জীবন ও মহল্লার বাস্তবতায় আগারওয়ালের একদিন

৩৪১ পঠিত ... ১৬:৪২, অক্টোবর ৩১, ২০২২

Agarwaler-ekdin

চেক শার্ট, ময়লা জিন্সের প্যান্ট আর হাতে পুরোনো দিনের ক্যাসিও ঘড়ি। যেন পৃথিবীর সমস্ত মলিনতা নিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছে পরাগ। আজ সোমবার। অথচ পরাগের মধ্যে কোনো তাড়াহুড়া নেই। অথবা তাড়াহুড়া থাকলেও মহল্লার মানুষ সেটা বুঝতে পারে না।

পরাগের মনে হতে লাগলো, মহল্লার প্রতিটা চোখ কেবল তার দিকেই তাকিয়ে আছে। যেন চোখ দিয়েই প্রশ্ন করছে, চাকরি হারাইছো না? এবার তো প্রেমিকা হারাবা, আত্মীয়-স্বজন হারাবা!

এসব ভাবতে ভাবতে পরাগ অনুধাবন করল, সে যেন শরৎ এর এই রৌদ্রজ্জ্বল সকালে নিজেকেই হারিয়ে ফেলতেছে।

চায়ের দোকানদার জমিরুদ্দিন দূর থেকে ডাক দেয়- ও পরাগ! চা খায়া যাও!

অথচ এই জমিরুদ্দিন আগে কখনো নাম ধরে ডাকেনাই। সব সময় বলত, 'অই! পরাগ আগারওয়াল আসছে! বেঞ্চি মুইছা দে। ভাইরে চা খাইতে দে। বিস্কুট দে'।

কোনো এক মুরব্বি টুইট করে বলছিলেন, 'চাকরি চইলা যাওনের খবর বাতাসের আগে পৌঁছায়া যায়'।

পরাগের মনে পড়ে যায় সেই টুইটের কথা। পরাগ দোকানের দিকে এগিয়ে যায়। হেসে জমিরুদ্দিনকে বলে, 'দেন এক কাপ। চিনি বাড়ায়ে দিয়েন।'

জমিরুদ্দিন জিভে কামড় দিয়ে বলল, 'চিনির যা দাম! এক চামুচের বেশি দিলেই দিন শেষে লস।'

পরাগ কথা বাড়ায় না। অথবা বাড়াতে চাইলেও তার মস্তিষ্ক এখন কথা গুছিয়ে বলতে পারছে না।

চা সিগারেট খেয়ে পরাগ বিল জানতে চাইলো। জমিরুদ্দিন যেন অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও বলল, 'বত্রিশ ট্যাকা। তুমি ত্রিশ ট্যাকা দ্যাও। দুই টাকা দেওন লাগবো না।'

পরাগ আগারওয়াল ঠিক এই মুহূর্তে বুঝতে পারলো, পৃথিবীতে তার দাম কমে গেছে। অথবা আগেও এমন দামই ছিলো। সে হয়তো দাম এর মত আপেক্ষিক বিষয় নিয়ে আগে কখনোই মাথা ঘামায়নি।

পরাগ দোকান থেকে বের হয়ে রিকশা ডাক দিলো। পরাগের বাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু ফেরার এই পথটুকু হেঁটে যাওয়ার মত সাহস তার নেই৷ এত গুলো চোখ, এত গুলো সিম্প্যাথি সে নিতে পারবে না।

রিকশাওয়ালা থেমেই বলল, 'ওঠেন। দশটাকা কমায়া দিয়েন।'

এমন কথা শুনে পরাগের রিকশায় উঠতে ইচ্ছা করল না। অথবা এখন 'যেদিকে চোখ যায় সেদিকে' চলে যেতে পারলে পরাগ সেটাই করত। অনিচ্ছায় রিকশায় উঠে পরাগ উদাস চোখে আকাশের দিকে তাকালো।

আকাশের মেঘগুলাও যেন উড়তে উড়তে বলছে, 'কী ব্যাপার তোমার চাকরি নাই?' অথবা তারা কথাই বলছেনা। যার চাকরি নাই, তার সাথে আবার কীসের কথা!

বাসার সামনে রিকশা থামতেই পরাগের দেখা হয় মহল্লার মুদি দোকানদার আব্বাস ভাই এর সাথে। রিকশা ভাড়া দেয়ার আগেই আব্বাস ভাই বলে উঠলো,'হিসাব কইরা খরচ করো মিয়া। আর বিকালে দোকানে আইসো। তোমার বাকি খাতা নিয়া বসুমনে।'

এবার পরাগ আগারওয়ালের খুব অভিমান হল। নিজের উপর,মহল্লার মানুষের উপর। অথবা এটা ঠিক অভিমান না৷ হয়তো চাকরি চলে গেলে এমনভাবেই ভাবে সবাই। তখন মানুষ হয়ে যায় শুকিয়ে যাওয়া বকুল ফুলের মত। শেষ ঘ্রাণটুকু নিয়ে কোনোমতে বেঁচে থাকে।

বাসায় ঢোকার আগে মোবাইলে রিচার্জ করতে গেলে পরাগের সব মন খারাপ ধ্বংস্তুপে পরিণত হল। রিচার্জ এর দোকানী যখন বলল, 'ফোনে টাকা নাই। রিচার্জ হইবোনা।' পরাগ আগারওয়াল এর পায়ের নিচে তখন আর কোনো মাটি নেই।

তার পুরো শরীর যেন অবশ হয়ে গেলো। এই দোকানীই সেদিন বলেছিলো, 'আপনের আসনের দরকার নাই। ফোন দিলেই রিচার্জ হয়া যাইবো। বৎসরের শেষে আইসা কার্ড দিয়া একখান ঘষা দিয়া যাইয়েন।'

পরাগ বাসার পথে হাঁটে। তার পায়ের জুতা সামনে আগাতে চায়না। এমন সময় তার ফোন বেজে উঠলে মহল্লার লোকজন যেন খুব অবাক হয়। তারা একে অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে যেন বলতে থাকে, যার চাকরি নাই, তাকে আবার কে ফোন দিলো!

পরাগ ফোন ধরতেই অপর পাশ থেকে নাইন মিনিট স্কুলের কাস্টোমার সার্ভিসের ছেলেটা মিষ্টি করে বলল, 'বিসিএস প্রিলি স্পেশাল বুলেট ব্যাচের জন্য আজই এনরোল করুন'। পরাগ আগারওয়াল মনে মনে খুশি হয়। বাসায় না ঢুকে সে একটা রিকশা নিয়ে নীল ক্ষেতের দিকে এগোতে থাকে। সামনের বিসিএসটা একটু সিরিয়াসলি দিতে হবে।

৩৪১ পঠিত ... ১৬:৪২, অক্টোবর ৩১, ২০২২

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top