অদ্ভুত আওয়ামী আঁধার এক

৩৭০ পঠিত ... ১৮:১৮, নভেম্বর ১২, ২০২৫

এই যে বাসে-ট্রেনে আগুন দেওয়া, মানুষকে পুড়িয়ে মারা, বিভিন্ন জায়গায় ককটেল ও ছোটো বোমা ফুটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি, গুম-খুন-ক্রসফায়ার-আয়নাঘর-গ্রেফতার নির্যাতন, চব্বিশের জুলাইয়ে শিশু-কিশোর-তরুণ-তরুণী হত্যার মানবতাবিরোধী অপরাধ করে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা না থাকা; এসবই আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি। অপরাধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে ক্ষমতা দখলই হচ্ছে; আওয়ামী লীগের কথিত রাজনৈতিক কৌশল।

স্বাধীন বাংলাদেশের ৫৪ বছরের রাজনীতির ইতিহাসে 'ভয় দেখিয়ে' প্রাধান্য বজায় রাখা, হরতাল করে দেশের সম্পদ বিনষ্ট করা, সীমাহীন দেশ ডাকাতি, রিপাবলিকের ধারণা অস্বীকার করে দেশটাকে বাপের দেশ মনে করা, দেশ ও দেশের মানুষকে খরচযোগ্য প্রজা ভেবে নিজেরা রাজা ও রাজন্যবর্গ হয়ে ওঠার যে আদিম স্বপ্ন; তা-ই হচ্ছে আওয়ামী লীগের রাজনীতির উদ্দেশ্য।

এই খল চরিত্রের কারণে বাংলাদেশের মানুষ বারবার তাদের প্রত্যাখান করেছে। কিন্তু প্রত্যাখান সহ্য করতে পারে না উগ্রপন্থী এই সন্ত্রাসী সংগঠন। নিজেদের অগণতান্ত্রিক আচরণ ও মানবতাবিরোধী ভূমিকার কারণে বার বার পতিত হয়েছে দলটি। পতিত হলেই সে ছুটে যায় দিল্লির প্রভুর কাছে। প্রভু তখন প্রভাব খাটিয়ে একটা বন্দোবস্ত দিয়ে যায় এই দলটিকে।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদারদের যে কোটাল পুত্রেরা পূর্ববঙ্গের গ্রামগুলোতে অবাধ্য কৃষককে গলা কেটে নদীতে ভাসিয়ে দিত; সেই কোটাল পুত্রদের উত্তরাধিকার আওয়ামী লীগ। এরা জমিদারের নির্দেশে হেন অপরাধ নেই যা করতে পারে না। সময়ের বিবর্তনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদারদের জায়গাটা নিয়েছে দিল্লির ক্ষমতা-কাঠামো; আর কোটালপুত্রের জায়গাটা নিয়েছে আওয়ামী লীগ।

পূর্ববঙ্গের উর্বর সমতলে সম্পন্ন কৃষক ও কারিগরদের মতো শ্রমঘন মানুষের বাইরে যে দালাল-ফড়িয়া-মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণীটি রয়েছে; আওয়ামী লীগ তাদেরই সমাবেশ। কোনো কাজ করে খাওয়ার যোগ্যতা তাদের নেই। ফলে ভয় দেখিয়ে, লোক ঠকিয়ে কেড়ে ছিঁড়ে খাওয়ার যে অসূয়া ধারা; সেটিই রাজনৈতিক দলের নাম নিয়ে পূর্ব পুরুষের পেশাতেই নিয়োজিত থাকার নাম আওয়ামী লীগ। 

বাংলাদেশে অন্যান্য দলের যে লোকেরা রয়েছে; তারা দল ক্ষমতায় না থাকলেও পরিশ্রম করে বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু আওয়ামী লীগের পরিশ্রম করে বেঁচে থাকার ঐতিহ্য তাদের জীবনধারায় নেই। শৈশব থেকে পরিবারের লোকেদের দেখছে সকাল বেলা সেজে-গুঁজে গ্রামের হাটে চলে যাচ্ছে লোক ঠকাতে; মিথ্যার বেসাতির গল্প ফেঁদে বড় বড় গল্প চাঁড়ছে। গ্রামের হাটের মধ্যে সবচেয়ে বড় গলা করা লোকটা আওয়ামী লীগ।

মুক্তিযুদ্ধেই দেখবেন সেনাবাহিনী ও পুলিশের যারা জীবন বাজি রেখে লড়েছেন; বিএনপি ও বাম দলের যারা সম্মুখ সমরে অংশ নিয়েছেন; যে কৃষক শ্রমিক রক্ত-ত্যাগ ও ঘামে ছিনিয়ে এনেছেন স্বাধীনতা; তাদের স্মৃতিচারণ সত্যের বুননে পরিমিত বয়ান। বাংলাদেশের প্রত্যন্তের শহীদ পরিবারগুলো ব্যক্তিগত বেদনার স্মৃতিকে জমা করে রেখেছে যত্ন করে। কিন্তু আওয়ামী লীগের লোকের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের গল্প মহাভারত-রামায়ণ কিংবা কারবালা পুঁথির আঙ্গিকে এমন সব মহাকল্পনা; বাস্তবের সঙ্গে যার মিল খুব অল্পই।

এই অতিরঞ্জন ও অতিকথন ব্যাপারটা হচ্ছে কলকাতার বেঙ্গল রেনেসাঁর শিক্ষা। শুধু নিজের বাহাদুরীর গল্প, নিজের দেশ ভাগের বেদনার গল্প, চলচ্চিত্র, গান। শেখ হাসিনাই যেমন বেঙ্গল রেনেসাঁ থেকে কাঁদতে শিখেছেন। উনি বক্তৃতা দিতে গিয়ে ‘স্বজন হারানোর বেদনা কি তা আমি জানি’ বলে কমপক্ষে এক লক্ষবার কেঁদেছেন। গ্রামাঞ্চলের যাত্রার অতি অভিনয়টাকেই বেঙ্গল রেনেসাঁ ঝেড়ে মুছে শিল্প-সাহিত্য-চলচ্চিত্রে উপস্থাপন করেছে। আওয়ামী লীগের লোকের ভাষণ যেমন যাত্রার বিবেকের মতো কেঁপে কেঁপে কথা বলা।

বেঙ্গল রেনেসাঁর কালচারাল উইং যেভাবে নবাবী আমল ও মুঘল আমলের শাসকদের নিষ্ঠুরভাবে চিত্রিত করে; বৃটিশকে ভারত ভাগ্য বিধাতার আসনে অধিষ্ঠিত করেছিল; আওয়ামী লীগ সেভাবেই রাজনীতির প্রতিপক্ষকে নিষ্ঠুর হিসেবে চিত্রিত করে; নিজেদের বাংলাদেশের ভাগ্য বিধাতা হিসেবে চিত্রিত করেছে। বৃটিশকে তেলাঞ্জলি দিয়ে যেভাবে ভারতের ক্ষমতা লাভ করেছিল সাম্প্রদায়িক চিন্তার লোকেরা; আওয়ামী লীগ তেমনি দিল্লিকে তেলাঞ্জলি দিয়ে বাংলাদেশের ক্ষমতায় বার বার এসেছে। দিল্লির রাজনীতির মূল জ্বালানি যেহেতু ইসলামোফোবিয়া; ফলে আওয়ামী লীগকে সেই সাম্প্রদায়িক চেতনার অন্তঃসলিল প্রবাহকে আলিঙ্গন করতে হয়েছে। বেঙ্গল রেনেসাঁ ইসলামোফোবিয়ার নাম দিয়েছিল অসাম্প্রদায়িকতা। আওয়ামী লীগের মন্ত্র সেই কথিত অসাম্প্রদায়িকতা।

বাংলাদেশে হিন্দু জনগোষ্ঠীর সম্পদ দখলের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সবার শীর্ষে। গ্রামের টাউট ফড়িয়া থেকে ঢাকার অভিজাত এলাকায় উঠে আসার রুপকথা রচিত হয়েছে ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে হিন্দু ও অবাঙালি ধণিক শ্রেণীর বাড়ি-জমি দখলের মাঝ দিয়ে।

এ কারণে দেশ লুণ্ঠন করে অভিজাত ড্রইরুমে বসে ছবি তুললেই আওয়ামী লীগের লোককে ময়ূর পুচ্ছ পরা কাক মনে হয়। রবীন্দ্র সংগীত শুনে মাথা দোলালেও তাকে জোড়াসাঁকোতে বহিরাগত মনে হয়।

ভূমিহীন, ভুখা, অলস, টাউট প্রকৃতির লোকেদের; যাদের হারানোর কিছু নাই; তাদের এনে আওয়ামী লীগে জড়ো করায়; দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করার সময় তাদের পক্ষে ধারণা করা সম্ভব হয় না; কত টাকা ডাকাতি করলে একটা জীবন চলে যাবে। ফলে পিয়নও চারশো কোটি, সহ-সভাপতিরা এক হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠন করে দেশের অর্থনীতি ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। ক্ষমতায় থাকতে আওয়ামী লীগের নেতাদের খাবার টেবিলে থরে থরে খাবার সাজানো থাকত। একজন মানুষের কতটুকু খাবার প্রয়োজন সেটা বুঝতে পারে না। আর ভূমিহীন মানুষ জমি দখল করে বা দুর্নীতির টাকায় জমি কিনে  বাড়ি তোলায়; নিজেদের দেশের মালিক মনে করতে শুরু করে। ফলে মুজিব শতবর্ষে টাকা মেরে পাকা দালান তোলা লোকটি কিংবা এটু আই প্রজেক্টে টাকা পাওয়া মেয়েটি; ভিন্নমতের লোকেদের পাকিস্তান ও এমেরিকায় চলে যেতে বলে।

ইতিহাসের সমৃদ্ধ জনপদ পূর্ববঙ্গের নদী মানুষের সহজ-সরল মনোজগতের সঙ্গে আওয়ামী লীগ মানানসই নয়। কারণ সে কলকাতার বেঙ্গল রেনেসাঁর ব্যাপ্টিজমে তৈরি হওয়া জটিল মানুষ। কলকাতায় যেমন প্যাঁচ মারা বুদ্ধি দিয়ে কুঁচ কুঁচ করে সিরাজ উদদৌলার চরিত্র হনন, মুখে যা এলো তা বলে দেওয়া; আওয়ামী লীগ বিশুদ্ধ বাঙালি সংস্কৃতির নামে ঐ প্যাঁচ মারা বুদ্ধি দিয়ে কুঁচ কুঁচ করে জিয়া-খালেদা হয়ে অধুনা ইউনুসের চরিত্র হননে লেগে পড়ে।

অথচ পূর্ব-বঙ্গের বাঙ্গালির জীবন কর্মমুখর, প্রতিটি পরিবারে পরচর্চাকে নিরুতসাহিত করা হয়। কোথাও একটু পরচর্চা দেখলে মুরুব্বিরা বলে ওঠেন, গীবত করতে নেই। জেন-জি হয়েছে ঠিক তাদের দাদা-নানার প্রজন্মের মতো। এরা পরচর্চা শোনে না, তাকে পাত্তাও দেয় না। ফলে তারা আওয়ামী লীগের গীবতের কালচারকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেছে।

ইন্টারনেটের কল্যাণে, বইপুস্তকের মাধ্যমে, আর বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশী পৃথিবীর নানাদেশে ছড়িয়ে পড়ায় বাংলাদেশ গ্লোবালাইজেশনের সঙ্গে সহজাতভাবে যুক্ত। বাংলাদেশ সমাজ এগিয়ে গেছে; এখানে পশ্চাৎপদ আওয়ামী একেবারেই মানানসই নয়। আধুনিক কলকাতার জেন-জি যেখানে বাংলাদেশের জেন-জি'র জুলাই-বিপ্লবের সারথী হয়েছে; আওয়ামী লীগ সেখানে পড়ে আছে প্রাচীন কলকাতার ময়ূখরঞ্জন আর অতিরঞ্জন বাজারে।

আওয়ামী লীগের জন্য জরুরি বাস্তবতা মেনে নিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়া। ২০০৯-২৪ (৫ অগাস্ট) পর্যন্ত করা মানবতাবিরোধী অপরাধ আর গত প্রায় পনেরো মাস ধরে অনুশোচনাহীন নরভোজি মানসের সংশোধন ছাড়া এই অভিশপ্ত পলাতক জীবন থেকে মুক্তি নেই। ডিনাইয়াল বা অস্বীকার হচ্ছে চোরাবালির মতো; এতে মানুষ তলিয়ে যায় বিবেকহীনতার অতলে। প্রয়োজন হলে তারা মানসিক স্বাস্থ্যের পরিচর্যায় থেরাপি নিতে পারেন। সমকালে টক্সিক মস্তিষ্কের চিকিৎসায় থেরাপি খুব স্বাভাবিক বিষয়। আর রবীন্দ্র সংগীতগুলোই গভীর মনোযোগ দিয়ে শোনা উচিত তাদের। রবীন্দ্রনাথ আসলে কুৎসা প্রিয় ও কর্কশ কলকাতা সমাজকে জীবনের গভীরের জীবন দেখাতে আর সুবোধ সঞ্চার করতে চেয়েছিলেন গানে গানে। তার শান্তি নিকেতন ছিল অনুশোচনা আর শিষ্টাচার সম্পন্ন সরস মানুষ তৈরির স্বপ্ন। প্রতিহিংসা, রক্ততৃষ্ণা, অবৈধ সম্পদের লোভ, বানিয়ে-ছানিয়ে মিথ্যা বয়ান বানানোর বাইরে 'বসন্তের মাতাল সমীরণ' উপভোগ করার নির্মল বাঙালিই ছিল তার আরাধ্য। 

৩৭০ পঠিত ... ১৮:১৮, নভেম্বর ১২, ২০২৫

আরও

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি


Top