চত্বরে মুসলমানিজমের রাজনীতিকদের ডাকে এসে বিপন্ন এক মাদ্রাসা পড়া কিশোরের মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে। ফ্যাসিস্ট হাসিনার কোটাল পুত্রেরা সেখানে নিপীড়নের কালো ইতিহাস সৃষ্টি করে। অথচ কখনও চারুকলার রেখাচিত্রে এই কিশোরের একটি ছবিও আঁকা হয়নি। বরং হাসিনার সহমত ভাইদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ‘কান ধরা দিবস’, ‘ছাগুরে ছাগু’ বলে কত না পুলকে হাকালুকি খেয়েছে এইসব সংস্কৃতি মামা ও খালা।
হাসিনার পনেরো বছর মঙ্গল শোভাযাত্রায় দাড়িওয়ালা অসুর বানিয়ে, দাড়িওয়ালা মুসলমান মানেই ছাগু তকমা দিয়ে দিয়ে; এবার পূজায় অসুরের সুন্নতি দাড়ি লাগিয়ে বিতর্ক উঠতেই এতদিনে রবীন্দ্রনাথের দাড়ির কথা মনে পড়েছে; ১৮৫৫ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদারের ছেলের আঁকা অসুরের দাড়ি দেখিয়ে প্রমাণ দিচ্ছে, হে মুসলমান, দাড়ি কি তোমার একার!
অবশ্যই না। দাড়ি নরেন্দ্র মোদীরও। সে কথা এতকাল মনে ছিল না। একটিবারও মোদীকে ছাগু ডাকার কথা সে কল্পনাও করতে পারে না।
একটা বিষয় এরা বুঝতে চায় না, ১৭৭০-৭৬, ১৯৪৩, ১৯৭৪-এর সৃষ্ট কৃত্রিম দুর্ভিক্ষে পুষ্টিহীনতায় বংশানুক্রমে যে ক্ষীণবুদ্ধি বহন করছে অনেকেই; সেখানে ওপর চালাকির ডেপথ কমই হবে। অনায়াসে ধরা পড়ে যাবে ছল-চাতুরি। তোমরা বরং জয়নুল-এসএম সুলতানের তুলির আঁচড়ে ছবি আঁকতে শেখ! কাঁহাতক পড়ে থাকবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে শেখা রেখাচিত্রে; আর অগ্নি দাদার তৈলচিত্রে।
পাঠকের মন্তব্য