চৌধুরী সাহেব ও মুন্সীজির বয়স হয়েছে। জীবনের পনেরোটি বছর নষ্ট হলো অযথাই। ইলেকশন এলো, ইলেকশন গেল; কিন্তু দাঁড়াতে দিল না হাসিনার জমিদারেরা। তাই এবার বয়স নেই; শরীরে কুলাচ্ছে না; তবু শেষবারের মতো জমিদারির স্বাদ নিতে ইচ্ছা করছে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তটা এবার ভোটে জিতে পোক্ত করে না দিলে ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি গদিনশীন হবে কি করে!
সেই যে বৃটিশ সাহেব চিটাগাং কালেক্টরেট থেকে এলাকায় এলে দারোগা বাবু দাদাসাহেবকে বলেছিল, বৃটিশ সাহেবের জন্য খানাপিনার বন্দোবস্ত করতে হয় যে মিয়া সাহেব। বৃটিশ সাহেব কালেক্টর অফিসের মুন্সীকে সঙ্গে নিয়ে এসে দাওয়াত খেয়ে খুশি হয়ে বলল, মোগাম্বো মুশ হুয়া চৌধুরী। সেই থেকে এলাকার সম্ভ্রান্ত চৌধুরী হিসেবে নাম রটে গেল। বৃটিশ সাহেবের সমভিব্যহারের মুন্সীটিও মুন্সীজি হয়ে উঠল। এরপর পাকিস্তানি সাহেব, বাংলাদেশি সাহেব চৌধুরী সাহেব ও মুন্সীজির বাসায় দাওয়াত খেয়ে খেয়ে এটা পাকাপোক্ত করে ফেলল, পরিবার দুটি সম্ভ্রান্ত অতি; এমন পোরসেলিনের তৈজস, মোরগা মোসাল্লাম, নক্সী আরাম কেদারা; লাল কাপড়ের চামর, দ্বিতল হাভেলি এলাকায় আর কারও ছিল না।
স্বাধীন বাংলাদেশের ৫৪টি বছর ভালোই কেটেছে চৌধুরী ও মুন্সী পরিবারের। এলাকায় নতুন নতুন দেশপ্রেমিক ইজারাদার, ঠিকাদার, রাজনীতিদার এলেও; চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ভিত এতোটুকু নড়েনি। এমনকি উন্নয়নের বন্দোবস্তেও নতুন ফুপাতো ভাই ও খালাতো ভাই এমপি হয়ে দোয়া নিয়ে গেছে। প্রত্ন পোরসেলিনের পাত্রে মোরগা মোসাল্লাম খেয়ে আভিজাত্যের ঢেঁকুর তুলে গেছে হাসিনার জমিদারেরা। এলাকার সম্ভ্রান্ত পরিবারের পরশ পাথর হয়ে রয়ে গেছে চৌধুরী ও মুন্সী খানদান। ৫ অগাস্ট পালানোর সময়েও দেখা করে গেছে হাসিনার জমিদারেরা, চৌধুরী সাব, মুন্সীজি জমিদারি ফালাইয়া যাইতেছি; ইচ্ছা হইলে মাস খরচটা ইন্ডিয়া পাঠাইয়া দিয়েন। আমরা-আমরাই তো; আপনেগো বিপদে আমরা আপনেগো দেখছি; আমাগো বিপদে আপনারা আমগো দেখবেন সেই বিশ্বাস আছে।
৫ অগাস্টের পর, জুলাই অভ্যুত্থানের তরুণেরা এলাকায় মিছিল করলে, চৌধুরী সাহেব মুন্সীজিকে ফোন করে বলে, নতুন আপদ আইল। এরা আবার কয় নতুন বন্দোবস্ত আনব! ইলেকশন বাইর হইলেই শখ মিইটা যাইব। আরে বাবা বন্দোবস্ত একটাই; চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত।
যেহেতু পুলিশ ও প্রশাসনের লোক সেই বৃটিশ আমল থেকে চৌধুরী সাহেবের বাড়িতে দাওয়াত খায়; ফলে তাদের ভীষণ আপনা লোক মনে হয়। তাই লাঠিতে ভর দিয়ে নির্বাচনী জনসভায় গিয়ে চৌধুরী সাহেব হুংকার দেয়, প্রশাসন আমাদের কথায় উঠবে-বসবে-গ্রেপ্তার করবে; আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন।
আগে তবু ইলেকশনটা একটু লড়ে জেতার ধৈর্য্য ছিল। কিন্তু হাসিনা এমন এক লাইলাতুল ইলেকশনের নেশা লাগিয়ে দিয়ে গেছে; যে ভোটের আগের রাতে পুলিশ-প্রশাসনের লোক দিয়ে ব্যালটে সিল মেরে বক্সে বোঝাই করে; সকাল সকাল জিতে যাওয়ার একটা খোয়াব এখন চৌধুরীর চোখে।
মুন্সীর শরীররা দীর্ঘদিন খারাপ যাচ্ছিল। বহুবছর সংসদের সবুজ সিটে বসতে না পেরে গভীর হতাশায় শরীরের অর্গানগুলো ফেইল করতে থাকে। ৫ অগাস্ট তরুণেরা হাসিনা ও তার দোসরদের দিল্লি-কলকাতায় পাঠিয়ে দিলে; তারপর হাসপাতালের বিছানায় শরীরের অর্গানগুলো মিছিল করতে থাকে, চলো চলো সংসদে চলো।
লাঠিতে ভর দিয়ে নির্বাচনী জনসভায় গিয়ে মুন্সীজি বলে, যার বংশ পরিচয় নেই, বাপ-দাদার নাম নেই, সেও নাকি এমপি হবে।
সেই তো; যার পরিবারের লোক মারা গেলে পত্রিকায় লেখে, উনি শিয়ালনগরের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সেইরকম পরিবারের লোক ছাড়া মাননীয় সাংসদ হয় কি করে!
পুরো সমাজ জুড়ে তাই চৌধুরী ও মুন্সী হবার স্বপ্ন দাপিয়ে বেড়ায়। আলেম, বুদ্ধিজীবী, মাদ্রাসা শিক্ষিত যুবক, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষিত যুবক, পশ্চিমা শিক্ষিত কলাম লেখক; সবাই মিলে পুরোনো বন্দোবস্ত টিকিয়ে রাখতে কতই না রঙ্গে ইজম চুষতে থাকে। ডিএনএ-তে চৌধুরী আর মুন্সীদের ছড়িয়ে দেওয়া খুদ কুঁড়ো খেয়ে এফলুয়েন্ট হবার স্বপ্ন তাদের। টিভি টক-শোতে গিয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে শেখ, মির্জা, চৌধুরী, মুন্সীর পক্ষে বয়ান তৈরির ইঁদুর দৌড়ে অক্লান্ত মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়ার দল। কেউ শেখ চুষে সচ্ছল, কেউ মির্জা চুষে সফল, কেউ চৌধুরী চুষে মাতোয়ারা।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদারের নায়েব, গোমস্তা, মোল্লা, পুরোহিত, স্তবগায়ক, কোটালপুত্রের ডিএনএ জুড়ে জমিদার বাঁচাও রব।
বঙ্গভঙ্গ রদের আন্দোলনের ভঙ্গিতে নতুন বন্দোবস্ত রদের আন্দোলনে যেমন খুশি তেমনি সাজার মাতম।
তাই তো, দরিদ্র গরুর গাড়ির চালকের নাতি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আজ রিক্সাচালক সুজনের সংসদ নির্বাচনের প্রার্থিতা দেখে ছ্যা ছ্যা করে। এক পুরুষ আগে ছাপড়ায় থাকত এমন লোকের নাতি নাতনি ফেসবুকে এসে ইতস্তত একে ওকে ছাপড়ি ডেকে সিগন্যাল দেয়, সে বড্ড এলিট হয়েছে। এইসব চাকরস্য চাকরেরা মিলে পুরোনো বন্দোবস্ত বাঁচাতে মরিয়া তো হবেই।
ফলে মুন্সী ও চৌধুরী জানে, তাদের দাসেরা ডিএনএ-তে বসবাস করে। দাসের ডিএনএ-তে আটকে পড়া কোটাল পুত্র যতই শিক্ষিত কিংবা এফলুয়েন্টের ভং ধরুক; সে মুক্তি চাইবে না। বরং চৌধুরী ও মুন্সী, শেখ কিংবা মির্জা, নানারকম ইজমের ফোঁপর দালালি করে কাটাবে অনাগতকাল। দাসের আনন্দ চুষে।



পাঠকের মন্তব্য