জুলাইকে চুপ করিয়ে দাও

৪০৭ পঠিত ... ১৮:১৬, মে ২১, ২০২৫

17

জুলাই বিপ্লবের পর প্রচলিত ইনফ্লুয়েন্সাররা আগামীতে পদ-পদবি-পদকের স্বপ্নে যে যার দলের ভেলায় গিয়ে চড়েছেন। জুলাই বিপ্লব নিয়ে কথা বলবে এমন লোকের সংখ্যা হাতে গোণা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল প্রথম দিকে কথা বলতেন, যেহেতু উনি কথা বলতে জানেন। অমনি কালচারাল উইংটি তাকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলতে শুরু করে। কালচারাল উইংটি ধারণা করেছিল, আওয়ামীলীগের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে তারা মাঝে মাঝে একে মৃদু বকে দেবে। সেই বকুনিতে অল্প কাজ হলে ‘হ্যাশট্যাগ ধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রী’ লিখে গলে পড়বে। আর ঘরে বাইরে উপন্যাসের বিমলারা তাকে সন্দ্বীপের মতো বিপ্লবী দেশপ্রেমিক ভেবে প্রগলভ হবে। ঠিক এইরকম একটি স্ট্যাটাসকে জুলাই বিপ্লবের মাঝ দিয়ে ভেঙে পড়লে ‘নতুন’কে ভয় পেতে শুরু করে কালচারাল উইং।

আসিফ নজরুল তাদের প্রথম টার্গেট ছিলেন। এরপর মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী উপদেষ্টা হলে; তাকে চুপ করিয়ে দেবার খেলা শুরু হয়। ‘ঢাকা-টু-কলকাতা সিটিং সার্ভিস’-এর কালচারাল মামা ও খালারা সংস্কৃতি বলে যে বেঙ্গল রেনেসাঁর মূর্তি দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন; ফারুকী তাতে দড়ি ধরে মারেন টান। অমনি বেঙ্গল রেনেসাঁর শিষ্যেরা হতচকিত হয়ে ফারুকীকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলতে শুরু করে। প্রণয় নিকেতনের মাসোহরা পাওয়া সাংবাদিকেরা গিয়ে প্রশ্ন করার ছলে শেখ হাসিনার মানবতাবিরোধী অপরাধ হালকা করার কাজে লেগে পড়ে। গ্রাজুয়েশন করে নক্সী পাঞ্জাবি পরে হারমোনিয়াম বাজিয়ে একটু গান গাইতে শিখলে; দেশের সংস্কৃতির দণ্ড মুণ্ডের কর্তা হয়ে পড়ে এই কালচারাল উইং। নিজেদের গানে নিজেরাই হাততালি দিয়ে, নিজেদের দুর্বল মুভি নিয়ে নিজেরাই আহাউহু করে; কলকাতা থেকে শিল্প হচ্ছে কী হচ্ছে না সেই সনদ নিয়ে কালচারাল উইং বিরাট এক একজন পালের গোদা হয়ে পড়ে। তারা মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীকে শেখাতে চেষ্টা করে সংস্কৃতি কেমন হওয়া উচিত। এইভাবে ফারুকীকে চুপ করিয়ে দিয়ে তারা লক্ষ্য করে এবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমকে চুপ করাতে হবে।

কারণ উনি এই বেঙ্গল রেনেসাঁর কালচারাল উইংটির অযৌক্তিক কথা বার্তার উত্তর দেন। উনি একুশে গ্রন্থমেলায় শেখ হাসিনা আস্তাকুঁড়ে টিস্যু ফেলে ‘ঢাকা-টু-কলকাতা’ কালচারাল ব্যান্ডের মন ভেঙে দিয়েছেন। ৩০-৩১ জুলাইয়ে হাসিনার পতন অবশ্যম্ভাবী ভেবে যে আগস্ট ডিভিশন জুলাই বিপ্লবী সেজে পথে নেমেছিল; তাদেরও পূর্ণিমা রাতে হাসিনা হারানোর বেদনা টনটন করে বুকের বাম পাজরে। সুতরাং শফিকুল আলমের ওপর গিয়ে সব রাগ পড়ে। ঊনিশ শতকের জমিদারের ছেলে-মেয়ের স্টাইলে স্বদেশ চিন্তার কঁকানি করে যারা একমাত্র দেশপ্রেমিক হিসেবে আউটডেটেড কথা-বার্তা বলে, তাদের অযৌক্তিক প্রস্তাবনার সমালোচনা করেন শফিকুল আলম। সুতরাং তাকে চুপ করাতে ডাক পড়ে পোড় খাওয়া বুদ্ধিজীবীদের, যারা বিশ্বাস করেন, খান বিশেক বইপুস্তক পড়ে তারা এত সিজনড টিম্বার হয়ে গেছেন যে, দেশ সম্পর্কে কেবল অভিমত রাখবেন তারা। শফিকুল আলম কেন কথা বলবেন!

গত সাড়ে নয় মাস ধরে নাহিদ, মাহফুজ, আসিফ, হাসনাত, সারজিসকে চুপ করিয়ে দেবার আলকাপ নৃত্য কতনা রঙ্গে মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়া মাতিয়েছে। আসল ব্যাপার হচ্ছে, জুলাই বিষয়ক কথাবার্তা বন্ধ করে বয়ানগুলোকে বিংশ শতকের আওয়ামীলীগ ও বেঙ্গল রেনেসাঁর ঠিক করে দেওয়া সিলেবাসে নিয়ে আসা।

বিএনপি অত্যন্ত সাবধানী রাজনৈতিক দল। ভারতের রুদ্ররোষে পড়ে ক্ষমতা কেন্দ্র থেকে দেড় দশক দূরে থেকে; ভারত রুষ্ট হয় এমন একটি শব্দও খরচ করবে না তারা। আর জামায়াত ভারতের বিজেপি দ্বারা অনুপ্রাণিত। ভারতে হিন্দুত্ববাদীরা ক্ষমতায় যেতে পারলে বাংলাদেশে ইসলামপন্থী কেন পারবে না! এই কষ্টকল্পনায় সে ভারতের মিডিয়ার বাংলাদেশ বিরোধী অপপ্রচারকে এক এক করে বাস্তব ভিত্তি দিতে মরিয়া। দুটি আসন পাবে কিনা ঠিক নাই; কিন্তু তবু যতক্ষণ জামায়াতকে আলোচনায় রাখা যায়, ততক্ষণই আওয়ামীলীগ কঁকিয়ে উঠতে পারে। ভারতের মোদি প্রগতিশীল অ্যাক্টিভিজম প্রয়োজন হয় কথিত জামায়াত ঠেকাতে।

জামায়াত এসে একাত্তর ডিনাইয়ালের চুইংগাম চেবালে আওয়ামীলীগের তখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার চুইংগাম চেবাতে সুবিধা হয়। এই পদ্ধতিতে ৫৪ বছর ধরে দেশ লুণ্ঠন করেছে আওয়ামীলীগ।

তাই তো জামায়াত কোনো চুইংগাম না চেবালেও ‘মুজিব চলচ্চিত্রের অভিনেত্রী’ গ্রেফতার হওয়াকে কেন্দ্র করে সহমত ভাই, শিবব্রতদা, ললিতাদি, আনারকলি আপা এসে বলে, মুজিব চলচ্চিত্রে যারা খান সেনা ও মুজিব হত্যাকারী চরিত্রে অভিনয় করেছে; তাদেরকে পুরস্কৃত করুন।

খারাপ ছাত্রের চিকন বুদ্ধি থাকলে যা হয়; আফসোস লীগ বোঝাতে চায়, যারা কারাগারে আছে, তারা সব মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি পবিত্র মানুষ; আর যারা মুক্ত তারা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি। লক্ষ্য করুন, সেই বাইনারি যা দিয়ে সে গুম, খুন, ক্রসফায়ার, কারাগারে নির্যাতন করেও তার শখ মেটেনি। বহুব্যবহারে জীর্ণ বস্ত্রখণ্ডের বয়ানটি কোনোরকম প্রাসঙ্গিকতা কিংবা ইসলামপন্থীদের উস্কানি ছাড়াই চেবাবে তারা। বাংলাদেশ আয়তনে ক্ষুদ্র দেশ, খোঁজ নিলে দেখা যাবে এই আফসোস লীগের কারও পরিবারে মুক্তিযুদ্ধে কোনো ত্যাগ নেই। এরা শাহবাগ ডিভিশনের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা; যা দিয়ে তারা কাস্টের উত্থান ঘটিয়ে রুলিং এলিট সাজতে চেয়েছিল।

কালচারাল উইংটি খুব ভালোভাবেই জানে, বিএনপি ও জামায়াত জুলাই বিপ্লবের বয়ান সংরক্ষণ করবে না। বামেরা তো ড. ইউনূস প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণের আগের দিন থেকেই তাকে ফ্যাসিস্ট শাসক ডেকে হাসিনার সাড়ে পনেরো বছরের নিকৃষ্ট ফ্যাসিজমের সঙ্গে ইকুইলিব্রিয়াম তৈরিতে ব্যস্ত।

কাজেই, আসিফ নজরুল, মোস্তফা সরওয়ার ফারুকি, শফিকুল আলম, মাহফুজ আলম, আসিফ, হাসনাত, সারজিস আর নাহিদকে চুপ করিয়ে দেওয়া গেলে; আবার গোল হয়ে, সাদা সাদা কালা কালা গান গাওয়া যাবে। বেঙ্গল রেনেসাঁর ব্রাহ্মণ সেজে সমাজে আইকন হয়ে ঘোরা যাবে। জুলাই বিপ্লবকে ডানপন্থী তকমা দিয়ে বই লিখে প্রথমা প্রকাশনী থেকে প্রকাশ করা যাবে। তারপর আবার তৃতীয় মাত্রায় বসে বিপ্লবীর অভিনয় করে জাতীয়তাবাদ বিরোধী রবীন্দ্রনাথকে জাতীয়তাবাদী মূর্তি হিসেবে উপস্থাপন করা যাবে।

কালচারাল উইং-এর অস্বস্তি দাড়ি টুপিওয়ালা লোকগুলো জনপদে ঘুরলে। ওরা মসজিদ-মাদ্রাসা ও কারাগারে থাকবে, ভারতীয় ধণুক ব্যবসার ‘জঙ্গী বিরোধী অভিযান’ নাটকের ভয়ে পলায়নে থাকবে; ওদেরকে কেন এত চোখে পড়ছে! সংস্কৃতি খালা আকলিমা নদী ঢং করে বলে, এই পথিকৃত বাতেন, দাড়ি টুপিটাকে সরাও; আমার ভয় লাগছে।

নক্সী পাঞ্জাবি ও জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির কস্টিউম পরে কালচারাল উইং অষ্টপদের ভর্তা খেয়ে হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্বের ফ্যাশান প্যারেড করে বেড়াবে। সংস্কৃতি মামা খালার আধো আধো বাংলা বলা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া ছেলেমেয়েরা সেখানে এসে ইংরেজি বলে তাক লাগিয়ে দেবে। দর্শকেরা মুগ্ধতায় বলবে, উনারা অন্য গ্রহের লোক। ঐ শেফালি চল তোরে ছায়ানটে ভর্তি কইরা দিই; ও রুপালি তোরে ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করি।

পৃথিবীর অন্যান্য সমাজের মতো অন্যতম হয়ে বাঁচার মুরোদ এই নতুন এফলুয়েন্টদের নেই, নিও নলেজ আঁতেলদের নাই। তারা আইকন না হলে ভাল্লাগে না। ভূষি মালকে আইকন বানানোর কারখানা প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার আর ‘আমরা সংস্কৃতি করি’ সংস্কৃতি আন্টিরা। তাই জুলাই বিপ্লবের পরের সাম্যচিন্তা ও মানুষের মর্যাদার সমাজ বিনির্মাণ প্রক্রিয়ার প্রতি তারা বীতশ্রদ্ধ। নব্বুই দশকে যারা টাকা ধার নিয়ে ডিম কিনে বাড়ি ফিরত; ২০০৯ সালে তারা হাসিনার চেরাগ জ্বালিয়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদার হয়েছিল; সেই জমিদারি হারানোর কঁকনি আর জুলাই কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেবার ফ্যান্টাসি এইসব আশা ও আশাভঙ্গের দিনগুলি।

 

৪০৭ পঠিত ... ১৮:১৬, মে ২১, ২০২৫

আরও

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি


Top