পেনড্রাইভ

১৫৮৭ পঠিত ... ০০:৩৩, মে ০৩, ২০২২

Pendrive (1)

১.

সেদিনও অন্যান্য দিনের মতো আমাদের বিজ্ঞাপনী অফিস শুরু হয়েছে শত শত ব্রিফের চাপ মাথায় নিয়ে, সবাই সবার সকালের চায়ে চুমুক দিয়ে যে যার ব্যস্ততায় ছড়িয়ে গিয়েছে। ক্লায়েন্ট সার্ভিসিং শুরু করে দিয়েছে ব্রিফের ভেঁপু, ক্যাম্পেইন লাগবে, কপি লাগবে, স্ক্রিপ্ট লাগবে, জিঙ্গেল লাগবে, জীবন লাগবে, আজকেই লাগবে, এখনই লাগবে, গতকাল লাগবে। এইসব লাগালাগি এড়িয়ে ঘড়িতে তখন প্রায় বারোটা। অনিক ভাইয়ের সাথে অফিসের ঠিক মধ্যখানে দেখা হয়ে গেলো আশিষ চক্রবর্তীর।  

আশিষ চক্রবর্তী মুখটা ফ্যাকাশে, সে কিছু একটা খুঁজছে। অনিক ভাইয়ের সাথে দেখা হওয়ার সাথে সাথে উশখুশ করে জিজ্ঞেস করলো, ‘ব্রো আপনার কাছে কী পেনড্রাইভ আছে?’  

অনিক ভাই আছেন তখন মহা যন্ত্রনায়। সকাল থেকে একটা গল্প তার কাছে ধরা দেবে দেবে করেও ধরা দিচ্ছে না। বারবার চা সিগারেট খেয়ে গল্পকে ডাকার চেষ্টা করছেন, কিন্তু গল্পের হদিস নেই। ফলে তিনি গল্পটাকে আরও গভীরভাবে ভাবার জন্য বাথরুমের দিকে যাচ্ছিলেন অথবা এমন হতে পারে আসলে অনিক ভাইয়ের এক অথবা দুই নম্বরের যে কোনো একটি বাথরুম পেয়েছিলো। আর তার মাথায় চলছিলো একটি গল্পের সন্ধান। যেখানে একটি মেয়ে আজেবাজে বাল্বের আলোতে পড়ালেখা করে পরীক্ষায় ডাব্বা মারে পরে মেয়েটি একটি প্রথিতযশা বাল্বের নিচে পড়ালেখা করে বোর্ড স্ট্যান্ড করে ফেলে।  

ফলে বাল্বের ভাবনায় থাকা অবস্থায় হুট করে পেনড্রাইভের মতো ছোটখাটো বিষয়ের কথা শুনে তিনি কিছুটা বিরক্ত হলেন বটে, তবে বিরক্তি বুঝতে না দিয়ে সম্পূর্ণ মার্জিত ভাষায় বললেন, ‘না ব্রো! নাই।’

‘ওহো নাই!’ বলে বিবর্ণ মুখে আশিষ ঝড়ের বেগে চলে গেলো। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে শাকিব খান, গুণ্ডারা তার মা খালেদা আকতার কল্পনাকে আটকে রেখে পেনড্রাইভ চেয়েছে। এক্ষুনি পেনড্রাইভটা না পেলে তারা বড় ধরনের ক্ষতি করে ফেলবে।   

 

২.

বিকাল চারটার আশেপাশে সময়। অফিসের ব্যস্ততা তখন গাবতলী, মহাখালি কিংবা সায়েদাবাদ বাস স্ট্যান্ডের মতো। এরমধ্যে অনিক ভাই চূড়ান্ত হতাশ। কারণ তিনি গত তিন ঘণ্টা ভেবে যে ইউনিক গল্পটা পেয়েছেন ক্লায়েন্ট প্রথমবার শুনেই খুব খুশি হয়েছেন। খুশি হয়ে বলেছেন, ‘দারুণ গল্প। একদম ইউনিক। কিন্তু এটা না আমাদের ব্র্যান্ডের সাথে একদম যায় না। আপনাদের এমন একটা গল্প ভাবতে হবে যেটা একদম ইউনিক, যে গল্পে একটা বাচ্চা থাকবে, ইমোশন থাকবে, যে গল্পে বাচ্চাটা আমাদের বাল্বের আলোয় পড়ালেখা করে বোর্ডের সেরা হয়ে যাবে।’  

অনিক ভাই নতুন ইউনিক গল্পটাই ভাবছেন। কিন্তু হারামজাদা গল্প আবার আগের মতো ঢং শুরু করেছে। এই নিয়ে তিনি বিরক্ত, তার বিরক্তি সবচেয়ে বেশি সেই বাচ্চার উপর, যে প্রথিতযশা বাল্পের আলোতে পড়ে সেরা রেজাল্ট করে। তিনি কিছুতেই বুঝতে পারছেন না ভালো রেজাল্ট করতে সেই বাল্বের আলোতে পড়তে হবে কেন? হারামজাদা তোর যদি পড়ালেখা করার ইচ্ছা থাকে তাহলে তুই তো হারিকেনের আলোতে পড়েও বোর্ড স্ট্যান্ড করবি। আর এখন তো বোর্ড স্ট্যান্ড করার যুগও নাই। ফলে অনিক ভাই ভাবতে ভাবতে অন্য একটা গল্প পেয়ে গেলেন। গল্পটা একজন বয়স্ক মহিলার, যে মহিলার ক্লাস নাইনে থাকতে বিয়ে হয়ে যায়। এরপর তার পাঁচ বাচ্চাকাচ্চাকে মানুষ করে বড় বড় করতে করতে কেটে যায় আরও অনেক বছর। বাচ্চারাকাচ্চারাও এখন সবাই বিয়ে করে সংসারী। ঘরজুড়ে মহিলার নাতি-নাতনী। সুখের কোনো অভাব নেই। আর মহিলার হাতেও অফুরন্ত সময়। তিনি ভাবলেন আবার পড়ালেখা শুরু করে ম্যাট্রিক পরীক্ষাটা দেবেন। কিন্তু এখানেই গল্পের টুইস্ট, কারণ গল্পের মহিলা ততোদিনে অন্ধ হয়ে গেছেন। মূলত এক অন্ধ মহিলা প্রথিতযশা বাল্বের আলোতে পড়ালেখা করে এ প্লাস পাবেন। চারিদিকে হৈচৈ পড়ে যাবে, সাংবাদিকরা লাইন ধরবে। কিন্তু ঝামেলা হচ্ছে অন্ধ মহিলা কীভাবে বাল্বের আলোতে দেখবেন। এই লজিকটা মেলাতে পারলে দারুণ একটা গল্প হবে। মানুষ দেখতে দেখতে চোখ মুছবে। অনিক ভাই যখন অন্ধ মহিলার দৃষ্টি নিয়ে প্রচণ্ড চিন্তা করছিলেন ঠিক তখনই দৃশ্যপটে এসে হাজির আশিষ। সে এসে খুব নির্মল কন্ঠে বললেন, ‘অনিক ব্রো।’   

অনিক ভাই নিজের ভাবনায় থেকে জবাব দিলেন, ‘জি ব্রো?’

আশিষ কণ্ঠ আরো মোলায়েম করে বললেন, ‘ব্রো আপনার কাছে কী পেনড্রাইভ হবে?’ এবারও অনিক ভাইয়ের কিছুটা মেজাজ খারাপ হলো। তিনি সেটা খুব একটা লুকালেনও না, ‘সকালে তো কইলাম নাই।’

‘না, তাও’ এই বলে আশিষ আবার উদভ্রান্তের মতো চলে গেলো। তাকে দেখে মনে হলো সে পেনড্রাইভ না, রক্ত খুঁজছে, রক্তের গ্রুপ ও নেগেটিভ। ডাক্তার বলেছে চার ব্যাগ ও নেগেটিভ রক্ত লাগবে, না পেলে রোগীকে কিছুতেই বাঁচানো যাবে না।

 

৩.

সন্ধ্যা তখন লেগে এসেছে, বাইরের অন্ধকার অফিসের ভেতর থেকে বোঝা যায় না। কাজের ব্যস্ততায় এখনও দুপুর মনে হয়। অনিক ভাইয়ের মন খারাপ। কারণ ক্লায়েন্ট এবারও গল্পটা ভীষণ পছন্দ করেছে। করে বলেছে, ‘গল্পটা অসাধারণ। শুনেই তো চোখে পানি চলে আসছে। একদম প্রোপার ইমোশনটা আছে ভাই। দুর্দান্ত গল্প। কিন্তু অন্ধ, কানা, ল্যাংড়া, বধির এই ধরনের কাউকে আমরা আমাদের ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপনে দেখাবো না। দয়া করে একটা ইউনিক গল্প ভাবেন যেখানে একটা বাচ্চা আমাদের বাল্বের আলোতে পড়ে বোর্ড স্ট্যান্ড করে ফেলে।’ অনিক ভাইয়ের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা করলেও সেটা তিনি করতে পারছেন না। কারণ এইসব নিত্যদিনের ঘটনায় ছেঁড়ার মতো যথেষ্ট চুল অনিক ভাইয়ের মাথায় নেই। আল্লাহ আমাদের মাথার চুল ছেঁড়ার মতো অনেক সমস্যা দিয়েছেন কিন্তু ছেঁড়ার মতো এতো চুল মাথায় দেননি। ঠিক এই সময় আবার আশিষ চক্রবর্তীর প্রবেশ, এবং তার চেহারা একই রকম বিষন্ন আর উদভ্রান্ত। দেখে মনে হচ্ছে সে রক্ত মানে পেনড্রাইভ খুঁজে পায়নি। সে অনিক ভাইয়ের কাছে এসে কন্ঠ আগেরবারের চেয়ে বেশি মোলায়েম করে বললো, ‘ব্রো’

: জ্বি ব্রো

: আপনার কাছে কী পেনড্রাইভ আছে?

এবার আর অনিক ভাই সহ্য করতে পারলেন না। একটু রেগে গিয়েই বললেন, ‘হ আছে। কিন্তু পার্মানেন্ট।‘

তার উত্তরটাও আশিষ বুঝতে পারে, সেও একটু কড়া স্বরে উত্তর দেয় ‘ওইডা আমারও আছে।’

: কিন্তু আপনেরটা আর আমারটায় পার্থক্য আছে।

: কী পার্থক্য?

: আমারটায় ক্যাপ নাই, আপনারটায় ক্যাপ আছে।

 

৪.

সন্ধ্যার সেই সংলাপের পর পেনড্রাইভ বিষয়ক সকল আলোচনা সেখানেই শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু এমন একটি ঘটনার শেষ এভাবে হবে সেটা আমি কিছুতেই মানতে পারলাম না। আর কর্পোরেট পৃথিবী যখন বলে অফিসটা একটা পরিবার। ফলে পরিবারের সদস্যদের সবার হক আছে উক্ত ঘটনাটি শোনার। ফলে সকলকে মিটিং রুমে ডেকে নিয়ে আমি পুরো গল্পটা শোনালাম আর সবাই মিলে একমত হলাম যে আশিষ চক্রবর্তীর জন্য আমরা পুরো অফিসে পেনড্রাইভ খুঁজবো। যেখান থেকে পারি তাকে পেনড্রাইভ ম্যানেজ করে দিতেই হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। তখনই মিটিং রুমে প্রবেশ করলেন আমাদের সিনিয়র সহকর্মী জুয়েল ভাই। যিনি বিয়ে করেছেন প্রায় বিশ বছরের মতো। তার দুই ছেলের বড়জন কলেজে পড়ে, ছোটজন সামনের বার ম্যাট্রিক দিবে। তিনি প্রবেশের সাথে সাথে রুমে বসে থাকা নাঈম জিজ্ঞেস করলো, ‘জুয়েল ভাই আপনার কাছে কী পেনড্রাইভ আছে?’

শুনে জুয়েল ভাই উত্তর দিলো, ‘আছে, তবে নষ্ট। কাজ করে না।

তার উত্তর শুনে যে হাসির আওয়াজ হলো সেই হাসিটা তিনি ধরতে পারলেন না। বারবার জিজ্ঞেস করার পর আমরা যখন ঘটনা খুলে বললাম তখন তিনিও হাসিতে অংশ নিলেন এবং মিটিং রুমে বসে পড়লেন। আর তার সাথে সাথেই রুমে প্রবেশ করলো, প্লেবয় খ্যাত সহকর্মী অর্ক। তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘অর্ক তোমার কাছে কী পেনড্রাইভ আছে?’

সে হেসে বললো, অবশ্যই আছে। কয়টা লাগবে? ১২৮ জিবি, ৬৪ জিবি সব ধরনের পেনড্রাইভই আছে।’

কেউ একজন হাসি সামলে আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘সাথে আছে?’

অর্ক আবার উত্তর দিলো, ‘আমি বাবা পেনড্রাইভ সবসময় সাথে রাখি। কখন কোথায় দরকার পড়ে যায় তার ঠিক আছে?’

অর্ককেও ব্যাপারটা খুলে বলা হলো। সে তেমন রাগ না করে দ্রুত আমাদের দলে সামিল হয়ে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। অবশ্য খুব একটা অপেক্ষা করতে হয়নি। ততক্ষণে হেলেদুলে রুমে প্রবেশ করেছে ডিজাইনার ফাহাদ ভাই। তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, ফাহাদ ভাই তোমার কাছে কী পেনড্রাইভ আছে’

‘হ আছে তো। পিসির সাথে লাগানো’ ফাহাদ ভাই জবাব দিলো।

আবার দমকা হাসি। আবার সবকিছু খুলে বলা। এবং এবার ফাহাদ ভাইও দ্রুত আমাদের দলে সামিল হয়ে গেলো। আমরা সবাই মনে মনে অপেক্ষা করছিলাম পরের শিকারের আর নিজেরা ভেতরে ভেতরে উত্তেজনাবোধ করছিলাম একটা মেয়ে আসলে সে কী উত্তর দিতে পারে! কিন্তু মেয়ে আর আসলো না। আসলো আমাদের আরেক সহকর্মী রাকিন। তাকেও জিজ্ঞেস করা হলো, ‘রাকিন তোমার কাছে কী পেনড্রাইভ আছে?’

‘আছে, তবে গার্লফ্রেন্ড নিয়ে গেছে। ওর নাকি লাগবে।’ রাকিনের নির্বিকার উত্তর। সে তো জানলোই না তার কথার গভীর মর্মার্থ কী? অতএব পুরো রুম আবার হাসির খামার হয়ে গেছে রীতিমত। হাসি থামে কিন্তু আবার থামে না। নিভে যাওয়া আগুনের ছাইয়ের ভেতর থেকে যেমন আগুন উঁকি দেয় তেমন করে হুট করে থেমে যাওয়া হাসির ভেতর থেকে কেউ একজন কেউকেউ করে ওঠে। সেই হাসি শুনে আরেকজন হাসে আবার হাসি ছড়িয়ে যায়। ততক্ষণে আমরা পরের শিকারের জন্য অপেক্ষা করছি। বিধাতা আজ কপালে কী রেখেছে কে জানে। খুবই হন্তদন্ত ভঙ্গিতে রুমে প্রবেশ করলো স্মার্ট বয় ফারদিন। সবার এমন কাহিল অবস্থা দেখে সে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী হইছে সবার?’

‘আমাদের একটা পেনড্রাইভ দরকার। তোমার কাছে আছে?’ কেউ একজন বললো।

‘আছে তো। গাড়িতে রেখে আসছি। লাগলে নিয়ে আসতেছি।’ বললো ফারদিন অথচ হাসলো পুরো রুম। এমন একটা উপকারী ছেলের উপকার করার কথা শুনে সবাই হাসছে। ফারদিন ব্যাপারটা বুঝলো না। তবে তার জানতেও দেরিও হলো না।

আমরা বুঝে গেলাম যে, এখানে যতোক্ষণ বসে থাকবো ততক্ষণ কেউ না কেউ আসবে ততক্ষণ ঘটনা চলতে থাকবে। ফলে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম এখনই বের হয়ে যাবো। কিন্তু ঠিক তখনই রুমে প্রবেশ করলো আরেফিন। তাকেও সেই বহুল জনপ্রিয় প্রশ্নটি করা হলো, ‘সালেকিন তোমার কি পেনড্রাইভ আছে?’

সালেকীন প্রশ্ন শুনে খুব হতাশ। সে বলে, ‘ছিলো। এখন নাই। কে যেন মাইরা দিছে।’

আবার সেই হাসি, আবার সব খুলে বলা। আবার অপেক্ষা পরের শিকারের। কিন্তু আমরা গ্লাসের রুম থেকে বাইরে তাকিয়ে দেখি মিটিং রুমের দিকে আমাদের এক মেয়ে সহকর্মী আসছে। তার আসা দেখেই আমাদের ভেতরকার লজ্জা আর উত্তেজনা একাকার হয়ে যাচ্ছে। কী জানি কী উত্তর দেয়। আমরা ভাবতে ভাবতে রুমে প্রবেশ করলো আমাদের সহকর্মী ঐন্দ্রিলা। আমাদের ভেতর চাপা উত্তেজনা। কেউ একজন কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো, ‘ঐন্দ্রিলা তোমার কী পেনড্রাইভ আছে?’

পুরো অফিস নীরব, ঐন্দ্রিলার উত্তরের জন্য পিঁপড়ারাও বোধহয় হাঁটাহাঁটি বন্ধ করে দিয়েছে। সবার কান খাড়া, মনযোগ ঐন্দ্রিলার মুখের দিকে।  

সবাইকে চমকে দিয়ে ঐন্দ্রিলা বললো, ‘আমার তো পেনড্রাইভ নাই।’

 

১৫৮৭ পঠিত ... ০০:৩৩, মে ০৩, ২০২২

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top