থাবড়া দ্য স্ল্যাপ: সোশ্যাল মিনিং

৩৪৯ পঠিত ... ১৩:৩১, এপ্রিল ১০, ২০২৩

থাবড়া-দ্য-স্ল্যাপ

২১ শতকের সবচেয়ে আলোচিত থাবড়াটা মারছেন উইল স্মিথ। আর খাইছেন ক্রিস রক। ২০২২ সালের অস্কার অনুষ্ঠানে।

 

পশ্চিমা কালচারে অবশ্য ঘটনাটা বিরল। সাধারণত হলিউডি মুভিতে ক্রুদ্ধ পুরুষেরা একে অপরকে ঘুষি তথা ঠুয়া মারে। উপমহাদেশের নাটক, সিনেমা বা সিরিয়ালে ক্রুদ্ধ লোকেরা থাবড়ায়।     

 

বাপে পোলারে থাবড়ায়, বাপ-মা ছেলে-মেয়েরে থাবড়ায় আর থাবড়ায়ে পরে অনুশোচনায় ভোগে।

শাশুড়ি থাবড়ায় বউরে, স্বামী অধিনস্ত স্ত্রীরে, সৎ পুলিশ অফিসার ঘুষখোর ভিলেনরে থাবড়ায় ইত্যাদি।

সামাজিক সিনেমায় অনেক সময় থাবড়াগ্রহীতা, থাবড়াদাতারেই আবার এক পর্যায়ে থাবড়ায় এবং প্রতিশোধের চক্র পুরা করে।  

 

শাস্তি বা আক্রমণ হিসেবে থাবড়ার প্রতি আমাদের সমাজের গভীর এই ফ্যাসিনেশনের ব্যাখ্যা কী?

 

থাবড়া কী এমন তাৎপর্য বহন করে যা দৈনন্দিন জীবনের প্রেজেন্টেশন হিসেবে নাটক-সিনেমায় এমন অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়া ওঠে? 

 

তার আগে বলে নেই, বিকল্প শব্দগুলার বদলে 'থাবড়া' শব্দটা কেন ব্যবহার করতেছি। থাবড়া কর্মটা প্রকাশ করে এমন কিছু শব্দ, আসেন, ভালো করে দেখি। 

 

(১) থাপ্পড়

(২) চড়

(৩) থাবড়া ও

(৪) চপেটাঘাত —বাংলায় এই ৪টা বেশি শব্দ চালু আছে।

 

১.

দীর্ঘদেহী ও পণ্ডিতিগন্ধী শব্দ বিবেচনায় 'চপেটাঘাত' শুরুতে বাদ দিতেছি।        

 

২.

চড় (বা চড়ের কিউট কাজিন 'চটকানা') শব্দটা ছোট, পাঞ্চি —যা আমার পছন্দ। চটকানার আরেকটা সুন্দর সংস্করণ আছে: বন চটকানা। এইটা এমন চটকানা যা খাইলে কানে তালা লেগে যায়, মাথা চক্কর দিয়া ওঠে, মাথা বন বন করে ঘোরে। তাই নাম বন চটকানা। কথাটায় কল্পনাশক্তির ব্যবহার দেখি। তবে থাপ্পড় শব্দের আৎকা আঘাতের ভাবটা চড় বা চটকানায় যথেষ্ট ফোটে না।  

 

৩.

থাবড়া শব্দে থাপ্পড়ের 'তাৎক্ষণিকতার পাশাপাশি বেশ ভারী, মোটাসোটা, বেশ দশাসই চড়-এর ভাবটাও ফোটে। 

 

এইসব বিবেচনায় এই লেখায় আমি থাবড়া শব্দটা ব্যবহার করতেছি।

 

উপমহাদেশের সমাজে, প্রকারান্তরে ভিজুয়াল মিডিয়ায়— নাটক-সিনেমা-সিরিয়ালে— থাবড়ার এই সর্বব্যাপ্তি বিষয়ে কয়েকটা অনুমান করা সম্ভব। 

 

১মত—

থাবড়া অবমাননার চিহ্ন আইকা দেয় মুখমণ্ডলে। মুখ দেহের সেই অংশ যা আমাদের আইডেন্টিটি প্রকাশ করে। আমাদের মুখই মূলত আমরা। লজ্জায় আমরা মুখ লুকাই। কেলেঙ্কারি বা লজ্জাজনক ঘটনা ঘটলে বলি 'কোন মুখে মানুষের সামনে যাবো?' বা 'মুখ দেখাবো ক্যামনে?'  

 

২য়ত—

থাবড়া হাতরে (অ্যাকশন টুল) তড়িৎগতিতে সংযুক্ত করে মুখের (আইডেন্টিটি) সাথে। থাবড়ার টার্গেট যতটা শরীর তারচেয়ে বেশি আইডেন্টিটি—ব্যক্তির ইমেজ। ফলে কাজটা প্রতীকী: দর্শকদের চোখের সামনে কাউরে ছোট করা।  

 

বাপ সন্তানরে থাপড়ায়, মালিক চাকররে থাপড়ায়। উদ্দেশ্য অনুশাসনের মাধ্যমে স্টেটাস কো' অক্ষুন্ন রাখা,  থাবড়া গ্রহীতারে নিরুৎসাহিত করা যাতে জীবনে তার নির্ধারিত অবস্থানের বাইরে না যায়। 

 

এই কারণেই সম্ভবত উপমহাদেশের ফিল্মে/নাটকে, 'তুই জানিস আমি কে?' বা 'যতবড় মুখ নয় ততবড় কথা!' বলেই মারে এক থাবড়া। কথাগুলা অন্তত থাবড়ার আগে/পরে বলে।   

 

আমি হিন্দি সিনেমা অল্প দেখায় নিশ্চিত জানি না। কিন্তু অনুমান করি, হিন্দি ফিল্মেও থাবড়ার আশেপাশে 'যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা!'/ 'এত বড় স্পর্ধা!' ধরনের ডায়লগ (হিন্দিতে) থাকার কথা। 

 

যথেষ্ট পরিমাণে হিন্দি মুভি দেখা ২ জনের কাছে আমার অনুমান ঠিক কিনা জানতে চাইলাম। তারা বললো, ‘পুরানা হিন্দি ফিল্মে থাবড়ার সাথে 'আউকাত' (স্টেটাস?) কথাটা প্রায়শ থাকে।‘

 

হিন্দি নাটক-ফিল্মেও 'আউকাদ মেহ রেহ', 'জিয়্যাদা হিরো মাত বান' টাইপ ডায়লগের কথাও বললো। 

দাবাং সিনেমায় সোনাক্ষী সিনহার সিনেমার পপুলার ডায়লগ: 'থাপ্পাড় সে ডর নেহি লাগতা সাহাব, পেয়ার সে লাগতা হ্যায়'।

 

যাহোক, থাবড়া বলে: নিজের অবস্থান ও পরিচয় ভুইলা যাইয়ো না। লিমিট ক্রস কইরো না। 

 

অন্যদিকে, ঘুষি বা ঠুয়া যেন এক প্রকার যুদ্ধ। প্রকাশ্য শত্রুতা; বিরূপতার প্রকাশ্য ঘোষণা। ঘুষি টার্গেটরে ধরাশায়ী করতে চায়। ঘুষি পুরুষালি শক্তির দেখনদারির (বা ধরেন, মর্দামির) প্রকাশক। ফলে ঘুষি পাল্টা-ঘুষির আহ্বান জানায়। এবং প্রায়ই পাল্টা ঘুষি আসেও। মোদ্দাকথা ঘুষি শারীরিক শক্তির বহিঃপ্রকাশ, সামাজিক শক্তির না।

 

ঘুষি জিনিসটা যে আমরা থাবড়ার মতো অতো ভাল করে চিনি না তার প্রমাণ পাওয়া যায় ফিল্মে। ফিল্মে ঘুষির আওয়াজ কেমন?

 

ঢিশুম! ঢিশুম!

ভিশাআআআক! 

 

এই আওয়াজগুলা প্রমাণ করে কৃত্রিমভাবে বানানো ঘুষির আওয়াজ বাস্তব ঘুষিরে ভালো করে তুলে ধরে না। বরং  নাটকে-ফিল্মে থাবড়ার 'ঠাস!' করে যে আওয়াজটা শোনা যায়, তা অতিরঞ্জিত হইলেও  বাস্তবের থাবড়ার শব্দের কাছাকাছি। আমরা ঘুষির চাইতে থাবড়া সম্ভবত ভালো চিনি।

 

৩য়ত—

থাবড়ানো মূলত সিম্বলিক ভায়োলেন্স। এই ভায়োলেন্সে ধিক্কার, অপমান ও গণলজ্জা (পাবলিক শেইমিং) দেওয়ার বিষয়টা থাবড়ার মূল ও গুরুত্বপূর্ণ  জায়গা। 

থাবড়ার ভূমিকা মূলত থাবড়ানোর উদ্দেশ্যরে বড় কইরা তোলা। ঘুষির ক্ষেত্রে পাল্টা ঘুষি যতটা দেখা যায়, সেই তুলনায় থাবড়ার জবাবে পাল্টা-থাবড়া (কাউন্টার-স্ল্যাপ) আসে কদাচিৎ।

 

৪র্থত—

সোশাল হায়ারার্কির এক ধরণের মেনিফেস্টেশন আকারেও থাবড়ানোর জনপ্রিয়তা বা অ-জনপ্রিয়তারে পাঠ করা যায়। থাবড়ার প্রয়োগ 'ট্রাডিশনাল লাইন অফ অথরিটি' জোরদার করতে।    

 

থাবড়া সামষ্টিক অতীত বহন করে; একটা থাবড়া তার 'থাবড়া' কাজটার সাথে সোশাল ক্লাসের অতীত আদর্শ ও পুরা সৈন্যবাহিনীরে তার শক্তিমত্তা জাহিরের অংশ করে। থাবড়ানো কর্মটারে 'নজির' বা 'দৃষ্টান্ত স্থাপন করা'-মূলক কর্মকান্ডের অংশ করে তোলে। এই শাস্তিপ্রদান কর্তৃত্বের ক্ষমতা চর্চা। সামাজিক হায়ারার্কিতে সংশোধনমূলক মাস্টারির ভূমিকা নিতে চায় থাবড়া।

 

৫মত—

সমাজে পরস্পরের হায়ারার্কি বা পজিশনের ভিত্তিতে ইন্টারেকশনের বদলে, আমরা যদি ব্যক্তি বা ইন্ডিভিজুয়াল হিসেবে ইন্টারেক্ট করি, অর্থাৎ সমাজ-কাঠামো যদি আরও ইগালিটারিয়ান হয়া ওঠে, সম্ভবত আমাদের সমাজেও থাবড়ানো কমবে আর ঘুষির ব্যবহার বাড়বে।  

 

থাবড়া থেকে ঘুষি তথা ঠুয়ায় এই সামাজিক উত্তরণ– ইন সাম ট্রুলি আইরনিক ওয়ে— গুড নিউজ হওয়ার কথা!

 

৩৪৯ পঠিত ... ১৩:৩১, এপ্রিল ১০, ২০২৩

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top