তিন বোনের মধ্যে সুলতানা সবার ছোট। বাবা মাঝারি ধরনের ব্যবসায়ী। মোটামুটি সচ্ছল পরিবারের সন্তান হওয়ায় অভাবের তাড়নার সংজ্ঞা সুলতানা জানে না বলাই যায়। বয়স এখন ১৭ চলছে তার। গ্রামীণ পরিবেশে বেড়ে ওঠা এ বয়সী অনেক মেয়েদেরই বিয়ে হয়ে গিয়েছে। সুলতানার কয়েকটা বান্ধবীর তো বাচ্চা ও আছে ইতোমধ্যে। বড় দু বোনের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় বাকি থাকা সুলতানার জন্য প্রায় প্রতিদিনই সম্বন্ধ আসে। কিন্তু বাঁধ সাধে তাঁর বাবা-মা-বোনেরা। তারা চায় সুলতানা আরো পড়াশোনা করুক, নিজের পায়ে দাঁড়াক।
কিন্তু কেউ কখনো জানতে চায়নি সুলতানা কী চায়!
হ্যাঁ, সুলতানার ও নিজস্ব কিছু স্বপ্ন আছে।
স্বপ্ন ভাঙার কষ্টে ভাঙা ঘুম থেকে উঠেই সুলতানা ভাবে, ‘দুনিয়াতে ল্যাখাপড়াডা আবিষ্কার করছিল কে ?
পড়ালেখার মত হাবিজাবি জিনিস দুনিয়াতে ২য় টা আছে বলে তার মনে হয়না।’
মেয়েরা কেন পড়বে? দিন শেষে তো শ্বশুরবাড়ি ই হবে আসল ঠিকানা। এই যে বাবার বাড়ি থাকছে, খাচ্ছে, এই ঘরটাই তো দুদিন পর নিজের থাকবে না।
শ্বশুরবাড়ির লোকজন কী খাবে? কী পছন্দ করবে- কী করবেনা? কিভাবে চলতে হবে? কী বলতে হবে? এসবই তো আসল গন্তব্য। তাহলে এই পড়াশোনা না করলেই বা কি! স্বামী চাকুরি করবে, আর সে বাসায় বসে রান্না-ঘরকন্নায় ব্যস্ত থাকবে। সুলতানা মনে করে মেয়েদের এত বেশি মাথা ঘামানোর দরকার নেই।
এই সব নারীবাদ-টারিবাদ সব বোগাস! মেয়েরা থাকবে পুরুষদের প্রটেকশনে। কেন যে তার বাবা-মা তার বিয়ে দিচ্ছে না সে ভেবে পায়না! ইতোমধ্যে বান্ধবীদের থেকে সে পিছিয়ে আছে এটা ভাবলেই তো কেমন নিজেকে পরাজিত সৈনিক মনে হয়। সুলতানার বোনেরা ওর এই মনোভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকলেও সুলতানা নিজেকে নিয়ে গর্ব করে। সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে জগতে নারীদের কোন পড়াশোনার দরকার ই নেই।
পুরুষরা তো পড়ছেই। সবাই পড়লে বাকিরা কী করবে!
আর সংসার করার মত অক্ষর জ্ঞাণ তো তার আছেই।
এটুকুই যথেষ্ট!
কিন্তু সুলতানার জীবনের এই সুখ স্থায়ী হলনা।
একদিন বাড়িতে সবাই একটা অনুষ্ঠানে বাইরে গিয়েছিল, সুলতানা যায়নি। ঐদিন সমস্ত এলাকায় বিদ্যুৎ ছিলনা। ফলশ্রুতিতে মোবাইলে নেটওয়ার্ক ও ছিল। সুলতানা রিল দেখে না হয় সময়টা কাটিয়ে দিতে পারতো। মায়ের আলমারি খুলে একটা শাড়ি পড়ে সেজে বসে থাকবে ভেবে আলমারি খুলে একটা কোণায় পুরোনো একটা বই পেয়ে যায়। বইয়ের ব্যাপারে তার সাপে-নেউলে সম্পর্ক কিন্তু মলাটে নিজের নাম দেখে বেশ অবাক হয়।
‘সুলতানার স্বপ্ন?’ বইটা নেড়েচেড়ে দেখতে আরম্ভ করে সে! তার পরের কয়েকটা দিন কেটে যায় খুব দ্রুত। সুলতানা বইটা শেষ না করে উঠতে পারেনি। ঘরের সবাই অবাক হয়েছে বটে, কিন্তু কী এসে যায়!
সুলতানার স্বপ্ন বইট সুলতানা শেষ করে ফেলেছে।
কিন্তু তার শরীর ভালো লাগছে না।
মায়ের কাছে গিয়ে নালিশের সুরে অভিযোগ করলো, মা, আমার বই পড়তে ইচ্ছে করে ইদানিং! আমার যেন কী হয়েছে! কেউ আমায় তাবিজ করেছে। আমায় বাঁচাও!



পাঠকের মন্তব্য