এয়ারপোর্টে যেভাবে আমি এক প্যাকেট সিগারেট খোয়ালাম

৮৫৯ পঠিত ... ১৭:৩২, মার্চ ২২, ২০২২

Airport-cigerette

২০১৭ সাল, নভেম্বর মাস। ভোর সাড়ে ছয়টা। হংকং এয়ারপোর্টের ইন্টারন্যাশনাল ডিপারচার দিয়ে ঢুকে ব্যাংককগামী থাই এয়ারওয়েজের কাউন্টারের খোঁজ করছি। একাই গিয়েছিলাম সেবার বাংলাদেশ থেকে। সাথে কেউ না থাকায় সারাক্ষণ ভয়ে থাকতাম দেরি করে ফেলার৷ তাই শিডিউল টাইমের অনেক আগেই পৌঁছে গেছি। দেখলাম, কাউন্টার তখনো খুলেই নাই।

কিছু করার না থাকায় খাবারের দোকানে ঢুকে একটা স্যান্ডউইচ খেলাম। কফি হাতে নিয়ে স্মোকিং এরিয়া খুঁজতে বের হলাম। ভিতরে স্মোক করা যাবে না। তাই টার্মিনালের বাইরে বেরিয়ে আসলাম। সিগারেট ধরিয়ে টানছি, দেখলাম এক লোক হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছে আমার দিকে৷ আমি ডানেবামে তাকিয়ে দেখলাম আর কাউকে দেখে হাসছে কি না। তখন সেখানে আমি ছাড়া কেউ ছিল না৷ নিশ্চিত হলাম, হাসিটা আমার উদ্দেশ্যেই।

অচেনা মানুষ। উপমহাদেশীয় চেহারা৷ বেশ লম্বা, প্রায় ছয়ফুট৷ জিন্সপ্যান্ট পড়া, গায়ে কডের জ্যাকেট, মাথায় বেসবল ক্যাপ। বয়স আনুমানিক ৫০। কানের পেছন দিয়ে কাঁচাপাকা লম্বা চুল বেরিয়ে আছে। অনেকদিন কাটে না বোঝা যায়৷

কাছে এসে হাত মেলাল। ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করলো, আমি ইন্ডিয়ান কি না?

মাথা নেড়ে জানালাম, বাংলাদেশ থেকে আসছি।

খুব সাবলীল ভঙ্গিতে একটা সিগারেট চাইলো। তার স্টক নাকি শেষ। দিলাম একটা বের করে। প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললাম, বেনসন এন্ড হেজেস, লাইট, বাংলাদেশের তৈরি। খুশি হল সে সিগারেট পেয়ে। নিজের নাম বলল। নামটা ভুলে গেছি, পবন সিং বা ওইজাতীয় কিছু হবে। চন্ডীগড়, হরিয়ানার আদি বাসিন্দা।

নামের শেষে 'সিং' দেখে জিগাইলাম, পাঞ্জাবি শিখ কি না?

সে বলে, না, শিখ না, হিন্দু জাঠ সম্প্রদায়ের। বীরেন্দর শেহওয়াগের মত। আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ডু ইউ ফলো ক্রিকেট?

আমি তো মওকা পেয়ে গেলাম৷ ফেভারিট টপিক৷ সেও ভালই ধারণা রাখে দেখলাম৷ ক্রিকেট, ক্রিকেটারদের নিয়ে প্রো লেভেলের কথাবার্তা হল। সাকিব, তামিম, মাশরাফিদের খবরও সে রাখে৷ কার কেমন পারফরম্যান্স ভালোই জানে।

জাঠরা ত্যাড়া টাইপের। ঐতিহাসিকভাবে তারা কৃষিজীবী, নিম্নবর্গের শূদ্র সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। বেসিক্যালি উত্তর ভারতের অধিবাসী। দিল্লি, পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও এর আশপাশের এলাকায় থাকে।

যবের তৈরি শক্ত রুটি খায় বলে এদের চোয়ালের গড়ন হয় চারকোনা টাইপের। খেয়াল করে দেখলাম, এই লোকও দেখতে বীরেন্দর শেহওয়াগ এবং সন্দ্বীপ রায়ের (সত্যজিৎপুত্র) মাঝামাঝি। থুতনির মাঝখানে একটা খাঁজ আছে। মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া গেল, জাতের ব্যাপারে সে সঠিক তথ্য দিয়েছে।

হংকংয়ে আছে প্রায় বিশ বছর যাবত। ব্যবসা করে, ইমপোর্ট: এক্সপোর্টের৷ হংকং থেকে ভারতে ইলেকট্রনিকস আইটেম পাঠায়, দেশ থেকে নিয়ে আসে খাদ্যদ্রব্য। বিশাল ভারতীয় জনগোষ্ঠী হংকংয়ে থাকে। ভারতের অনেক কিছুরই চাহিদা সবসময়ই তুঙ্গে। তাদের সাপ্লাই দিয়েই নাকি কুল পায় না।

সাথে থাকা ব্যাগের ভেতর থেকে চার পাঁচটা শুকনো খাবারের প্যাকেট বের করল। গুজরাটি খাবার, ঠেপলা, ধোকলা:  এগুলোর গুড়ো। পানিতে মিশিয়ে দিলে ইন্সট্যান্ট নুডলসের মত করে ফুলে উঠবে৷ সবিনয়ে ফেরত দিলাম। বললাম যে, এগুলো নিয়ে আমাদের এয়ারপোর্ট দিয়ে ঢুকা যাবে না। হুদাই৷

ফ্যামিলির কথা জিজ্ঞেস করলাম। সে জিভ কাটল। বলে যে, বিয়ে হয়েছিল তার দেশে থাকতে৷ দুইবছর পরেই ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। একটা মেয়ে আছে ১৮ বছর বয়স। মেয়ে তার মা: সহ দিল্লিতে থাকে। মেয়ের খরচ পাঠিয়ে দেয় প্রতিমাসে। এছাড়া পরিবারের সাথে কোন যোগাযোগ নাই।

সে এয়ারপোর্টে এসেছে তার গার্লফ্রেন্ডকে বিদায় জানাতে। গার্লফ্রেন্ড ইউক্রেনিয়ান। হংকংয়ে একটা বারে কাজ করে৷ উইকেন্ডে একবার ড্রিঙ্ক করতে গিয়ে তিনমাস আগে তার সাথে পরিচয় হয়েছে। তারপর থেকে তারা লিভইন রিলেশনশিপে আছে। সে এখন থাকছে ওই মেয়ের ফ্ল্যাটে৷ মেয়ের বয়স ২৩। এই বলে চোখ টিপে দিল।

সিগারেট শেষ। হ্যান্ডশেক করে ঘুরে এয়ারপোর্টের ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছি, সে আমাকে ডাকল।

: ব্রাদার, একটা রিকোয়েস্ট করব।

: কী?

: আমাকে এক প্যাকেট সিগারেট দিতে পারবে? ভালোই লাগলো টানতে।

আমার কাছে দুই প্যাকেট এক্সট্রা সিগারেট ছিল ব্যাগে। প্যান্টের পকেটে যেই প্যাকেট ছিল সেখানে ছিল ৬-৭ টা।

কোন এক মনীষী আমাকে একবার বলেছিলেন কখনও কাউকে ধার না দিতে। পারলে একেবারে স্বত্বত্যাগ করে দান করে দাও অথবা তাকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করো।

যেহেতু আমার মন অনেক কোমল, তাই আমি ওকে খোলা প্যাকেটটাই দেয়ার মনস্থির করলাম।

সে এতেই মহাখুশি। আবারও আমাকে ধোকলা, ফেপড়া দিতে চাইল।

আসার সময় তার চোখের দৃষ্টির দিকে খেয়াল করলাম। লুনাটিক। ঘোরলাগা চোখের মণি। কেন যেন মনে হল, এই লোকটা আমাকে এতক্ষণ যতগুলো কথা বলেছে তার একটাও সত্যি নয়।

তার একমাত্র ইচ্ছা ছিল আমার কাছে থেকে সিগারেটের প্যাকেট হাতানো।

..

একটা জোক প্রচলিত আছে পাবনাতে৷ মানসিক হাসপাতালে যেসব রোগী দীর্ঘদিন চিকিৎসার পরে কিছুটা সুস্থ হয়ে রিলিজের পর্যায়ে যায়, তাদেরকে আর ঘরে আটকে রাখা হয় না। তারা হাসপাতালের ভেতর ঘোরাফেরা করতে পারে।

কোনও নতুন রোগীকে ভর্তি করতে আসলে সাথে থাকা লোকের সাথে এরা প্রথমে ভাব জমিয়ে তুলে। তারপর তাদের কাছে সিগারেটের আবদার করে।

সিগারেট পাইলে ভালো, চুপচাপ নিয়ে চলে যাবে।

আর যদি না পায়, তো সঙ্গেসঙ্গে তাকে গালি দিয়ে বলবে, 'শুয়োরের বাচ্চা, সাথে করে সিগারেট আনিসনি কেন?'

বলেই একটা চড় মেরে দৌড়....

৮৫৯ পঠিত ... ১৭:৩২, মার্চ ২২, ২০২২

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top