আমাদের পাড়াটা এমনিতে শান্ত-শিষ্ট। সবারই সবার সঙ্গে সদ্ভাব রয়েছে। কিন্তু জগলুলের ছেলে শরিয়তের সঙ্গে জগন্নাথের ছেলে শিবব্রতের মাঝে সবসময় একটা চাপা টেনশন লেগে থাকে। অথচ জগলুলের সঙ্গে জগন্নাথের দীর্ঘকালের বন্ধুত্ব। কিন্তু শরিয়ত আর শিবব্রত কি সব পার্টি টাট্টি করে ফোর-টুয়েন্টি করে বেড়ায়।
শিবব্রতের বন্ধু সহমত ডাকাতি করে ধরা পড়ে মহল্লা ছাড়া হয়েছে। একাকীত্ব ঘুঁচাতে সাত্তারের ছেলে রহমতের ওপর ভর করেছে। ফলে এখন পাড়ার টেনশনটি শিবব্রত ও রহমত বনাম শরিয়ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই যে জগলুল, জগন্নাথ, সাত্তার; তাদের বন্ধুত্বে কখনো চ্যুতি ঘটেনি। সুখে দুঃখে একটা জীবন একসঙ্গে কাটিয়ে দিলো তারা।
কিন্তু ঐ যে শিবব্রত একদিন বলে বসলো বেদে সব আছে; আর শরিয়ত বলে বসলো কুরানে সব আছে; তারপর থেকে সেটা একটা রাজনৈতিক কোন্দলে পরিণত হলো। একথা সত্যি যে শিবব্রত পুরো বেদ পড়ে অর্থ আত্মস্থ করেছে; কিংবা শরিয়ত পুরো কুরান পড়ে আত্মস্থ করেছে এমন নয়। দুজনেরই আসলে কুঁচকুচানি স্বভাবটা প্রবল। জগলুল ও জগন্নাথ উভয়েই নিজ নিজ সন্তানকে পাড়ায় এসব দলাদলি করতে নিষেধ করেছে। কিন্তু শার্ট প্যান্ট পরে দুটো পাশ দেয়ায় ছেলে দুটো ফাদার ফার্স্ট হয়ে গেছে। বাপের চেয়ে বেশি বুঝতে শুরু করেছে।
শিবব্রত পাড়ার ললিতা, আনারকলি, কল্পনা, আলপনাকে নিয়ে বেশ একখানি আড্ডা জমিয়েছে। ললিতা সেজে গুঁজে পাড়ার হার্ট থ্রব হতে মরিয়া। ললিতার সঙ্গে একটু কথা বলার ইচ্ছা থেকেই প্রথমে সহমত ও অধুনা রহমত শিবব্রতের সঙ্গে সখ্য করেছে।
শরিয়ত পাড়ার রাবেয়া, আলিয়াকে নিয়ে বেশ একখানি আড্ডা জমিয়েছে। আলিয়া সেজেগুঁজে পাড়ার হার্টথ্রব হবার প্রতিযোগিতায় আছে। ফলে আলিয়ার সঙ্গে একটু কথা বলার ইচ্ছা থেকে রহমত শরিয়তের সঙ্গে সখ্য করার চেষ্টা করেছিল। সেখানে সাড়া না পেয়ে এখন সে শিবব্রতের দ্বারস্থ হয়েছে। তাতে যদি ললিতার কাছাকাছি যাওয়া যায়।
এসব ছেলেমানুষী দ্বন্দ্ব ভূমিবাস্তবতায় থাকলে কোন সমস্যা ছিলো না। কিন্তু ফেসবুকে দুটি পক্ষ হয়ে প্রতিদিন শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতা করে পাড়ার পরিবেশটা তেতো করে তুলেছে তারা।
শিবব্রত নিজেকে প্রগতিশীল দাবি করে শরিয়তকে মৌলবাদি জঙ্গি তকমা দিয়েছে। শরিয়ত তখন শিবব্রতকে শাহবাগী শাতিম তকমা দিয়েছে। ছোট্ট পাড়া মহল্লার বিবাদটাকে বিরাট ল্যান্ডস্কেপে ফেলে গালিভার'স ট্রাভেলসের ক্ষুদ্রাকৃতি ব্লেফুসকুডিয়ান ও লিলিপুটিয়ানদের টুথপিক সাইজের তীর-ধণুক চালনায় নিয়ে গেছে।
জগন্নাথ তার ছেলেকে ডেকে বলে, ফেসবুকে যে এতো বড় বড় কথা বলিসরে শিবু; বাপ যে মুদি দোকানে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে; একটু দোকানে এসে বসলেও তো পারিস। জগলুলও তার ছেলে ডেকে কড়কে দেয়, বাপ কাপড়ের দোকান চালাইয়া সংসার চালায়, তারে একটু সাহায্য না কইরা বিরাট আমার সম্ভ্রান্ত মুসলমান সাইজা বইছো!
শিবব্রত ফেসবুকে কলকাতার বনেদী দাদা সেজে বসে। শরিয়ত ফেসবুকে আরব শেখ হয়ে পড়ে। শিবব্রত আহাজারি করে, দেশটা যে ছদ্ম পাকিস্তান হয়ে গেলো! শরিয়ত পালটা লেখে, দেশটা ছায়া ভারত না হলেই ছদ্ম পাকিস্তান মনে হয়।
এরকম প্রতিপক্ষতার উত্তাপ ছড়াতেই শিবব্রতের ফলোয়াররা রাবেয়া ও আলিয়ার ফেসবুক পোস্টে গিয়ে গালাগালি শুরু করে। শরিয়তের ফলোয়ারেরা ললিতা, আনারকলির পোস্টে গিয়ে গালাগাল চালাতে থাকে। শেষ পর্যন্ত পাড়ার মেয়েরাই ভিক্টিম হয় শিবব্রত ও শরিয়তের খেলনা ইজমের কাইজ্জাতে।
চায়ের স্টলে নিজেদের আড্ডায় ললিতা ও আলিয়ার বাবা এসে শরিয়ত ও শিবব্রতকে নিয়ে নালিশ করে। শরিয়তের বাবা জগলুল বলে, এই শরিয়তরে নিয়া কী করি! শিবব্রতের বাবা জগন্নাথ বলে, শিবব্রতেও বইসা খাইয়া চর্বি হইছে অনেক।
চাওয়ালা উপদেশ দেয়, বিয়া দিয়া দেন পোলা দুইটারে। সংসারের ঘানি ঘাড়ে পড়লে তখন আরবের শেখ আর কলকাতার বাবু হওয়ার শখ মিইটা যাইবো। বউয়ের ঝাড়ি খাইয়া বুঝবো, কত ধানে কত চাইল।



পাঠকের মন্তব্য