বাংলাভাষী ফেসবুক নগরীর সঙ্গে ইটালির নেপলস নগরীর ভীষণ মিল। নেপলস প্রসিদ্ধ এর ঝগড়াঝাটির জন্য। এ নিয়ে গ্রন্থও রয়েছে, পিটার রোবের স্ট্রিট ফাইট ইন নেপলস। আমি নিজেও নেপলস স্টেশনে নেমে নগরে প্রবেশ করতেই দেখলাম এক নারী ঝগড়া করছেন এক তরুণের সঙ্গে। উভয়পক্ষে লোক জমে গেছে। পুলিশের গাড়ি এসে পৌঁছে দেখে; ঐ নারীর তরুণ পুত্র ও ঝগড়ারত তরুণ একে অপরের সঙ্গে ঘুষাঘুষি করে নাক ফাটিয়ে দিয়েছে; দুজনেরই নাক থেকে রক্ত ঝরছে। পুলিশ এসে মারামারি ও ঝগড়া থামিয়ে চলে যায়।
বাংলাভাষী ফেসবুকে প্রবেশ করলে এমন ঝগড়া ও ঘুষি দিয়ে নাক ফাটিয়ে দেবার গরম ইচ্ছা চোখে পড়ে। প্রতিদিনই কিছু না কিছু ঝগড়া করে জীবন অতিবাহিত হয়। ফেসবুকের মন্তব্য ঘরটিকে পাঞ্চিং ব্যাগ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
পুরো বছরের মধ্যে জানুয়ারি মাসটি মোটামুটি শান্তির। তবে আওয়ামী লীগ ঘটা করে ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস পালন করতে গেলে; তা নিয়ে খুটখাট লেগে যায়। দিবস পালন শুধু দিবস পালনে সীমাবদ্ধ থাকলে তেমন অসুবিধা হবার কথা নয়। দিবস পালন করতে গিয়ে সহমত ভাই, শিবব্রত দাদা, ললিতাদি, আনারকলি আপা বঙ্গবন্ধু পূজার ছলে দেশের মালিকানা দাবি করে। তখন প্রতিপক্ষের শরিয়ত, রহমত, রাবেয়া, আলিয়া বঙ্গবন্ধুকে শেখ মুজিব ডেকে ৭২-৭৫ ‘ফ্যাসিস্ট’ শাসনের কথা নিয়ে আসে। তখন সে ঝগড়াটি খণ্ড খণ্ড প্রলয় হয়ে ফেসবুকের গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
ফেব্রুয়ারি মাস ভাষা আন্দোলনের মাস। সুতরাং এ মাসে ভাষাপ্রেমীরা অত্যন্ত আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। বিশেষ করে যাদের নিজের ছেলেমেয়ে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে; তাদের বাংলা ভাষার জন্য কান্না রাজস্থানের রুদালির পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এসময় বইমেলায় বঙ্গাব্দ ভব টাইপের লোকেরা সিনক্রিয়েট করার জন্য ঘুরে। ফলে বইমেলা থেকে ঝগড়া ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। শিবব্রত তার কোন সুষুপ্ত সুহৃদকে দিয়ে ইসলামকে গালি দিয়ে বই লিখে; শরিয়ত সেই বই পুড়াতে চলে যায়। এই ঝগড়ার ফলে কিছু লোক অন্যদেশে এসাইলাম পেয়ে যায়। তারপর সেখানে পার্কে বিয়ারের বোতল হাতে নিয়ে তারা উপহাস করে, পানি লাগবে পানি। মাঝখান থেকে বাক স্বাধীনতা নিয়ে দিস্তা দিস্তা লেখা লিখে ফেলেন জাতির বিবেকেরা। সেগুলো ছেপে প্রথম আলো গালি খায় পাড়ায় পাড়ায়। কে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেলো, তা নিয়ে একটা রুটিন ঝগড়ার ব্যবস্থা আছে। কখনো লীগের দোসর, কখনো জামায়াতের দোসর বলে দাগিয়ে দিলে পুরস্কার প্রাপ্তের দফার রফা ফিশরোল হয়ে যায়। ফেসবুক গ্রামের প্রগতিশীল বনাম ধর্মশীলের কালচারাল ওয়ারের শুভ সূচনা হয় ফেব্রুয়ারি মাসে।
মার্চ মাস স্বাধীনতার মাস। ফলে আওয়ামী লীগ ও বামপন্থীরা এসময় মুক্তিযোদ্ধা টু পয়েন্ট ও হয়ে যায়; আর সারা দেশের মানুষ রাজাকার হয়ে যায়। একাত্তরের নয় মাস যারা ঢাকা শহরে আরামে বসে ছিল; তাদের ছেলেমেয়েরা গ্রাম গ্রামান্তরে যারা পাকিস্তানি মিলিটারির তাড়া খেয়ে ফিরেছে তাদের ছেলেমেয়েকে রাজাকার হিসেবে দাগিয়ে দেয়। ঢাকা শহরে বসবাস করে শহীদ হয়েছেন যারা; তাদের ছেলেমেয়েদের ৩২টা টিভি চ্যানেলে ইন্টারভিউ নেয়া হয়। আর সারাদেশে যারা শহীদ হয়েছেন; তাদের সন্তানেরা থেকে যান বিস্মৃতির অতল গহবরে। ঢাকা শহরের সেলিব্রেটি শহীদ পুত্র কন্যাদের নিয়ে অনুষ্ঠান আয়োজন করতে করতে কিছু লোক শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ছবি দেখে; ওরকম কস্টিউম আর চশমা পরে; মুক্তিযুদ্ধের চেতনার খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতা হয়ে পড়ে। তখন সমাজের সবাইকে তার পেছনে লাইন দিতে হয়; চেতনার সনদ পাবার জন্য। চেতনার সনদ ম্যানেজ হয়ে গেলে তখন শিবব্রত দাদার দায়িত্ব হয়; তাদের টিপে টুপে দেখে প্রগতিশীলতার পৈতে পরিয়ে দেয়া। এইসময় জামায়াতের লোকেদের মাঝে অস্বীকার প্রবণতা পেয়ে বসে। তারা একাত্তরের হত্যাযজ্ঞকে ডিনাই করে চেতনার দোকানে দোলা দেয়। এরপর যে ঝগড়া হয় সেখানে মোদিবীজ বনাম পাকিবীজ খিস্তিখেউড়ে ফেসবুক মৌ মৌ করে।
এপ্রিল মাস বৈশাখ আগমনের মাস। ফলে মাসের শুরু থেকেই কালচারাল ওয়ারের শুরু। বৈশাখ আবহমান কাল ধরে চলে আসা হালখাতা, মেলার মাধ্যমে উদযাপন করা হবে; নাকি চারুকলা ও ছায়ানটের নির্দেশিত রিচুয়ালের মাধ্যমে পালিত হবে; এই নিয়ে আবার দিস্তার পর দিস্তা লেখা চলতে থাকে। সে লেখা ছেপে ফেসবুকের নানা মহল্লায় গালি খায় প্রথম আলো। এসময় শিবব্রত বৈশাখ উদযাপনের ঠাকুদ্দা হিসেবে শশাংককে নিয়ে আসে। অন্যদিকে শরিয়ত বৈশাখ প্রচলনের দাদা সাহেব হিসেবে নিয়ে আসে আকবরকে। শশাংক ও আকবরকে গালি দিয়ে বাপের নাম ভুলিয়ে দিলে ভীষণ তিক্ততায় শেষ হয় এপ্রিল মাস।
মে ও জুন মাসে দুদণ্ড শান্তির প্রত্যাশা থাকে। কিন্তু কখন শরিয়ত গিয়ে ললিতাকে জিজ্ঞেস করবে, তোমার ওড়না কোথায়? কিংবা শিবব্রত গিয়ে আলিয়াকে জিজ্ঞেস করবে, তুমি হিজাব পরেছ কেন! তার তো কোনো ঠিক নেই। ফলে বাংলাভাষী ফেসবুকটা কালচারাল ওয়ারের মাইন পাতা ভূমির মত। কখন কোন মাইন ফেটে যায় তার তো কোনো ঠিক নাই।
জুলাই মাস এসে পড়লে চব্বিশের জুলাই মাসে আরামে বাসায় বসে ছিলেন যারা; শিশু-কিশোর-তরুণের মৃত্যুতে যাদের মনে কোন আলোড়ন ছিল না; তারা জুলাই আহতদের হুইল চেয়ারে করে নিয়ে এসে জুলাই কান্দন কেঁদে জুলাই স্পিরিটের মালিক হয়ে পড়েন। তখন শুধু তারা ছাড়া বাকি সবাই ফ্যাসিস্টের দোসর হয়ে যায়। পলাতক আওয়ামী লীগ এগিয়ে আসে ডিনাইয়াল নিয়ে। বরং হাসিনার দখলদার বাহিনীর সদস্যদের মৃত্যু নিয়ে হাহাকার করে। আর জাতির বিবেকেরা জুলাই তাদের কিভাবে হতাশ করেছে; তা নিয়ে দিস্তা দিস্তা লেখা লেখে। প্রথম আলো সেগুলো ছেপে নানা মহল্লায় গালি খায়। শিবব্রত দাদা দেশটা ইরান হয়ে গেলো বলে ময়ূখরঞ্জনের সুরে নাচে। ফলে কালচারাল ওয়ারে ফেটে পড়ে কথিত প্রগতিশীল ও ধর্মশীলেরা।
অগাস্ট মাসে; ৫ অগাস্টে হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি, ১৫ অগাস্টে বঙ্গবন্ধু হত্যা, ১৪ অগাস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস, ১৫ অগাস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবস, ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলা দিবস। ফলে ঝগড়া ঝাটির ক্লাইমেক্সের মাস এটি। এই মাসের পরতে পরতে ঘুষি মেরে নাক ফাটিয়ে দেবার সুযোগ।
সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাস দুটো অপেক্ষাকৃত শান্তিময়। তবে মনে রাখতে হবে, রোজার মাস পড়ে গেলে রেষ্টুরেন্ট বন্ধ কেন? কোরবানির ইদ পড়ে গেলে, আমার কুরবানি দেখলে গা ঘিন ঘিন করে; আমি ভেজিটেরিয়ান বলে আঁতকে ওঠে সারাবছর বার বি কিউ করা ললিতাদি ও আনারকলি আপা। কেন মাংস খাওয়া শরীরের জন্য খারাপ এ বিষয়ে ডাক্তারি উপদেশ ছেপে আবার গালি খায় প্রথম আলো। অক্টোবরে দুর্গা পূজা এসে গেলে শরিয়তের প্রতিমা ভাঙ্গা ও শিবব্রতের কাউকে দিয়ে প্রতিমা ভেঙ্গে শরিয়তের ওপর দোষ দেবার ঝগড়াঝাটি চলতে থাকে। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে।
নভেম্বরের ৭ তারিখ বিএনপি ও আওয়ামী লীগের জন্য পৃথক অর্থ বহন করে। সুতরাং একটা ফেসবুক বচসা সেদিন ঘটবেই। বারো মাসে তেরো দিবসের এই দেশে আসলে এমন একটা মাস নেই যখন দুদণ্ড জিরিয়ে নেবেন। এর উপর রয়েছে তৌহিদি জনতা। তারা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির চাঁদাবাজদের মতো পেশীশক্তির ভীতি সৃষ্টি করে চাঁদাবাজি করার সামর্থ্য অর্জনের লক্ষ্যে ইসলাম অবমাননার ছুঁতো ধরে সফট টার্গেট হিসেবে বাউল ও মাজারগুলোকে খুঁজে পেয়েছে। আর সেটাকে কেন্দ্র করে ইসলাম ধর্মকে গালাগালের সুযোগই বা কেন হাতছাড়া করবে জোড়াসাঁকো জনতা।
ডিসেম্বর বিজয়ের মাস। ফলে পরাজিত আওয়ামী লীগের বড় গলা করার অবারিত সুযোগ। বিজয়ের মাস আবার জামায়াতের ডিনাইয়ালের মাস। আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে চেতনার দোকান চালাতে বামপন্থী, বিএনপি ও পাকাপোক্ত প্রগতিশীল-এর কান্দন আর ধর্মশীলের অস্বীকারের চিৎকার ভীষণ দোলা দেয় টিভি টকশোতে। ফেসবুকে আওয়ামী লীগ আবার এসে বাম ও প্রগতিশীলকে মৃদু বকা দেয়, করছিলেন তো লালবদরদের সমর্থন; এখন এলা বুঝেন!
আর একটা জিনিস ভুলে গেলে চলবে না; দেশটাকে ভারতের হাতে তুলে দেয়া বনাম এমেরিকার হাতে তুলে দেয়া; দেশটা পাকিস্তান হয়ে গেলো বলে ঝগড়া বাধানোর লোকের অভাব নাই। প্রত্যেক মাসের ১৫ তারিখের পর বেতনের টাকা নিঃশেষ হবার জোগাড় হলে; ব্রেক আপ ও দাম্পত্য কলহ বাড়লে, ছেলেমেয়ে পরীক্ষার ফল খারাপ করলে, ডায়াবেটিসের প্রকোপ বা প্রেশার বেড়ে গেলে; তখন ব্যক্তিগত হতাশাকে জাতীয়তাবাদে রুপান্তর করে ফেসবুকে শিং ঘষে ঝগড়ার যে অনন্ত উপাখ্যান; এটা লিখে শেষ যাবে না।



পাঠকের মন্তব্য