ভারতকে পাড়ার ছবি আপার মতো অসম্ভব কুইন বী মনে হয়। এটা ঠিক; এক সময় ছবি আপার প্রেমে পড়েনি এমন লোক এ তল্লাটে খুঁজে পাওয়া যাবে না। একটা লালডুরে শাড়ি পরে চোখে কাজল এঁকে ছবি আপা যখন পাড়ার মোড়ে রিকশা খুঁজত; কমপক্ষে ছয়টি রিকশা হাজির হতো তার সেবায়। তারপর তিনটি যুবক সাইকেলে চড়ে ছবি আপার বিনুনি দেখতে দেখতে গার্ড অফ অনার দিয়ে নিয়ে যেত তার গন্তব্যে।
পাড়ার রবীন্দ্র ও নজরুল জয়ন্তীতে সব শেষে থাকত ছবি আপার গান; সেই অপেক্ষায় এমনকি ডায়াবেটিক পেশেন্টরাও কাহিল হয়ে অপেক্ষা করত। তারপর কুইন ছবি যখন মঞ্চের দিকে কোমর দুলিয়ে হেঁটে যেত, প্রেমময় যুবকদের চোখ সরল দোলকের মতো দুলত।
এ পাড়ায় ছবি আপার কোনো বান্ধবি ছিল না। তার বাড়ির চারপাশের ছয়টি গৃহের নাইয়ার আপা, রুকাইয়া আপা, চন্দ্রিকা দিদি, ফেরদৌসি আপা, থাপা দিদি, ওয়াংচুক সিস্টার; নেহাত ছবি আপার আশেপাশে ফিল্মের সুচিত্রা সেনের চারপাশে আল্পনা-কল্পনা-রুপালি-শেফালির মতো ঘুরত। ছবি আপা চাইত, সবাই ছবি আপাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হবে; কিন্তু তাদের নিজেদের মধ্যে কোনো বন্ধুত্ব থাকবে না।
ছবি আপার এই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করার রোগের কারণে একে একে নাইয়ার, রুকাইয়া, চন্দ্রিকা, থাপা ও ওয়াংচুক বিগড়ে যায়। তখন ছবি আপা আঁকড়ে ধরে ফেরদৌসিকে। মাথায় তেলপানি বসিয়ে দেওয়া, উকুন তুলে দিতে দিতে নাইয়ার আপার গুষ্টি উদ্ধার, পাড়ার অনুষ্ঠানে গানের আগে ছবি আপার মেকআপ ঠিক করে দেওয়া; সব দায়িত্ব পড়ে যায় ফেরদৌসির কাঁধে।
নাইয়ার, রুকাইয়া, চন্দ্রিকা, থাপা, ওয়াংচুক ওপাড়ার বড় লোক হয়ে ওঠা ইয়েন সিস্টারের সঙ্গে ঘনিষ্ট হলে; ছবি আপা রাগে ফুঁসতে থাকে। ফেরদৌসিকে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কেঁদে বলে, আমার মাথার দিব্যি; তুই ইয়েনের বাড়িতে কক্ষনও যাবি না।
এইভাবে ছবি আপা কঙ্গনার মতো অসম্ভব অবুঝ আর কনট্রোল ফ্রিক হলে বড্ড হাঁপিয়ে ওঠে ফেরদৌসি। কারণ ছবি আপা ফেরদৌসির কললিস্ট চেক করতে চায়; সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখে সে নাইয়ার কিংবা ইয়েনের ছবিতে লাইক দিয়েছে কিনা।
পাড়ার যে যুবকেরা ছবি আপাকে দ্রৌপদী কল্পনা করে কবিতা লিখত; তাদের কাব্য চর্চায় ভাটা পড়তে থাকে; কারণ ছবি আপা আজকাল বড্ড ক্ষ্যাপাটে হয়ে থাকে। তার সেই লাস্য হারিয়ে গিয়ে কেমন যেন কুটিলতার জ্যামিতিক রেখা পড়েছে তার মুখমণ্ডলে। ফলে আজকাল আর পাড়ার মোড়ে ছয়টি রিকশা এসে দাঁড়ায় না। কারও বিয়ে কিংবা জন্মদিনের অনুষ্ঠানে সবাই ছবি আপাকে এড়িয়ে চলতে চায়। ফেরদৌসির কাছেও হাসফাঁস লাগে এই ছবি আপার টক্সিক বিহেভিয়ার। কারণ ছবি আপার গল্পের জগত মানেই নাইয়ার ও ইয়েনের গুষ্টি উদ্ধার। রুকাইয়ার সঙ্গে অকারণে রেগে রেগে কথা বলা। চন্দ্রিকা, থাপা ও ওয়াংচুক সিস্টারের সঙ্গে অযথা অহংকার দেখানো।
ফেরদৌসি সিদ্ধান্ত নেয়, অনেক হয়েছে আর নয়। ফেরদৌসির এই এড়িয়ে চলাতে মাথায় বাজ ভেঙে পড়ে ছবি আপার। সে ফেসবুকে ফেরদৌসিকে নিয়ে নানা আজে বাজে কথা বলতে থাকে। কেউ তাতে লাইক না দিয়ে হাহা ইমো দিয়ে যায়। ইয়েনের বাসার হাইটিতে দাওয়াত পেয়ে ফেরদৌসি সেখানে গেলে ছবি আপা রেগে গিয়ে ফেরদৌসির গৃহের কর্মীকে ভাগিয়ে এনে কাজ দেয়। আর তাকে উদ্ধৃত করে ফেসবুকে লেখে, বুঝি তো, ইয়েনের কাছে টাকা ধার চাইতে গেছে। ছবি আপার গানের অনুষ্ঠান প্রায় দর্শকশূন্য হতে থাকে। ফেরদৌসি সেখানে না আসায় ছবি আপা ফেসবুকে লিখে দেয়, ইসলামি ছাত্রী সংস্থায় যোগ দিয়েছে ফেরদৌসি। সেখানেও হাহা দিয়ে যায় পাড়ার অন্য আপারা।
ছবি আপা তখন একা একা পাড়াময় ঘুরতে থাকে; অপ্রয়োজনে হাত নাড়ে, মিষ্টি হাসার চেষ্টা করে; কিন্তু কারও কাছে কোনো সাড়া পায় না। হঠাৎ ওয়াংচুক সিস্টারের সঙ্গে দেখা হলে ছবি আপা তাকে কটাক্ষ করে, ইয়েনকে পেয়ে আমাকে ভুলে গেলে যে। ওয়াংচুক হাসি হাসি মুখে বলে, ছবিদি তুমি নিজেকে রাজকন্যা মনে করো; আর আমাদের সবাইকে মনে করো তোমার সেবাসখি। এভাবে তো বন্ধুত্ব হয় না। তুমি নিজের স্বভাবের কারণেই আজ এমন একা হয়ে গেছ।
পাঠকের মন্তব্য