আলো আসবেই গ্রুপের যে শিল্পী জুলাই বিপ্লবের সময় আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীর ওপর গরম পানি ছিটিয়ে দিতে পরামর্শ রেখেছিলেন; তিনি গতকাল খালেদা জিয়া ও তারেকের দীর্ঘ সাতবছর পর দেখা হবার ছবি শেয়ার করে, মা মাগো বলে উঠেছেন। সুতরাং গতকালকের দিনটিকে নতুন যুগের তেলাঞ্জলির সূচনা দিবস হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
গত সাড়ে পনেরো বছরে খালেদা জিয়ার যে নিরাপোষ জীবন, গৃহ থেকে উচ্ছেদ, জেল-জুলুম, শেখ হাসিনা ও তার পোষা শাখামৃগদের অশালীন অপমান সহ্য করতে হয়েছে; এর বিপরীতে তার যে শালীন প্রতিক্রিয়া; তা তাকে শ্রদ্ধার আসনে আসীন করে। তারেক রহমানের লন্ডনের নির্বাসিত জীবনের যে বাক সক্রিয়তা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে বিবৃতি; তা পলিটিক্যালি কারেক্ট ও উদার গণতন্ত্রী রাজনৈতিক নেতা হিসেবে নিজেকে তৈরি করার প্রমাণ তুলে ধরে। ফলে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এরকম শিষ্ট আচরণ ও মনোভঙ্গিতে খুশি।
কিন্তু কেউ মাথায় জাতীয় পতাকা বেঁধে দেশপ্রেমের কথা বললে, মাথায় টুপি দিয়ে ধর্মপ্রেমের কথা বললে, আর নেতা বা নেত্রীর ছবি দিয়ে তেলাঞ্জলি দিলে; সে নিশ্চিতভাবেই দেশডাকাতির প্রস্তুতি নিচ্ছে এটা বোঝা যায়। এ আমাদের ৫৪ বছরের বাংলাদেশের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। তাই যারা খালেদা ও তারেকের ছবি দিয়ে আলুথালু হলেন; তাদের ব্যাপারে অজানা আশঙ্কা তৈরি হয়। কারণ আমরা দেখেছি শেখ মুজিব ও হাসিনার ছবি ফেসবুকে দিয়ে আলুথালু হয়েছিল যারা; তারা দলবদ্ধভাবে দেশ-ডাকাতি করে দেশের অর্থনীতিকে আলুথালু করে রেখে গিয়েছে।
খালেদা জিয়ার সঙ্গে তারেকের দেখা হবার দৃশ্যটি মা ও সন্তানের মিলন দৃশ্য। নিঃসন্দেহে পৃথিবীর সুন্দরতম দৃশ্য। কিন্তু জুলাই বিপ্লবে যে সন্তানেরা নিহত হলেন; তাদের মায়ের জীবনে সন্তান বিরহ আমাদের স্মৃতিতে তাজা। শেখ হাসিনার ফ্যাসিজমে যে সন্তানেরা নির্বাসনে বাধ্য হয়ে; তাদের মায়ের জীবনে সন্তানের বিরহ ট্র্যাজিক এক বাস্তবতা। সেখানে এই একটি ছবির মধ্যে পৃথিবীর সর্বোচ্চ সুখ খুঁজে পাওয়া, সহজাত কোনো আবেগ নয়; এতে দেশ ডাকাতির প্রস্তুতি আছে।
খালেদা ও তারেকের ছবি শেয়ারের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি ক্ষমতার চারা রোপণ করে। পাবলিক পারসেপশন তৈরি হয়, এই লোক রহমত ভাই হয়ে উঠবে অথবা আয়েশা আপা হয়ে উঠবে। এই ছবি আলো আসবেই গ্রুপের শিল্পীর মতো দল ও জার্সি বদলেরও ইঙ্গিত। বিএনপির যেসব নেতা-কর্মী ১৮ বছর ধরে আন্দোলন, সংগ্রাম, ত্যাগ করেছে; তারা দেখবেন এখন পিছিয়ে পড়বেন। কারণ মুক্তিকামী ডিএনএ ও মুক্তিউদযাপন ডিএনএ প্রথমেই পৃথক। বিএনপির নেতা-কর্মীরা এ মুহূর্ত থেকে কাজল রেখা গল্পের কাজল রেখা হতে শুরু করল। কাঁকন দাসীরা এখন কাস্তে হাতে ধান কাটতে নেমে পড়বে; জিয়া-খালেদা ও তারেকের ফটো আর স্তুতিতে ভরিয়ে ফেলবে ফেসবুক টাইমলাইন।
আমাদের দেশের এই কোলাবরেটর ডিএনএ জানে কী করে আস্তে আস্তে ক্ষমতা-কাঠামোতে ভিড়ে যেতে হয়। এই কোলাবরেটরেরা সেই বৃটিশ আমল থেকে পাকিস্তান আমল হয়ে বাংলাদেশ আমল পর্যন্ত ঘুরে ফিরে ঠিকই দেশলুণ্ঠনের গ্যাং-গুলো তৈরি করতে পারে।
আওয়ামীলীগের ফ্যাসিজমকালে দেখবেন বিএনপি ও জামায়াতের অনেক নেতা ও কর্মী দিব্যি ব্যবসা বানিজ্য করেছে। আওয়ামীলীগ নেতা প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মন হলে; তার ঠিকাদারির কাজ বিএনপির নেতা করেছে আর ক্যাশিয়ারের কাজ করেছে জামায়াতের লোক। প্রকৃষ্ট কোলাবরেটরের ডিএনএ এই কলাকৈবল্যগুলো অনেক ভালো জানে। যারা এসব ভেতরের খেলাগুলো জানে না; তারাই সব বাইরে বাইরে এটা-ওটা-সেটা নিয়ে কোঁদাকুঁদি করে ক্যালরি ক্ষয় করে।
চোখের সামনে ছাত্র-জনতাকে হত্যা করতে দেখার পরেও দেখবেন, গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের নেতা আওয়ামীলীগের প্রতি মায়ায় গদগদ হয়েছেন। একে সুবিশাল মানবতাবাদ ভাবা ভুল। ভারতের ক্ষমতা-কাঠামো বাংলাদেশ নীতির সবগুলো ডিম আওয়ামীলীগের বাস্কেটে রেখেছেন বলে মনে হলেও; কিছু ডিম বিএনপি ও জামায়াতের বাস্কেটেও রেখেছেন। মালদ্বীপে প্রেসিডেন্ট মইজুর দলের অনেক হর্স ট্রেডিং হয়েছে। অনেক নেতাকে কিনে নিয়েছিল ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা। কোলাবরেটর ডিএনএ গলায় টু লেট বা ফর সেল বোর্ড ঝুলিয়ে প্রস্তুত থাকে ভাড়ায় বা বিক্রিতে মুন্ডু সঁপে দেবার জন্য।
আলবদর, BALবদর ও বজরং বদর এখন স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্টের মাঝ দিয়ে যাচ্ছে। ৫ আগস্টের পর হাসিনার ছবি সরিয়ে জুলাই বিপ্লবের ছবি শেয়ার করে লালবদর হয়েছিল যারা; এখন তারা তাদের চূড়ান্ত পজিশনিং-এর দিকে যাচ্ছে। সুতরাং খালেদা ও তারেকের ছবি শেয়ার করলেন যারা; তারা বদরের নিত্যতা সূত্রের লোক। ব্যতিক্রমী মানুষেরা আশা করি নিজেদের এই বদর বিশ্লেষণের বাইরে রাখবেন।
২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ যখন ক্ষমতায় এল; সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নব্বই-এর দশকে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির করা লোকেরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পালোয়ান ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক হিসেবে আবির্ভাব ঘটাল। শাহবাগ আন্দোলনের মাঝ দিয়ে দাড়ি টুপিওয়ালা লোকেদের হঠাৎ লিবেরেল হয়ে ওঠা জিন্স ও টি-শার্ট পরা ছেলেরা সামান্য ভিন্নমত দেখলেই তাকে ‘রাজাকার’ বলে ট্যাগিং করতে শুরু করল। বাংলাদেশ ছোটো দেশ; একটু খোঁজ নিলেই ঠিকুজি বেরিয়ে আসে। মুক্তিযুদ্ধে পরিবারের সামান্যতম ত্যাগ নেই যেসব পরিবারের; তারাই চোরের মায়ের বড় গলা নিয়ে দ্বিতীয় মুক্তিযোদ্ধা সেজে ঘুরতে শুরু করল। আর এই যেমন খুশি তেমনি সাজো ভং ধরে ভাগ্য পরিবর্তন করল। এরপর সেকি আর্ট কালচারের আলোচনা সেসব সহমত ভাই, শিবব্রত দাদা, ললিতা দি, আনারকলি আপার। সাক্ষাৎ একেকজন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদার হয়ে উঠল।
আমরা দেজাভুর মতো দেখলাম, বৃটিশ-পাকিস্তান আমলে কোলাবরেটরেরা কীভাবে জমিদার হয়ে উঠেছিল। কোলাবরেটরের ক্ষমতা কাঠামোর দালালি করার চিরন্তন এই সূত্রের আরেকটি নতুন একটি পর্ব দেখতে পাচ্ছি আমরা। বাংলাদেশে সৎভাবে পরিশ্রম করে বাঁচা যায়। কিন্তু দরিদ্রপল্লীর ছেলে-মেয়েদের মনে যে ডুপ্লেক্স, বড় গাড়ি, বিলাসী জীবনের স্বপ্ন মনের দারিদ্র্যের কারণে স্থায়ী হয়েছে; তাতে ক্ষমতার দালালিকেই সাফল্যের একমাত্র পথ হিসেবে মনে জনসংখ্যার বিপুল একটি অংশ। কাজেই ৫ আগস্টের পরিবর্তনের পর আবার ক্ষমতা কাঠামোকে তেলাঞ্জলি দিয়ে নতুন একদল ধনী হবে বাংলাদেশে।
এই যে ৫ আগস্টে দেশ থেকে ধেড়ে ইঁদুরের মতো পালিয়ে যেতে দেখলাম একদল দুর্নীতিবাজ নতুন জমিদারকে; এই যে ডাণ্ডা বেড়ি পরে আওয়ামী জমিদারেরা আদালত পাড়ায় পচা ডিম খেয়ে ঘুরছে; এসব দেখে এতটুকু ভয় জাগে না ; শিক্ষা হওয়া তো দূরের কথা। কারণ এদেশে আইনের শাসন দেখেনি কেউ। দেশডাকাতি করে শাস্তি পেয়েছে কেউ; এমন একটি দৃষ্টান্তও নেই। স্লামডগবিলিওনিয়ার নিজে জেলে আটকে থাকলেও তার বউ ছেলে মেয়ে পশ্চিমের সেকেন্ড হোমে এফলুয়েন্ট জীবন যাপন করে। আর সুফি কালচারের প্রভাবে ছাইড়া দেওরে বাজান বলে চিহ্নিত খুনি, দুর্নীতিবাজকে বাঁচিয়ে দেবার ভাটিয়ালি কালচার রয়েছে আমাদের সমাজে।
তাই তো ছলে বলে কৌশলে ক্ষমতা-কাঠামোর কোলাবরেটর হয়ে নতুন জমিদার হবার স্বপ্ন; আমাদের সমাজের একমাত্র স্বপ্ন।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন