আমাদের গোলকিপার পাঁচুগোপাল সেদিন ভুল করে ওর পিসিমার চশমা চোখে দিয়ে মাঠে নেমে পড়েছে। তার পরে আরকি–একসঙ্গে তিন দিকে তিনটে বল দেখতে পায়, ডাইনের বলটা ঠেকাতে যায় তো বাঁয়েরটা গোল হয়ে যায়। বলটুদা আবার বুদ্ধি করে একটা ব্যাক পাস করেছিল। তাতে করে একটা সেমসাইড!
এখন হলো কি, ছটা গোল দিয়ে টাইগার ক্লাব কী রকম নার্ভাস হয়ে গেল। আনন্দের চোটে ওদের তিনজন খেলোয়াড় অজ্ঞান হয়ে পড়ল। বাকিরা কেবল লাফাতে লাগল। সেই ফাঁকে ছয়টা বল ফেরত গেল ওদের গোলে। তখন সেই ফুর্তির চোট লাগল থান্ডার ক্লাবে। আর কে যে কোন দলে খেলছে, খেয়ালই রইল না। টেনিদা বেমক্কা হাবুল সেনকেই ফাউল করে দিল আর ন্যাড়া মিত্তির তখন নিজেদের গোলে বল ঢোকানোর জন্য মরিয়া। থান্ডার ক্লাবের দুজন তাকে জাপটে ধরে মাঠময় গড়াগড়ি খেতে লাগল। ব্যাপার দেখে রেফারি খেলা বন্ধ করে দিলেন। আর কোত্থেকে একটা চোঙা এনে সমানে ভাঙা গলায় চেঁচাতে লাগলেন, ‘ড্র–ড্র–ড্রন গেম–এক্ষুনি সব মাঠ থেকে কেটে পড়ো, নইলে পুলিশ ডাকব–হুঁ!’
সেদিন সন্ধের পর এই নিয়ে দারুণ আলোচনা চলছিল আমাদের ভেতরে। হঠাৎ টেনিদা বলল, ছোঃ, বারোটা গোল আবার গোল নাকি? একবার একাই আমি বত্রিশটা গোল দিয়েছিলুম একটা ম্যাচে।
অ্যাঁ! চুইংগাম চিবুতে চিবুতে ক্যাবলা একটা বিষম খেল।
খেলাটি কোথায় হয়েছিল?
ঘুঁটেপাড়ায়। কি পেলে, ইউসেবিও, মুলার নিয়ে লাফালাফি করিস! জীবনে একটা ম্যাচে কখনও বত্রিশটা গোল দিয়েছে তোদের রিভেরা, জেয়ার জিনেহা? ববি চার্লটন তো আমার কাছে বেবি রে!
বুঝলি! ঝালমুড়ি চিবুতে চিবুতে টেনিদা বলতে লাগল, ছ দিনের জন্যে তো বেড়াতে গেছি মোক্ষদা মাসির বাড়িতে। ভরা শ্রাবণ, থেকে থেকেই ঝুপঝাপ বৃষ্টি। সেদিন সকালে মাসিমা তালের বড়া ভেজে ভেজে তুলছেন আর আমি একটার পর একটা খেয়ে যাচ্ছি। এমন সময় কটা ছেলে এসে হাজির।
অনেকবার তো ঘুঁটেপাড়ায় যাচ্ছি, ওরা সবাই আমায় চেনে। বললে, ‘টেনিবাবু, বড় বিপদে পড়ে আপনার কাছে ছুটে এলুম। আজ বিকেলে শিবতলার মাঠে বিচালিগ্রামের সঙ্গে আমাদের ফুটবল ম্যাচ। ওরা ছ জন প্লেয়ার কলকাতা থেকে হায়ার করেছে, আমরাও ছজন এনেছি। কিন্তু মুশকিল হলো, আমাদের এখানকার একজন জাঁদরেল খেলোয়াড় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আপনাকেই আমাদের উদ্ধার করতে হচ্ছে, দাদা।’
জানিস তো, লোকের বিপদে আমার হূদয় কেমন গলে যায়। তবু একটা কায়দা করে বললুম, ‘সব হায়ার করা ভালো ভালো প্লেয়ার, ওদের সঙ্গে কি আর আমি খেলতে পারব? তাছাড়া এ বছরে তেমন ফর্ম নেই আমার।’ ওরা তো শুনে হেসেই অস্থির। কী যে বলেন স্যার, আপনি পটলডাঙ্গার টেনিরাম শর্মা–আপনার ফর্ম তো সব কাজে সবসময়েই থাকে। অত বুঝিনে দাদা, আপনাকে ছাড়ছিনে। আমাদের ধারণা, মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গল তো তুচ্ছ–আপনি ইচ্ছা করলে বিশ্ব একাদশে খেলতে পারেন।
‘ওরা হেঁ-হেঁ করে চলে গেল, কিন্তু আমাকে রাজি করিয়েও গেল। আমার ভীষণ ভাবনা হলো রে। কিন্তু ফিরিয়েও তো দেওয়া যায় না। আমার নিজের, পটলডাঙার সব প্রেস্টিজ বিপন্ন।
বিকেলে আকাশজুড়ে কালো মেঘ। মনে হলো, দুর্দান্ত বৃষ্টি নামবে। তবু মাঠে গিয়ে দেখি, বিস্তর লোক জড়ো হয়ে গেছে। একদল হাঁকছে, বিচালিগ্রাম, হিপ হুররে–আর একদল সমানে উত্তর চড়াচ্ছে, ঘুঁটেপাড়া, হ্যাপ-হ্যাপ-হ্যাররে। ওরা হিপ হিপ বলছে কি না, তাই পাল্টা জবাব। ওরাও যদি হিপ হিপ করে, তাহলে এরা বলবে না, এদের নকল করছে? ওরা যদি বলত বিচালিগ্রাম জিন্দাবাদ–এরা সঙ্গে সঙ্গে বলত ঘুঁটেপাড়া মুর্দাবাদ। নকল করে অপমান হওয়ার চাইতে মরে যাওয়া ভালো, বুঝলি না?
বিলক্ষণ! আচ্ছা, বলে যাও।
এতেই বুঝতে পারছিস দুটো গ্রামে রেষারেষি কী করম। দারুণ চিৎকারের মধ্যে তো খেলা শুরু হলো। দু মিনিটের মধ্যেই বুঝতে পারলুম, বিচালিগ্রামকে এঁটে ওঠা অসম্ভব। ওরা ছ জনেই এ ডিভিশনের প্লেয়ার এনেছে–খেলায় ওদের আগুন ছোটে। আর ওদের গোলকিপার! সে একবারে ছ হাত লাফিয়ে ওঠে, বল তো বল, বন্দুকের গুলি অব্দি পাকড়ে নিতে পারে।
খেলা শুরু হতে না হতেই বল এসে একেবারে ঘুঁটেপাড়ার ব্যাক লাইনে চেপে পড়ল, মাঝ-মাঠও আর পেরোয় না। আর ওদের গোলকিপার শুনিয়ে-শুনিয়ে বলতে লাগল, ‘একটা বালিশ আর শতরঞ্চি দাও হে–একটু ঘুমিয়ে নেব।’
এমন সময় আকাশ ভেঙে ঝমঝম বৃষ্টি। কিন্তু পাড়াগেঁয়ে লোক, আর কলকাত্তাই খেলোয়াড়ের গোঁ, খেলা দাপটে চলতে লাগল। বল জলে ভাসছে, ধপাধপ আছাড়–এই ফাঁকেও পরপর দুখানা গোল খেয়ে গেল ঘুঁটেপাড়া। ভাবলুম, যাঃ, হয়ে গেল!
বিচালিগ্রাম তারস্বরে চিৎকার করছে, হঠাৎ এ দিকের লাইন্সম্যান ফ্ল্যাগ ফেলে মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বললে, শিবতলার পুকুর ভেসেছে রে–মাঠভর্তি মাছ।
অ্যাঁ–মাছ!
দেখতে দেখতে যেন ম্যাজিক। রইল খেলা, রইল বিচালিগ্রাম আর ঘুঁটেপাড়ার কম্পিটিশন, তিনশ লোক আর একুশজন খেলোয়াড়, দুজন লাইন্সম্যান–সবাই কপাকপ মাছ ধরতে লেগে গেল। প্লেয়াররা জার্সি খুলে ফেলে তাতেই টকাটক মাছ তুলতে লাগল। খেলতে আর বয়ে গেছে তাদের–
এই রে, মস্ত একটা শোলমাছ পাকড়েছি! আরে–একটা বাটামাছের ঝাঁক যাচ্ছে রে! ইস! কী বড় বড় কই, মাইরি! ধর…ধর…!
সে যে একখানা কী কাণ্ড, তোদের আর কী বলব! খেলার মাঠ ছেড়ে ক্রমেই দূরে দূরে ছড়িয়ে পড়তে লাগল সবাই। শেষে দেখি, মাঠে আমরা দুজন। আমি আর রেফারি। রেফারি ওখানকার স্কুলের ড্রিল মাস্টার। বেজায় মারকুটে, ভীষণ রাগী। দাঁত খিঁচিয়ে বললেন, হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছো কী? ইয়ু গো অন প্লেয়িং! ঘাবড়ে গিয়ে বললুম, ‘আমি একাই খেলব?’ ইয়েস! একাই খেলবে। আমি তো খেলা বন্ধ করিনি। ধমক দিয়ে রেফারি বললেন, খেলো। প্লেয়াররা মাঠ ছেড়ে মাছ ধরতে দৌড়ালে খেলা বন্ধ করে দিতে হবে, রেফারিগিরির বইতে এমন কোনো আইন নেই। তখন শুরু হলো আমার গোল দেবার পালা। একবার করে বল নিয়ে গিয়ে গোল দিয়ে আসি, আর রেফারি ফুর্র্ করে বাঁশি বাজিয়ে আবার সেন্টারে নিয়ে আসে। এ-ই চলতে লাগল। এরই মধ্যে আমি যা গোল দেবার দিয়েছি–মানে গুনে গুনে বত্রিশটি। আমি গুনছি না, গোল দিতে দিতে আমার মাথা বোঁ-বোঁ করছে, আর ওই ভারী ভেজা বল বারবার সেন্টার থেকে জলের ওপর দিয়ে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছি–চাড্ডিখানা কথা নাকি! একবার বলেছিলুম, অনেক তো গোল দিয়েছি, স্যার, আর পারছি না, পা ব্যথা করছে! রেফারি আমায় তেড়ে মারতে এলেন, বিকট মুখ ভেংচে বললেন, ‘ইয়ু গো অন গোলিং–আই সে।’ আমি গোল দিচ্ছি আর উনি গুনেই যাচ্ছেন, থার্টি–থার্টিওয়ান–থার্টি টু…। তখন, ওরে গোল দিচ্ছে বুঝি! বলে ওদের সেই গোলকিপারটা দৌড়ে এল। সে যে রকম জাঁদরেল, হয়তো একাই বত্রিশটা গোল ফেরত দিত, আমি আটকাতে পারতুম না–বেদম হয়ে গেছি তখন। কিন্তু রেফারি তক্ষুনি ফাইন্যাল হুইসেল বাজিয়ে দিলেন। দিয়ে বললেন, ‘খেলা ফিনিশ!’ তারপর আমাকে বললেন, এখন যাও, কই মাছ ধরো গে, তাল কুড়োও গে। কিন্তু তখন কি আর মাছ, তাল কিছু আছে? খেলা ফিনিশের সঙ্গে তাও ফিনিশ।’
টেনিদা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তখন প্রাণের আনন্দে মাছ ধরে আর তাল কুড়িয়ে বিচালিগ্রাম চিল্লোতে লাগল, থ্রি চিয়ার্স ফর বিচালিগ্রাম! আর ঘুঁটেপাড়া চেঁচাতে লাগল, থ্রি টিয়ার্স ফর ঘুঁটেপাড়া।
টিয়ার্স? মানে চোখের জল? ক্যাবলা আবার বিস্মিত হলো।
হ্যাঁ, টিয়ার্স। পালটা জবাব দিতে হবে না? সে যাক। কিন্তু একটা ম্যাচে একাই বত্রিশটা গোল দিলুম, পেলে-ইউসেবিও-রিভেরা-চার্লটন সব কাত করে দিলুম। কিন্তু একটা কই মাছ, একটা তালও পেলুম না–এ দুঃখ মরলেও আমার যাবে না রে!
(সংক্ষেপিত



পাঠকের মন্তব্য