ছাত্র বনাম পুলিশ

৫১৫ পঠিত ... ১৬:৫১, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২৩

ছাত্র-বনাম-পুলিশ

 

০১.

‘দেখি! বের কর অভিজ্ঞান-পত্র- আইডেনটিফিকেশন কার্ড!’

কী আর করে বেচারি– দেখাতে হল কার্ডখানা। নামধাম ঠিকানা তো রয়েইছে, তদুপরি রয়েছে বেচারির ফোটোগ্রাফ, তার নিচে ছোকরার দস্তখত, এবং দুটোর দু কোণ জুড়ে য়ুনিভার্সিটির ট্যাম্প। হোমিওপ্যাথিক পাসপোর্ট আর কী!

হায় বেচারা! যখন য়ুনিভার্সিটিতে প্রবেশ করার ওক্তে সগর্বে কর্তৃপক্ষের সম্মুখে ফোটোগ্রাফের নিচে দস্তখত করেছিলে তখন কি জানত এটা ‘দস্তখত’ নয়, এই ‘কুকর্ম’, করে তার ‘দস্ত’ (হাত) ‘ক্ষত’ হয়েছিল– এ ‘পান’টি আমার নয়, বিদ্যেসাগর মশাইয়ের। তাঁর প্রোতেজে মাইকেল পান করতেন প্রচুর, স্বয়ং বিদ্যেসাগর ‘পান’ করতেন অত্যল্পই।

প্রাগুক্ত সরস প্রেমালাপ হচ্ছিল জর্মনির কোনও এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং পুলিশম্যানে (চলতি জৰ্মনে ‘শুপো’)। ছোকরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে রাত দুটোর সময় কাকর ছুড়ছিল একটি বিশেষ জানালার শার্সিকে নিশান করে, এবং যেহেতু তৎপূর্বে– অর্থাৎ শনির সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত দুটো অবধি চেন-স্মোকারদের মতো অ্যাট্টুখানি, মানে ইয়ে, ওই যাকে বলে বিয়ার পান করেছিল বলে তাগটা স্বভাবতই টালমাটাল হয়ে পাশের যার-তার জানালার শার্সির উপর পড়েছিল। অবশ্য একথা অবিসম্বাদিত সত্য যে, সে কাপুরুষের মতো শুপোর হাতে আত্মসমর্পণ করেনি– আপ্রাণ পলায়ন-প্রচেষ্টায় নিষ্ফল হয়ে তবে ধরা পড়ে।

ব্যাপারটা সবিস্তার কী?

অতি সরল। জর্মন ছাত্রছাত্রী ডিগ্রি লাভের পূর্বের তিন বৎসর ভূতের মতো খাটে। কিন্তু শনি-সন্ধ্যা থেকে রবির সকাল পর্যন্ত দল বেঁধে ‘পাবে’ বসে প্রেমসে বিয়ার পান করে। এবং যেহেতু বাড়াবাড়ি না করলে খ্রিস্টধর্ম মদ্যপান সম্বন্ধে উচ্চবাচ্য করে না, তাই কোনও কোনও ধর্মানুরাগী ছেলে তোর সাতটার ‘মেস’-এ (উপাসনায়) যোগ দিতে যায় ‘পাব’ থেকেই, সোজা গির্জার দিকে– শনির সন্ধ্যা থেকে রবির ভোর ছটা সাড়ে ছ’টা অবধি বিয়ার পান করার পর। অবশ্যই মত্তাবস্থায় নয়– তবে ইংরেজিতে যাকে বলে ঈষৎ মডলিন।

তা সে যাক। এ লেখকের বিষয়বস্তু পুলিশ বনাম স্টুডেন্ট (স্টু’ডেন্ট’ বলতে জর্মনে একমাত্র য়ুনিভার্সিটি স্টুডেন্টই বোঝায়– স্কুলবয়কে বলে ‘শ্যুলার’)। এই দুই দলের মধ্যে হামেহাল অবশ্য সাধারণত সন্ধ্যার পর থেকে ভোর পর্যন্ত এবং বিশেষ করে শনি দিনগত রাতে– একটা অঘোষিত বৈরিতা বিরাজ করছে, য়ুনিভার্সিটি সৃষ্টির প্রথম দিন থেকে। আমি যা নিবেদন করতে যাচ্ছি তার ঐতিহাসিক পটভূমিটি কিন্তু কিংবদন্তিমূলক, অর্থাৎ পুরাণ জাতীয়। সেইটুকু সয়ে নিন। তার পরই মাল।

আমরা সকলেই জানি কতকগুলো উপাধি মানুষের নামের অচ্ছেদ্য অংশ : যেমন (১) রেভারেন্ড, (২) কর্নেল, (৩) ডক্টর (শুধু চিকিৎসক অর্থে নয়; যে কোনও বিষয়ে পিএইচডি, ডিএসসি জাতীয় ডক্টরেট পাস করা থাকলে)। প্রথম শ্রেণির উপাধিগুলো বিধিদত্ত, দ্বিতীয়গুলো রাজদত্ত এবং তৃতীয়গুলো য়ুনিভার্সিটিদত্ত।

রাজাতে-চার্চে লড়াই বহু যুগ ধরে চলেছে। এ লড়াইয়ে শেষের দিকে এলেন য়ুনিভার্সিটি। তার পূর্বে শিক্ষা-দীক্ষার ভার ছিল প্রধানত পাদ্রিদের হাতে। কিন্তু মহামতি লুথারের আন্দোলনের ফলে বহু পিতা পুত্রকে আর ‘কুসংস্কারাচ্ছন্ন’ যাজক সম্প্রদায়ের কাছে মানসিক, হার্দিক এমনকি আধিভৌতিক উন্নতির জন্য পাঠাতে চাইলেন না। এছাড়া আরও বিস্তর কারণ ছিল, কিন্তু সেগুলো এস্থলে অবান্তর না হলেও নীরস। মোদ্দা কথা, চার্চ ও রাজার লড়াইয়ের মধ্যিখানে য়ুনিভার্সিটিগুলো তক্কে তক্কে রইল আপন আপন স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বাধীনতা-স্বরাজ লাভের জন্য। তাদের মধ্যে অনেকেই ছিল লুথারপন্থী এবং তাদের মূল নীতি ছিল অনেকটা—‘যখন পোপের “গুরু-বাদ” ত্যাগ করে স্বয়ং স্বাধীনভাবে বাইবেল পড়তে চাও, এবং তদ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে একমাত্র স্বাধীন চিন্তার ওপর নির্ভর করে জীবন যাপন করতে চাও, তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দিতে হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বাধীনতা, (অটোনমাস ইন্ডিপেনডেন্ট)–নইলে তারা স্বাধীন চিন্তা, স্বাধীন বিচার-বিশ্লেষণ করবে কী প্রকারে?’

যে করেই হোক সে স্বাধীনতা য়ুনিভার্সিটি-টাউনগুলোর (অর্থাৎ যে শহরগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ই সর্বপ্রধান সর্বজনমান্য প্রতিষ্ঠান) রাস্তাঘাটেও সক্রিয় হয়ে উঠল। অর্থাৎ নিতান্ত খুন, ধর্ষণ জাতীয় পাপাচার না করলে স্বয়ং বিশ্ববিদ্যালয়ই ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আপন জেলে (?) পুরে দিত– বিচারের ভার নিতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ল’ বা আইন, জুরিসপ্রুডেন্সের প্রফেসরগণ ‘ছাত্র আসামি’ এদেরই একজন বা একাধিকজনকে আপন উকিল নিয়োগ করত– এবং সবকুছ ফ্রি-গ্যাটিস-অ্যান্ড-ফর-নাথিং!

সে-সব দিন গেছে। তবু শুনেছি হাইডেলবের্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিংবা অন্য কোনও একটা হতে পারে আমার ঠিক মনে নেই– জেলখানাটা নাকি এখনও মিউজিয়ামের মতো বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে এবং সেটি নাকি সত্যই দ্রষ্টব্য বস্তু!

যে পাঠক বাংলা ভাষায় অতুলনীয় (আমার মতে বাংলা ভাষায় ‘অদ্বিতীয়’) পুস্তক, উপেন বাঁড়ুয্যের নির্বাসিতের আত্মকথা’ পড়েছেন, তিনি হয়তো স্মরণে আনতে পারবেন (আমিও স্মৃতির ওপর নির্ভর করে বলছি; তাই ভুলচুক হবে নিশ্চয়ই, এবং তার জন্য মাফ চাইছি) যে, যখন অরবিন্দ-বারীন-উল্লাস-উপেন-কানাই-সত্যেন এট আল-এর বিরুদ্ধে আলীপুরে বোমার মামলা হয় তখন হাজতে থাকাকালীন ছোকরাদের মধ্যে যাদের অদম্য কবিতৃপ্রকাশব্যাধি ছিল তার লেখনীমস্যাধারাভাবৎ কাঠকয়লা দিয়ে দেয়ালে পদ্য লিখত। তারই একটি,

‘ছিড়িতে ছিড়িতে পাট শরীর হইল কাঠ

সোনার বরণ হৈল কালি

 প্রহরী যতেক ব্যাটা বুদ্ধিতে তো বোকা-পাঁঠা

দিনরাত দেয় গালাগালি।’

 যতদূর মনে পড়ছে, ‘উপীন’বাবু যেন মুচকি হেসে মন্তব্য করছেন, আহা কী ‘সোনার বরণ’ই বঙ্গসন্তানের হয়!

তার পর যা লিখছেন তার সারমর্ম; মাঝে মাঝে দু-একটি ভালো কবিতাও চোখে পড়ত। উদাহরণস্বরূপ দিয়েছেন,

‘রাধার দুটি রাঙা পায়ে

অনন্ত পড়েছে ধরা,

ওঠে ভাসে কত বিশ্ব

চিদানন্দে মাতোয়ারা।’

 

 এবারে তিনি যেন তাঁর চোখে একফোঁটা জল আসতে না আসতে দুঃখ করছেন, হায়, রে মানুষের মন! কারাগারের পাষাণ-প্রাচীরের ভেতরেও রাধার দুটি রাঙা পায়ের জন্য সে আছাড় খায়!

***

জর্মন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন যুগের আপন জেলখানার কথা হচ্ছিল। তার অন্যতম প্রাচীনতমের নিঃসন্দেহ সর্বোকৃষ্ট বর্ণনা দিয়েছেন মার্ক টুয়েন। সে বর্ণনাটি এমনই সদ-জাতের-বাড়া চৌম্বকীয় আকর্ষণীয় বর্ণনা যে তারই টানে আমারই চেনা এক সহযাত্রী জর্মন-সীমান্তে পৌঁছেই নাক-বরাবর চলে যান ওই জেল দেখতে– সাঁ সুসি প্রাসাদ, ড্রেসডেনে সঞ্চিত রাফায়েলের মাদোন্না নস্যাৎ করে।

আলীপুরের যেসব ‘কবিরা’ প্রহরীকে পাঁঠা নাম দিয়েছিলেন, কিংবা চোখ বন্ধ করে রাখার দুটি রাঙা পায়ের ধ্যানে মজে গেছেন, তাঁরা কিন্তু বিলক্ষণ জানতেন, তাঁদের জন্য মৃত্যু জেলের চতুর্দিকে ঘোরাফেরা করছে–শহিদ হওয়ার সম্ভাবনা কবি, অকবি সকলেই প্রায় সমান। কিন্তু জর্মন-বিশ্ববিদ্যালয়-জেলে ছাত্রেরা যেত অল্প কয়েক দিনের জন্য, ফাঁসির তো কথাই ওঠে না। তাই মার্ক টুয়েনের পক্ষে সম্ভব হয়েছে অপূর্ব হাস্যরসে রঞ্জিত করে সেই জেলটির বর্ণনা দেবার। কাজেই উপস্থিত আলীপুরের কথা ভুলে যান।

***

বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাঁসি-কাঠ না থাকতে পারে, ক্যাবারে কাঁ কাঁর ব্যবস্থা না থাকতে পারে, কিন্তু লেখনী-মস্যাধারের অভাব!–এটা কল্পনাতীত। যদিস্যাৎ ওই জর্মনিরই সর্বোৎকৃষ্ট দশ লিটার বিয়ার প্রসাদাৎ কল্পনাটা করেই ফেলি, তখন চোখের সামনে, বিকল্পে, ভেসে উঠবে পেনসিল– একথা তো ভুললে চলবে না, এদেশের কেতাবপত্রে মহামান্য কাইজারের (ভারতীয় কাইসর-ই-হিন্দ পদক, লাতিন সিজার ইত্যাদি) নাম পড়ার বহু পূর্বেই ভারতীয় ছেলেবুড়ো ব্যবহার করেছে, Koh-i-noor, made by L. &C. Hardmuth in Austria, graphite drawing pencil, compressed lead.

তাই সেই পেনসিল অকৃপণ হস্তে ব্যবহৃত হয়েছে ছাত্র, ‘কয়েদি’র দল দ্বারা বংশপরম্পরায়– সাদা দেয়ালের উপর। শুধু কবিতা না, বহুবিধ অন্যান্য চিজ।

কিন্তু তৎপূর্বে তো জানতে হয়, এরা জেলে আসত কোন কোন ‘অপরাধ’ করে। এর অনেকগুলোই আমি স্বচক্ষে দেখেছি, এবং সাতিশয় সন্তোষ সহকারে স্বীকার করছি, সবল সক্রিয় হিস্যেদারও হয়েছি বহু ক্ষেত্রে অর্থাৎ শুপো-স্টুডেন্টেন, পুলিশ, ভর্সস ছাত্র ‘যুদ্ধে’ কিংবা যুদ্ধ আসন্ন দেখে দ্রুততম গতিতে পলায়নে। কিন্তু সেটা অন্য অধ্যায়।

 

০২.

 

‘পাজিটা এখনও এল না, ব্যাপারটা কী? বলেছিল না, তার কাকা আসছেন ডানৎসিগ থেকে, ওর জন্য নিয়ে আসবে কয়েক বোতল অত্যুকৃষ্ট ডাৎসিগার গোল্ট ভাসার (ডানৎসিগের-স্বর্ণবারি– সোনালি সোমরস), আমরা সবাই হিস্যে পাব।’

‘একটা ফোন করলে হয় না?’

‘হ্যাঁ! সেই আনন্দেই থাক! টেলিফোন! বুড়ির বাড়িতে এখনও দড়ি টেনে ভেতরের ঘণ্টা বাজাতে হয়। ইলেকট্রিক বেল পর্যন্ত নেই। তবে, হ্যাঁ, গার্লফ্রেন্ডদের যখন তখন আপন কামরায় নিয়ে যেতে দেয়। তদুপরি বুড়ি বদ্ধ কালা। শুনেছি, পায়ের উপর গরম ইস্ত্রিটা হঠাৎ হাত থেকে ফসকে পড়ে গিয়েছিল– শুনতে পায়নি।’

রসালাপ হচ্ছিল শনির সন্ধ্যায় ‘পাব’-এ। জনসাতেক মেম্বর জমায়েত হয়ে একটা গোল টেবিল ঘিরে বিয়ার পান করছেন। সেটার উপর কোনও টেবিল-ক্লথ নেই। আছে গত একশ বছরের স্টুডেন্ট খদ্দেরদের নাম, যারা প্রতি শনিবার এই টেবিলটা ঘিরে গুলতানি করেছে– ছুরি দিয়ে খোদাই করা। আমাদের পলের বাপ ভি হেমের নামও এই টেবিলে আছে। সমস্ত টেবিলটা নামে নামে সম্পূর্ণ ভর্তি হয়ে গিয়েছে– আর নতুন নাম খোদাই করার উপায় নেই।

এদের গুলতানির বর্ণনা বা ইতিহাস দেওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়। কারণ সবাই জানেন, সেই সোক্ৰাতেসের যুগ থেকে ইয়োরোপে গুণীজ্ঞানী থেকে চোরচোট্টা সবাই মদ্যালয়ে বসে বিশ্রম্ভালাপ করেছেন এবং সহজেই অনুমেয়, চোরচোট্টারা প্লাতোর ‘আইডিয়া’র সংজ্ঞা খুঁজতে গিয়ে ঘোরাঘুরি করেনি, আর সোক্রাতেস প্রতিবেশীর তালাটি কী প্রকারে নিঃশব্দে বে-কার করা যায় তাই নিয়ে মদ্যপান করতে করতে শিষ্যদের সঙ্গে কূট যড়যন্ত্রে ত্রিযামা যামিনী যাপন করেনি। অর্থাৎ যে যার বৈদগ্ধ্য, জ্ঞানবুদ্ধি, যাতে তার চিত্তাকর্ষণ, তাই নিয়ে কথাবার্তা কইতে ভালোবাসে। তবে হ্যাঁ, মদ্যপানের মেকদার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আলোচনার বিষয়বস্তু যে ঈষৎ নিম্নস্তরে নেমে যায় সেটা অনেকেই লক্ষ করেছেন। জর্মনির স্টুডেন্টদের বেলায়ও তাই।

আমার ছিল মেজাজমর্জি অত্যন্ত খারাপ। ঠিক সেদিনই খবর পেয়েছি ইংরেজ গোল্ড স্ট্যান্ডার্ডকে তালাক দিয়েছে। তারই ফলে আমার কুল্লে বচ্ছরের খরচার জন্য ব্যাঙ্কে গচ্ছিত টাকার এক-তৃতীয়াংশ (বেশি হতে পারে, কমও হতে পারে, এতকাল পর সঠিক বলা কঠিন) কর্পূর হয়ে গেল। অর্থাৎ এখন যে য়ুনিভার্সিটি রেস্তোরাঁয় সবচেয়ে সস্তা ডিনারটি (সে যুগে দাম ছিল এদেশি পয়সায় কুল্লে বারো আনা) খাব, তারও উপায় রইল না। কাল সন্ধ্যা থেকে রাত্তিরের খাওয়াটা নিজেকেই রাঁধতে হবে। ওদিকে দেশের ইয়াররা ভাবছেন, লেখাপড়ায় আস্ত একটা গর্দভ ওই ছেলে জর্মনি গিয়ে তোপ মজাটা লুটে নিলে, মাইরি!

ইতোমধ্যে এসব ‘পাবে’ শনির সন্ধ্যায় যা-সব হয় সে-সবই হয়ে গেছে। ঠেলায় করে গরম গরম সসেজ এসেছে, দু-চারটে আনাড়ি বাজিয়ে ব্যাঞ্জোর উপর উৎপাত করে যৎসামান্য কামিয়ে গিয়েছে, পিকচার পোস্টকার্ড জুতোর ফিতে বিক্রির ছলে ভিখিরি তার রোদ মেরে গেল।

করে করে রাত একটা বাজল। বিস্ময় বিবোধক চিহ্ন দেবার জন্য ওই চিহ্নেরই বিন্দুটির বিন্দুবৎ প্রয়োজন নেই; শনির রাত্রি জর্মনিতে আরম্ভ হয় বারোটায়– যদ্যপি গ্রিনিজ ফয়তা ঝাড়ে ওই সময়টায় নাকি তার পরের দিন আরম্ভ। কিন্তু রাত একটার পর সাধারণ মদ্যালয় বন্ধ। এরপর করা যায় কী? আমি বিশেষ করে তাদেরই কথা ভাবছি যাদের তখনও তেষ্টা মেটেনি– জর্মনদের বিশ্বাস তারা বিয়ার পান করে তৃষ্ণা নিবারণার্থে। সাধারণ মদ্যালয় যখন বন্ধ তখন খোলা রইল অসাধারণ মদ্যালয়। সেগুলো একটু ইয়ে অর্থাৎ বিশেষ শ্রেণির মহিলায় ভর্তি আর কি। তবে স্টুডেন্টরা দল বেঁধে যখন সেখানে ঢুকে আপন গালগল্পে মত্ত হয় তখন ওই পূর্বোক্ত ‘ইয়েরা’ ওদের জ্বালাতন দূরে থাক্ ডিস্টার্বও করে না। ওদের পকেটে আছেই-বা কী?

ইতোমধ্যে সেই যে আমাদের টেওডর যাকে নিয়ে কাহিনী পত্তন করেছি, তার হঠাৎ পুনরায় শোক উথলে উঠল ওই ডানৎসিগ নগরীর প্রখ্যাত স্বর্ণবারির জন্য। বার বার বলে, ‘দেখলে ব্যাটার কাণ্ডখানা! রাত একটা ত আমাদের বসিয়ে রাখলে একটা সুরালয়ে– যখন কি না প্রত্যেক বাপের প্রত্যেক সু-পুত্তরের কর্তব্য আপন আপন সুনির্মিত স্নেহময় নীড়ে ন্দ্রিাদেবীর শান্ত্যঞ্চলে আশ্রয় নেওয়া।’

কে একজন বললে, ‘এই খানিকক্ষণ আগেই না তুই-ই বললি, পেটারের বাড়িটা আসলে অ্যাডাম এবং ঈভ তৈরি করেছিলেন ঝুরঝুরে থুরথুরে?’

টেওডরের কিন্তু তখন কারও টিপ্পনিতে কান দেবার মতো মরজি নয়– সে তখন মৌজে। হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে, যেন এক নবীন রিলেটিভিটি আবিষ্কার করার উৎসাহ দেখিয়ে বললে, ‘আর পেটার ব্যাটা নিশ্চয়ই আরামসে ঘুমুচ্ছে। চল, ব্যাটাকে গিয়ে জাগানো যাক’।

এস্থলে কারও পক্ষে রণে ভঙ্গ দেওয়া জর্মন-স্টুডেন্ট-মনু-শাস্ত্রে গোমাংস ভক্ষণের চেয়েও গুরুতর পাপ। তুমি তা হলে আস্ত একটা কাপুরুষ। পুলিশকে– অর্থাৎ দুশমনকে– ডরাও। তোমার কলিজা বকরির, তোমার সিনা চিড়িয়ার। অতিষ্ঠ হয়ে আপনি শুধোবেন,’ রাত্রি একটাই হোক, আর তিনটেই হোক’ কেউ কাউকে জাগালে পুলিশের পূর্বতর অধস্তন চতুর্দশ পুরুষের কিবা ক্ষতিক্ষয়, জখম-লোকসান? এদেশে কি রেতে-বেরেতে টেলিগ্রাফ পিয়ন আসে না?’

দাঁড়াও পাঠকবর, জন্ম যদি বঙ্গে, তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এসব ক্রমশ প্রকাশ্য।

বলা বাহুল্য রাত তেরটার সময়– গ্রিনিজ যদিও সেটাকে দিবাভাগ বলেন– আপনি যদি বাড়ির, অবশ্য অন্য বাড়ির, দোস্ত দুশমন– যে-ই হোক কাউকে জাগাবার চেষ্টা করেন, তা সে সিমেন-হালেস্কে-শুকের্টের নব্যতম বিজলি-বেল বাজিয়েই হোক, আর পৌরাণিক যুগীয় ঘণ্টাকর্ণ কানে যে-ঘন্টা ঝুলিয়ে রাখত যাতে করে সে তার জন্মবৈরী শ্রীহরির নাম-কীর্তন শুনতে না পায়– সেই ঘন্টাটিই বাজান, বাড়িউলি দরজা খুলে শনির রাতে ওই জবাকুসুসমঞ্চাশ টেওডরের নয়নযুগল দেখতে পাবে আমরা আর-সবাই না হয় পাশের গলিতে গা-ঢাকা দিয়েই রইলুম– তখন তার কণ্ঠ থেকে– ভুল বললুম, নাভিকুণ্ডলী থেকে যেসব মুরজ মুরলীধ্বনি বেরুবে তার ঈষদাংশ শুনতে পেলে ওই যে খানিকক্ষণ আগে কী-সব ইয়েদের কথা বলছিলুম তারা পর্যন্ত নোকের সামনে নজ্জা পাবে। অতএব ওই কবোষ্ণ অন্ধকারে আমাদের কাছে জাজ্বল্যমান হল যে ফ্রন্টাল এটাকের স্ট্র্যাটেজি বিলকুল ঔট অব ডেট।

আমাদের হস্তে তৎসত্ত্বেও আশার একটি ক্ষীণ প্রদীপ মিদি মিদির করছে। পেটারের কামরাটা দোতলায়, এবং একদম রাস্তার উপরে। অতএব আমরা সেদিক বাগে যেতে যেতে হেথাহোথা ক্ষুদ্রাকারের নুড়ি, কাঁকর, সোডার ছিপি ইত্যাকার মারণাস্ত্র কুড়িয়ে নিয়ে সুসজ্জিত হয়ে পৌঁছলুম পেটারালয়ে– বঙ্কিম সঙ্কীর্ণ পথ দুর্গম নির্জন পেরিয়ে।

পেটার থাকে মাউস ফাডে (সার্থক নাম, বাবা, ‘ইঁদুরের পথ!’)

টেওডরই আমাদের হিন্ডেনবুর্গ বলুন, লুডেনড বলুন, আমাদের রাইষ মার্শাল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল, যদিও সে পেটারের ঘরে আসে সপ্তাহে নিদেন দশ দিন, তবু তার জানালা যে ঠিক কোনটা সেটা ঠাহর করতে পারছে না– আশা করি তার কারণ আর বুঝিয়ে বলতে হবে না। অবশেষে হানস্-ই লোকেট করলে জানালাটা। হানস্ বটনির ছাত্র– পেটারের জন্মদিনে তাকে একটা অঙ্গুষ্ঠ-পরিমাণ সাতিশয় বিরল ফণীমনসা উপহার দেয়। একটা জানালার বাইরের চৌকাঠ-পানা ফালি কাঠের উপর হানস্ সেটি আবিষ্কার করলে রাত্রের হিম খাওয়াবার জন্য পেটার সেটি ওই সিল না লেজ কী যেন বলে ইংরেজিতে– তারই উপর রেখে দিয়েছিল। কালিদাসের যুগে দ্বারে আঁকা থাকত ভিন্ন ভিন্ন চিহ্ন যেমন শঙ্খচক্র– হেথায় কেকটাস্।

পয়লা রৌন্ডে টেওডর ছুড়ে মারল সোডার ছিপি। লাগল গিয়ে ডান-পাশের জানালাটায়। আমরা ফিসফিস করে পেটারকে সাবধান করতে কসুর করিনি, কিন্তু কেবা শোনে কার কথা, সে তখন জাঁদরেল জনরৈল সিং, আমরা নিতান্ত ডালভাত দাবাখেলার বড়ে-পেয়াদা। দুসরা রৌন্ডে টেওডর বোধ হয় ফইর করেছিল একটা স্নো-কৌটোর ঢাকনা। এটা ধন্ন্ ন করে গিয়ে লাগল বাঁ-পাশের জানালাটায়। আমরা তাকে কিছু বলতে যেতেই সে ধমক দিয়ে বললে, ‘চোপ! এই হল আর্টিলারির আইন। প্রথম মারবে তাগের চেয়ে দূরে, তার পর তাগের চেয়ে কাছে, শেষটায় ম্যাথম্যাটিকলি মেজার করে ঠিক মধ্যিখানে। হবেও বা। ও তো প্রাশান য়ুংকার ঘরের ছেলে– জানার কথা। এবং আমাদের তুলনায় তার পকেট-শস্ত্রাগার পরিপূর্ণ। কারণ আমরা জর্মনির ধোপদুরস্ত রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছি কীই বা এমন কামান-ট্যাঙ্ক। পক্ষান্তরে যুযুধান টেওডর ঘিনপিৎ উপেক্ষা করে ‘পাবে’র সামনের ‘বিন’ থেকে মেলা অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে এনেছে। তাই এবারে ছুড়লে ছোট্ট একটি মার্কিং ইঙ্কের খালি শিশি। লাগল গিয়ে তেতলার একটা জানালায়, তখন বুঝতে পারলুম জনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে কেন জিততে পারেনি। দ্বিতীয়টা তখনও হয়নি! সে সময় হিটলার যদি আমাকে কসট করত তবে আমি নিশ্চয়ই তাকে বারণ করে দিতুম– বিশেষত এই অভিজ্ঞতার পর।

তার চেয়েও স্পষ্ট বুঝতে পারছি, টেওডর এখন যে অবস্থায় পৌচেছে সেখানে আপন নাক চুলকোতে চাইলে গুত্তা মারবে পিঠে। কিন্তু সে তত্ত্বটি তখন তাকে বলতে গেলে সেই সুপ্রাচীন জর্মন কাহিনীরই পুনরাবৃত্তি হবে মাত্র এক মাতাল রাত চৌদ্দটায় বাড়ি ভুল করে বারবার চেষ্টা করছে চাবি দিয়ে সদর দরজা খোলবার এবং সঙ্গে সঙ্গে কটুকাটব্য। সেই শব্দে শেষটায় দোতলায় একজনের ঘুম ভেঙে গেল। নিচের দিকে মাতালকে দেখে বললে, ‘হেই, তুমি ভুল বাড়ির তালা খোলবার চেষ্টা করছ’। মাতাল উপরের দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে বললে, ‘হে হে হে হে! তুমিই ভুল বাড়িতে ঘুমুচ্ছ।’

এই একতরফা লড়াই– আইনে যাকে বলে ইনআর সনশিয়া– কিংবা বলতে পারেন ড-কুইটের জলযন্ত্র আক্রমণ– আধঘন্টাটাক চলার পর টেওডর ছাড়লে–বলতে গেলে তার প্রায় শেষ সিকস পৌন্ডার– সার্ডিনমাছের খালি একটা টিন! ঝন ঝন করে শব্দ হল। কিন্তু পরে মনে হয়েছিল সে যেন ওস্তাদ এনায়েত খানের সেতার–কারণ সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু ছাপিয়ে কানে গেল পুলিশের ভারি ভারি বুটের শব্দ। এটা হল কী প্রকারে? সচরাচর শানবাঁধানো রাস্তার উপর রোদের পুলিশের বুটের শব্দ সেই নিঝুম নিশীথে অনেক দূরের থেকে শোনা যায়, এবং টেওডর ছাড়া আমাদের আর সক্কলের আধখানা কান খাড়া ছিল তারই আশঙ্কায়। অতএব দে ছুট, দে ছুট! কোন মূর্খ বলে যুদ্ধে পলায়ন কাপুরুষের কর্ম! ইংরেজ আফ্রিদিদের সঙ্গে যুদ্ধে পালালে পর এ দেশের জোয়ানদের বুঝিয়ে বলত, ‘এর নাম বাহাদুরিকে সাথ পিছে হঠনা!’

কিন্তু ছুটতে ছুটতে আমি শুধু ভাবছি, এতগুলো বুটের শব্দ একসঙ্গে হল কী করে, রোঁদে তো বেরোয় প্রতি মহল্লায় হার্টের, sorry, হার্টলেস সিংগলটন! তা সে যা-ই হোক, এখন তো প্রাণটা বাঁচাই।

পূর্বেই বলেছি, পেটারের গলিটার নাম মূষিকমার্গ। আসলে কিন্তু বন্ শহরের আঁকাবাঁকা হাঁসুলি বাঁকের মোড়, পায়ের বেঁকি-গয়নায় প্যাঁচ-খাওয়া আড়াই বিঘৎ চওড়া নিরানব্বইটি ‘রাস্তাকেই’ মূষিকমার্গ বলা যেতে পারে– তার জন্য কল্পনাশক্তিটিকে বহু সুদূরে সম্প্রসারিত করতে হয় না।

কিন্তু একটি তত্ত্ব সর্বজনবিদিত। এই গলিঘুচি, কোথায় যে হঠাৎ বেঁকে গেছে, কোথায় যে রাস্তার আশেপাশে বহু প্রাচীনকালেই পঞ্চত্বপ্রাপ্ত একটি কারখানার অন্ধকার অঙ্গনে অশরীরী হওয়া যায়, অর্থাৎ লুকানো যায় (হংসমিথুনের কথা অবশ্য আলাদা), কোথায় যে একটা গারাজের আংটাতে পা দিয়ে সামান্য তকলিফেই ছাতে ওঠা যায়, এসব তথ্য পুলিশ যতখানি জানে আমরা ঠিক ততখানিই জানি। এমনকি লেটেস্ট খবরও আমরা রাখি: অমুক দেউড়ির ঠিক সামনের রাস্তার বাতিটি বরবাদ হয়ে গিয়েছে, এখনও মেরামত হয়নি, কিংবা অমুক জায়গায় পরশুদিন থেকে এক ভঁইপিপে জুটেছে– পিছনে দিব্য অন্ধকার। অর্থাৎ পুলিশ তার আপন হাতের তেলো যতখানি চেনে, আমরাও আমাদের তেলো ততখানিই চিনি।

মূষিকমার্গ ধরে খানিকটে এগোলেই সেখানে তেরাস্তা। আমাদের স্ট্রাটেজি অতি সনাতন, সুপ্রাচীন। সঙ্গে সঙ্গে আমরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে দু দিকে ছুট লাগালাম। আবার তেরাস্তা পেলে আবার দু ভাগ হব। ধরা যদি পড়িই তবে দলসুদ্ধ ধরা পড়ব কেন? এবং যুদ্ধের নীতিও বটে, ‘আক্রমণের সময় দল বেঁধে; পলায়নে একলা-একলি।’ খুদে বন্ শহরে পুলিশ গিস গিস করে না– আর এই রাত চোদ্দটায় ফাঁড়ি-থানা ক’টাই-বা শেয়ার করতে পারে? কাজেই প্রতি তেরাস্তায় তারা যদি আমাদেরই স্ট্র্যাটেজি অনুসরণ করে তবে যাদের ‘মেন পাওয়ার’ কম বলে, কয়েকটা রাস্তা ফোলো অপ করতে পারবে না বলে শেষ পর্যন্ত হয়তো কেউই ধরা পড়বে না। কিন্তু এই ‘শুপো’ নন্দনগণ ঘড়েল। এবম্প্রকার বহু যুদ্ধে তারা জয়ী এবং পরাজয়ী হয়ে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে সেটা তাদের শেখায় অন্য স্ট্র্যাটেজি।

পাঠক, তুমি কখনও পোষা চিতাবাঘ দিয়ে হরিণ-শিকার দেখেছ? না দেখারই সম্ভাবনা বেশি, কারণ সেই রাজারাজড়াদের আমলেও এ খেলাটি অস্মদেশে ছিল বিরল। আমাকে। দেখিয়েছিলেন বরোদার বুড়ো মহারাজ।

মহারাজার খাস রিজার্ভ ফরেস্টে ছিল বিস্তর হরিণ, তাদের পিছনে লেলিয়ে দেওয়া হত একটা পোষা, ট্রেন চিতেবাঘ। বাঘ দেখা মাত্রই হরিণের পাল দে ছুট দে ছুট। এবং মাচাঙের উপর থেকে স্পষ্ট দেখতে পেলুম, একটা সুবিধা পাওয়া মাত্রই তারা দু ভাগ হয়ে গেল, তার পর আবার দু ভাগ, ফের দু ভাগ– করে করে হরিণের পাল আর পাল রইল না, হয়ে গেল চিত্তিরমিত্তির।

কিন্তু আমাদের নেকড়ে মহাশয়টিও অতিশয় সুবুদ্ধিমান। এভাগ ও ভাগকে খামোখা তাড়া করে সে বর্বরস্য শক্তিক্ষয় করল না। সে প্রথম থেকেই তাগ করে নিয়েছে একটা বিশেষ হরিণ। প্রতিবারে পাল যখন দু ভাগ হয়, তখন সে ওই বিশেষ হরিণটার ভাগেরই পিছন নেয়। পরে চিতার ট্রেনার আমাকে বলেছিল, ‘সবচেয়ে যে হরিণটা ধু’মসো, চিতে সবসময়ই একমাত্র ওইটের পিছু নেয়– এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে শক্তিক্ষয় করে না, কারণ চিতে জানে ওইটেই হাঁপিয়ে পড়বে সকলের পয়লা। ধরতে পারলে পারবে ওইটেকেই সব সময় যে পারে তা-ও নয়।’

বন শহরের শুপো সম্প্রদায় ঠিক তাই করলে। আমাদের মধ্যে যে দুটি ছিল সবচেয়ে হোঁৎকা, ওরা প্রতি দু ভাগ হওয়ার সময় ওদেরই পিছু নিল। শেষটায় ধরতে পেরেছিল অবশ্য একজনকে। সে কিন্তু টেওডর নয়, এবং জসট টু কিপ কম্পানি, ছুঁড়েছিল মাত্র নিতান্ত খুদে দু চারটি কাঁকর। তার কথাই আপনাদের খেদমতে ইতোপূর্ব পেশ করেছি।

আগের জমানায় পুলিশ তাকে দিয়ে দিত য়ুনিভার্সিটির হাতে– সে যেত য়ুনিভার্সিটির জেলে। শুনেছি, এস্তক স্বয়ং প্রিনস আউটো এডওয়ার্ড লেওপোল্ড ফন্ বিসমার্ক অবধি। গেছেন। এবং সে তখন জেলের দেওয়ালের উপর পেন্সিলযোগে আপন জিঘাংসা, কিংবা অনুশোচনা, কিংবা মধ্যিখানে, কিংবা কটুবাক্য– যথা যার অভিরুচি-–কভু গদ্যে কভু ছন্দে, সে-ও কী বিচিত্র, কখনও আলেকজেনড্রিয়ান, কখনও– সে কথা আরেকদিন না হয় হবে– লিখত : আমার আমলে আমাদের যেতে হত শহরের জেলে– একদিনের তরে (সে-ও এক মাসের ভিতর দিনটা বাছাই করে নেওয়া ‘আসামি’র এক্তেয়ারেই ছেড়ে দেওয়া হত, বাইরে থেকে আপন খানা আনানো যেত, এবং যেহেতু যেসব সহযুযুধানবর্গ সে যাত্রায় পালাতে। সক্ষম হয়েছিলেন, তাঁরা নেমকহারাম নন, তাঁরাই চাঁদা তুলে উত্তম লঞ্চ ডিনার বাইরে থেকে পাঠাতেন); কিংবা (ভারতীয় মুদ্রায়) সোয়া তিন টাকা জরিমানা দান– যথা অভিরুচি।

কিন্তু প্রশ্ন, এতগুলো পুলিশ সে রাত্রে হঠাৎ একজোট হল কী করে?

খাঁটি বন্ বাসিন্দারা আমাদের যুদ্ধে নিরপেক্ষ কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট কাঁকর বা সোডার ছিপি যদি তার জানালায় লেগে গিয়ে তার নিদ্রাভঙ্গ করে তবে সে জানালা খুলে কটুবাক্য আরম্ভ করার পূর্বেই আমরা অকুস্থল ত্যাগ করি। কেউ কেউ আবার হঠাৎ এক ঝটকায় জানালা খুলে আমাদের মাথার উপর ঢেলে দেয় এক জাগ হিমশীতল জল। আমরা অবশ্য এ-জাতীয় অহেতুক উদ্ৰবের জন্য সদাই সতর্ক থাকি।

কিন্তু আজ ছিল আমাদের পড়তা খারাপ। টেওডরের সক্কলের পয়লা বুলেট, বা সোডার ছিপি, যাই বলুন, পড়ে একদম পাশের ফ্ল্যাটে এক নবাগত বিদেশির জানালায়– কেন যে বিদেশিগুলো বন-শহরটাকে বিষাক্ত করার জন্য আসে, আল্লায় মালুম– সে কিন্তু জানত, বন্ শহরের খাস বাসিন্দারা এই (মোর দ্যান) হানড্রেড ইয়ার ওয়ারে ভদ্র সুইটজারল্যান্ডের মতো সেই যুদ্ধারম্ভের রাত্রি থেকেই নিরপেক্ষ জোর কটুকাটব্য (অর্থাৎ ডিপ্লোমাটিক প্রটেস্ট)। কিংবা এক জাগ জল। তা সে এমন কীই-বা অপকর্ম? ইউরোপীয়রা তো চান করে একমাত্র যখন জাহাজ-ডুবি হয়। জল ঢেলে সে তো পুণ্যসঞ্চয় করল, ডাক্তারদের শ্রদ্ধাভাজন হল। কিন্তু আজকের এই বিদেশি পাপিষ্ঠটা কটুবাক্য করেনি, জল ঢালেনি, করেছে কী, সে-ফ্ল্যাটে ফোন ছিল বলে চুপিসাড়ে ফাঁড়ি-থানাকে জানিয়ে দিয়েছে। ওদিকে আবার ইয়ার টেওডরের অগুনতি সখা এই শহরে। এবং বছর দুই ধরে সে প্রাগুক্ত পদ্ধতিতে শহরে এ-মহল্লায়, ও-মহল্লায় শনির রাতে– এবং সেটা যত গম্ভীর হয় ততই উমদা– আজ একে, পরের শনিতে অন্য কাউকে জাগাবার চেষ্টা করে যাচ্ছে। পুলিশ বিস্তর গবেষণার পর লক্ষ করল যে সর্বত্রই ওয়ার্কিং মেথড বা মডুস অপেরান্ডি হুবহু এক– বড় বড় ব্যাঙ্ক-ডাকাতরা যে রকম পুলিশের এই জাতীয় গভীর গবেষণার ফলেই শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে। তাই তারা সেই ডেঞ্জরস ক্রিমিনাল টেওডরের প্রতীক্ষাতেই ছিল।

আর আপনাদের সেবক এই অধম? সে কি কখনও ধরা পড়েছিল?

 

০৩.

 

অধীর পাঠক! শান্ত হও, তোমার মনে কী কুচিন্তা সে আমি জানি; ইতোমধ্যে ওই বাবদে দু খানা চিঠিও পেয়েছি, আমার কিন্তু কিন্তু ভাবটা যাচ্ছে না। আমি জানি, তোমার জ্ঞানতৃষ্ণা প্রবল, তাই জানতে চাও আমি কখনও ধরা পড়ে শ্রীঘরবাস করেছিলুম কি না। আমার সে দুরাবস্থার(৩) বর্ণনা শুনে তোমার হৃদয়মনে কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে সেই নিয়ে আমার দুর্ভাবনা। তা হলে একটি ছোট কাহিনী দিয়ে আমার সঙ্কোচটা বোঝাই।

মাত্র কয়েকদিন আগে, ১৬ অগ্রহায়ণ, আমরা স্বৰ্গত গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুদিন পালন করলুম। এঁর বহু বহু সদ্গুণ ছিল, তার অন্যতম, তিনি নিজে সাহিত্য নাট্য সৃষ্টি করুন আর না-ই করুন, সে যুগের সবাই মেনে নিয়েছিলেন যে তাঁর মতো শাস্ত্রজ্ঞ রসজ্ঞ জন বাংলা দেশে বিরল এবং সুদ্ধমাত্র রসজ্ঞ হিসেবে অদ্বিতীয়। তাই কাঁচা-পাকা সর্ব লেখকই তাঁকে তাদের বই পাঠিয়ে মতামত জানতে চাইতেন। ওদিকে গুরুদাস ছিলেন কর্মব্যস্ত পুরুষ। সেই উঁই আঁই বই পড়ে স্বহস্তে উত্তর লেখার তার সময় কই? তাই একখানা পোস্টকার্ডে যা ছাপিয়ে নিয়েছিলেন তার মোটামুটি মর্ম এই : ‘মহাশয়, আপনার পাঠানো পুস্তকের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই। আমি উহা মনোযোগ সহকারে পড়িয়াছি। সত্য বলিতে কি পড়িতে পড়িতে–’ এখানে এসে থাকত একটা লম্বা লাইন এবং তার উপরে ছাপা থাকত, হাস্য সম্বরণ করিতে পারি নাই এবং লাইনের নিচে ছাপা থাকত, ‘অশ্রু সম্বরণ করিতে পারি নাই।’ তিনি নাকি পাঠানো বইখানা পড়ে যথোপযুক্তভাবে হয় লাইনের উপরে হাস্য সম্বরণ বা নিচের ‘অশ্রু সম্বরণ’ কেটে দিতেন। তিনি ছিলেন অজাতশত্রু, তাই নিশ্চয়ই কোনও বদরসিক কাহিনীটির সঙ্গে আরও জুতে দিত যে, অধিকাংশ স্থলেই তিনি নিজে বইখানি পড়তেন না, তার সেক্রেটারি সেটি পড়ে বা না পড়ে উপরের হাস্য কিংবা নিচের ‘অশ্রু’ কেটে দিত।

তাই আমার কিন্তু-কিন্তু, তুমি লাইনের উপরের না নিচের, কোন বাক্যটি কাটবে– আমার কাহিনী শুনে। তা সে যাকগে, বলেই ফেলি। কোন দিন আবার দুম করে মরে যাব।

পূর্বেই নিবেদন করেছি, চিতেবাঘ হরিণের পালের গোদাটাকেই সবসময় ধরবার চেষ্টা করে। তারই পিছনে ধাওয়া করে যখন সব কটা এদিকে-ওদিকে ছড়িয়ে পড়ে– শহরের পুলিশও ঠিক সেই রকম আমাদের মতো ‘পিশাচ-সম্প্রদায়ে’র সবচেয়ে হোঁৎকাটাকেই ধরবার চেষ্টা করত, আমরা যখন তাড়া খেয়ে হরিণের টেকনিকই অনুসরণ করে ইদিকের-ওদিকের গলিতে ছড়িয়ে পড়তুম। কিন্তু কিছুদিন পরে আমরা লক্ষ করলুম, একই গোদাকে বারবার শিকার করে পুলিশ যেন আর খাঁটি স্পোর্টসম্যানের নির্দোষানন্দ লাভ করছে না। তখন তারা দুসরা কিংবা তেসরা মোটুকাটাকে ধরবার চেষ্টা করতে লাগল। তাদের ট্রেনিং হচ্ছে, আমোগোরও। কখনও তারা জেতে, কখনও আমরা জিতি। সেই যে গুলিশোর শিকারি বয়ান দিচ্ছিল, ‘তার পর আমি তো ফইর করলুম বন্দুক, আর কুত্তাকেও দিলুম শিকারের দিকে লেলিয়ে। তার পর বন্দুকের গুলি আর কুত্তাতে কী রেস্! কভি কুত্তা কভি গোলি, কভি গোলি কভি কুত্তা!’ আমাদের বেলাও তাই, ‘কভি ইসটুডেন্ট কভি পুলিশ, কভি পুলিশ কভি ইসটুডেন্ট!’ আমার অবশ্য কোনওই ডর ভয় ছিল না। কারণ আমি তখন এমনিতেই ছিলুম বেহ রোগা টিঙটিঙে পাঁচ ফুট সাড়ে ছ ইঞ্চি নিয়ে একশ’ পাঁচ পৌন্ড ওজন অর্থাৎ হোঁৎকা মোটকা জর্মন সহপাঠীদের তুলনায় তো আধটিপ নস্যি! তদুপরি আমি সর্বদাই সুনির্মল বসুর সেই তিরস্কারটি মনে রাখি, ‘বাঙালি হয়েছ, পালাতে শেখনি!’

কিন্তু বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, এই রাত্রে দেখি, পুলিশ অন্য ব্যবস্থা করেছে। এতদিন যেই আমি একা হয়ে যেতুম, পিছনে আর বুটের শব্দ শুনতে পেতুম না। সে রাত্রে দেখি, পুলিশ নিতান্ত আমাকেই ধরবার জন্য যে মনস্থির করেছে তাই নয়, আগের থেকে, বেশ সুচিন্তিত ফাইভ ইয়ারস প্ল্যানিং করে যেন জাল পেতেছে। আমি তাড়া খেয়ে যেদিকেই যাই, পিছনে তো বুটের শব্দ শুনতে পাই-ই, তদুপরি দেখি, ওই দূরে গলির মুখে আরেকটা পুলিশ দাঁড়িয়ে রয়েছে- যেন বিরহজর্জরিত ফিলমের নায়ক প্রোষিতভর্তৃকা নায়িকাকে আলিঙ্গনার্থে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু আমি মহাভারত পড়েছি, জানি, এ আলিঙ্গন হবে ধার্তরাষ্ট্র। অতএব মারি গুত্তা অন্য বাগে।

অনেকক্ষণ ধরে এই খেলা চলল। ইতোমধ্যে আমি কয়েক সেকেন্ডের তরে সব পুলিশের দৃষ্টির বাইরে; এবং সঙ্গে সঙ্গে ঢুকলুম একটা পাবে। ঝটকা মেরে বার থেকে অন্য কারও অর্ডারি এক কাপ কঞ্চি যেন ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে বসলুম, ‘পাব’-এর সুদূরতম প্রান্তে। সঙ্গে সঙ্গে ঢুকল একটা পুলিশ।

খাইছে। এবারে এসে পাকড়াবে। বৈদ্যরাজ চরক বলেন, ‘এ অবস্থায় হরিনামের বটিকা খেয়ে শুয়ে পড়বে!’

সে কিন্তু হাঁপাতে হাঁপাতে প্রথমটায় ‘বার’ কিপারের মুখোমুখি হয়ে আমার দিকে পিছন ফিরে এক গেলাস বিয়ার কিনে একটা অতি দীর্ঘ চুমুক দিলে। আমি বুঝলুম, মাইকেল সত্যই বলেছেন, সীতাদেবীকে রাবণের রাক্ষসী প্রহরিণীরা কোনও গাছতলায় বসিয়ে বেপরোয়া ঘোরাঘুরি করত।

‘হীনপ্রাণা হরিণীরে রাখিয়া বাঘিনী।

নির্ভয় হৃদয়ে যথা ফেরে দূর বনে’

 গদ্যময় ইংরেজিতে যাকে বলে নিতান্তই ‘ক্যাট অ্যান্ড মাউস প্লে’। বরঞ্চ রবীন্দ্রনাথেরটাই ভালো, ‘এ যেন পাখি লয়ে বিবিধ ছলে শিকারি বিড়ালের খেলা!’

এবারে সে গেলাস হাতে করে ‘বার’-এর দিকে পিছন ফিরে আমার দিকে মুখ করে তাকাল।

আমিও অলস কৌতূহলে একবার তার দিকে তাকালুম। ‘পাব’-এ নতুন নিরীহ খদ্দের ঢুকলে যেরকম অন্য নিরীহ খদ্দের তার ওপর একবার একটি নজর বুলিয়ে অন্যদিকে চোখ ফেরায়।

আমি যদিও তখন মাথা নিচু করে কাপের দিকে তাকিয়ে আছি– যেন মাইক্রোস্কোপ দিয়ে বৈজ্ঞানিক অণুপরমাণু পর্যবেক্ষণ করছেন– তবু স্পষ্ট বুঝতে পারলুম, লোকটা কী ভাবছে। তার পর শুনলুম, ‘গুটে নাখট’! আমি মাথা তুলে দেখি পুলিশ তার বিয়ার শেষ করে ‘পাব’ওয়ালাকে ‘গুডনাইট’ জানিয়ে চলে যাচ্ছে। (জর্মনির অলিখিত আইন, ‘বিয়ার খাবে ঢক ঢক করে, ওয়াইন খাবে আস্তে আস্তে!’)।

ঠিক বুঝতে পারলুম না কেন? তবু হাঁপ ছেড়ে বাঁচলুম বলিনি। এদের তো রাবণের গুষ্টি। এবার যিনি আসবেন, তিনি এঁয়ার মতো বাপের সুপুত্তুর না-ও হতে পারে। আবার বাইরে যাবারও উপায় নেই। জাল গুটিয়ে সবাই চলে গেছেন, না ঘাপটি মেরে বসে আছেন, কে জানে?

ঘণ্টাখানেক পর যখন ‘পাব’ নিতান্তই বন্ধ হয়ে গেল, তখন দেখি সব ফাঁকা। তবু সাবধানের মার নেই। অকুস্থলের উল্টো মুখে রওনা দিয়ে অনেকখানি চক্কর খেয়ে বাড়ি ফিরলুম ‘তড়পত হুঁ জৈসে জলবিন মীন হয়ে।’

***

তার দু-তিন দিন পর সকালবেলা যখন পাত্তাড়ি নিয়ে য়ুনি (ভার্সিটি) যাচ্ছি, তখন একজন পুলিশ হঠাৎ সামনে দাঁড়িয়ে বুটের গোড়ালি গোড়ালিতে ক্লিক করে আমাকে সেলুট দিলে। আমি হামেশাই পুলিশের সামনে ভারি সুবিনয়ী– বার তিনেক ‘গুটেন মর্গেন’ ‘গুটেন মর্গেন’ বললুম, যদ্যপি একবারই যথেষ্ট।

কোনও প্রকারে লৌকিকতা না করে সোজা শুধোলে, ‘তুমি ইন্ডিয়ান?’

তালেবর পুলিশ মানতে হবে! বলেছে ‘ইন্ডার’। ‘ইন্ডিয়ানার’ বা রেড ইন্ডিয়ান বলেনি। এদেশের অধিকাংশ শিক্ষিত লোকও সে পার্থক্যটি জানে না। বললুম, ‘হ্যাঁ।’–

শুধোলে, ‘এখান থেকে ইন্ডিয়া কতদূর?’

আমি বললুম, ‘এই হাজার পাঁচেক মাইল হবে। সঠিক জানিনে, তবে জাহাজে যেতে বারো-তেরো দিন লাগে।’

বললে, ‘বাপ-মা এই পাঁচ হাজার মাইল দূরে পাঠিয়েছে বাদরামি শেখবার জন্যে?’

এতক্ষণে আমার কানে জল গেল। বুঝলুম উইথ রেফারেন্স্ টু দি কনটেকসট যে, লোকটা সেই রাত্রের আমাদের দলের দুষ্কর্ম এবং পরবর্তী লুকোচুরির কথা পাড়ছে। আমি তবু নাক-টিপলে-দুধ-বেরোয়-না গোছ হয়ে বললুম, ‘কিসের বাঁদরামি?’

জৰ্মনে ‘ন্যাকা’ শব্দের ঠিক ঠিক প্রতিশব্দ নেই। কিন্তু যে কটি শব্দ পুলিশম্যান প্রয়োগ করলে তার অর্থ ওই দাঁড়ায়। তার পর নামল সম্মুখ সমরে! বললে, ‘সেরাত্রে কয়েক সেকেন্ডের জন্য চোখের আড়াল হয়ে যেতে পেরেছিলে বলে তোমাকে ধরিনি। এবার কিন্তু ছাড়ব না।’

‘অনেক ধন্যবাদ!’ তার পর আমিও রণাঙ্গনে নেমে বেহায়ার মতো বললুম, ‘সে দেখা যাবে।’

যেন একটু দরদী গলায় বললে, ‘কিন্তু কেন, কেন এসব কর?’।

আমি তখন একটু নরম গলায় বললুম, ‘এদেশে কি শুধু য়ুনিতে পড়তেই এসেছি? ওদেশে বসেও তো এ-দেশের বই কিনে পড়া যায়। আমি এসেছি সব শিখতে আর-সব স্টুডেন্টরা যা করে, তাই করি।’

‘সব ছেলে এরকম বাদরামি করে?’

আমাকে বাধ্য হয়ে স্বীকার করতে হল, সবাই করে না।

‘তবে?’

তখন বললুম, ‘ব্রাদার শোনো। এই স্টুডেন্ট বনাম পুলিশ লড়াই সর্বপ্রথম আরম্ভ হয় চতুর্দশ শতাব্দীতে হাইডেলবের্গে। এখানে আরম্ভ হয় ১৭৮৬-তে। তার পর কয়েক বছর মুনি বন্ধ ছিল– কেন, সঠিক জানিনে, বোধ হয় নেপোলিয়ন তার জন্য দায়ী– ফের য়ুনি খোলার সঙ্গে সঙ্গে ১৮১৮ থেকে। এবারে তুমিই কও, বুকে হাত দিয়ে এই আমরা আজ যারা স্টুডেন্ট, আমরা যদি আজ লড়াই ক্ষান্ত দিই তবে ভবিষ্যৎ-বংশীয় স্টুডেন্টরা ইতিহাসে লিখে রাখবে না—‘অতঃপর বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে একদল কাপুরুষ ছাত্র আগমনের ফলে তাহাদের মধ্যে একটা অপদার্থ ইন্ডিয়ানও ছিল সেই সংগ্রাম বন্ধ হইয়া যায় স্টুডেন্টরা পরাজয় স্বীকার করিয়া লইল।’ তার পর ভারতীয় নাটকীয় পদ্ধতিতে ‘হা হতোস্মি করার পর বললুম, ‘এই যে মহাকবি হাইনে, তিনি পর্যন্ত এখানে–’।

এই করলুম ব্যাকরণে ভুল। বাধা দিয়ে শুধোলে, ‘তুমি তার মতো কবিতা লিখতে পারো?’

 নিশারণে সে জিতেছিল না আমি জিতেছিলুম, সেটা সমস্যাময়, সেটাকে ‘ড্র’ বললেও বলা যেতে পারে, কিন্তু দিবাভাগে এই তর্ক-যুদ্ধে আমি হার মেনে বললুম, ‘বাকিটা আর একদিন হবে, ব্রাদার। এখন তোমার নামটা বলো। সেই শনির রাত্রে যেখানে আমাদের প্রথম চারি চক্ষুর মিলন হয়েছিল সেখানেই দেখা হবে। আমি ফোন করে ঠিক করে নেব। এখন চলি, আমার ক্লাস আছে।’

সে হেসে যা বললে, সেটাকে বাংলায় বলা চলে, ‘ডুডু খাবে টামাকও ছাড়বে না। ’

***

এবারে ধরতে পারলে ছাড়বে না– সে তো বুঝলুম। ওদিকে এক মাস পরে আমার পরীক্ষা। তিনটে ভাইভা। শনির রাত জেগে তামাম রোববার শুধু মুখস্থ আর মুখস্থ। হাসি পায় যখন এদেশে শুনি, এখানে বড্ড বেশি মুখস্থ করানো হয়, মুখস্থ না করে কে কবে কোন দেশে কোন পরীক্ষা পাশ করেছে! তা সে পেসতালজির দেশেই হোক আর ফ্রোবেলের দেশ, এই জৰ্মনিতেই হোক। তাই আমাকে আর যুদ্ধে না ডেকে আমাদের ফিলড মার্শেল আমাকে রিজার্ভে রাখতেন। মাত্র এক রাত্রে ডাক পড়েছিল, তবে সেটা শহরের অন্য প্রান্তে। আর একদিন, সেই দৈত্যকুলের ‘প্রহ্লাদ-পো’টির সঙ্গে একটা ‘পাব’-এ বসে দু-দণ্ড রসালাপ করেছিলুম, লোকটি সত্যই অমায়িক।

***

এদেশে পরীক্ষার পূর্বে এত সাতান্ন রকমের কাগজপত্র মায় থিসিস্ ডিনের দফতরে জমা দিতে হয় যে, সবাই শরণ নেয় আনকোরা হালের যে দু দিন আগে পাশ বা ফেল করেছে, তারাই শুধু এসব হাবিজাবির লেটেস্ট খবর রাখে। সেরকম দু জনা অনেকক্ষণ ধরে বসে, দফে দফে একাধিক বার মিলিয়ে নিয়ে এক বান্ডিল কাগজ, ফর্ম, সার্টিফিকেট আমাকে দিয়ে বললে, এইবারে যাও বত্স, ডিনের দফতরে। সব মিলিয়ে দিয়েছি। আর, শোন, সব কাগজের নিচে রাখবে একখানা পাঁচ মার্কের (তখনকার কালে পাঁচ টাকার একটু কম) নোট। এটা কেরানির অন্যায্য প্রাপ্য– কিন্তু পূর্ণ শত বৎসরের ঐতিহ্য।

দুরু দুরু বুকে– প্রায় নার্ভাস ব্রেকডাউনের সীমান্তে পৌঁছে– দাঁড়ালুম গিয়ে ডিনের দতরে, কাউন্টারের সামনে। পাঁচ টাকার চেয়ে বেশিই রেখেছিলুম।

যে কেরানি এসে সম্মুখে দাঁড়ালেন তাঁর অ্যাব্বড়া হিন্ডেনবুর্গি গোঁফ, আর বয়েসে বোধ হয় তিনি মুনির সমান। সাতিশয় গম্ভীর কণ্ঠে আমার গুডমর্নিঙের কী একটা বিড়বিড় করে উত্তর দিয়ে দফে দফে কাগজ গুনলেন, টাকাটা কি কায়দায় যে সরালেন ঠিক ঠাহর করতে পারলুম না। কিন্তু মুখে হাসি ফুটল না। বরঞ্চ গম্ভীর কণ্ঠ গম্ভীরতর করে শুধোলেন, ‘অমুক সার্টিফিকেটটা কই?’

আমি তো সেই দুই যোগানদারদের ওপর রেগে টঙ। পই পই করে আমি শুধিয়েছি, ওরা আরও পই পই করে বলেছে, সব কাগজ ঠিকঠাক আছে, এখন এ কী গেরো রে বাবা! বুঝলুম, কী একটা সার্টিফিকেট আনা হয়নি। কিন্তু সে সার্টিফিকেট কিসের, কোনওই অনুমান করতে পারলুম না। যোগানদারদের মুখেও শুনিনি।

ভয়ে ভয়ে শুধালুম, ‘কী বললেন স্যর!’

এবার যেন নাভিকুণ্ডলী থেকে ফৈয়াজখানি কণ্ঠে কী একটা বেরুল।

 গুরু-মুর্শিদ, ওস্তাদ-মুরুব্বিদের আশীর্বাদ-দোওয়া আমার ওপর নিশ্চয়ই ছিল; হঠাৎ অর্থটা মাথার ভেতরে যেন বিদ্যুতের মতো ঝিলিক মেরে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে আপন অজান্তে একগাল হেসে বলে ফেলেছি, ‘চেষ্টা তো দিয়েছি, স্যার, দু বচ্ছর ধরে প্রায় প্রতি শনির রাত্রে মাফ করবেন স্যার বলা উচিত রবির ভোরে। তা ওরা ধরতে না পারলে আমি কী করব?–বললে পেত্যয় যাবেন না স্যার–’।

ইতোমধ্যে বুড়ো হঠাৎ ঠাঠা করে হেসে উঠেছেন। যেমন তার গাম্ভীর্য তেমন তার হাসি। বিশেষ করে তার বিরাট গোপজোড়ার একটা দিক নেমে যায় নিচে, তো অন্যটা উঠে যায় উপরের দিকে। সে হাসি আর থামে না। ইতোমধ্যে ছোকরা কেরানিরাও হাসির রগড় দেখে তার চতুর্দিকে এসে দাঁড়িয়েছে। এবারে থেমে বললেন, ‘ধরা দেবার চেষ্টা করলে, আর ওরা ধরতে পারল না, এটা কী রকম কথা?’

আমি বললুম, ‘যে-পুলিশ আরেকটু হলে ধরতে পারত, তাকে সাক্ষী স্বরূপ হাজির করতে পারি যে, আমি চেষ্টার ত্রুটি করিনি, এই জেলে যাবার সার্টিফিকেট যোগাড় করার।’

সংক্ষেপে বললেন, ‘খুলে কও।’

আমি সেই প্রকৃতির লোক যারা নার্ভাস ব্রেকডাউনের ভাঙন থেকে পড়ি-পড়ি করতে করতে বেঁচে গিয়ে হঠাৎ নিষ্কৃতি পেয়ে হয়ে যায় অহেতুক বাঁচাল।

সে-ও আরেক রকমের নার্ভাসনেস্। গড় গড় করে বলে গেলুম, পুলিশের সেই জাল পাতার কাহিনী বিশেষ করে আমার উপকারার্থে—‘পাব’-এর ভিতরকার বয়ান ও সর্বশেষে সেই পুলিশম্যানের সঙ্গে পথিমধ্যে আমার যম-নচিকেতা কথোপকথন। বক্তৃতা শেষ করলুম, দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে, ‘এরপর এই পরীক্ষায় পড়া নিয়ে বড় ব্যস্ত ছিলুম বলে সলিড কিছু করে উঠতে পারিনি, স্যার। শুধু ওই যে, দিন পনেরো আগে হঠাৎ এক সকালে দেখা গেল লর্ড মেয়ারের বিরাট দফতরের উচ্চতম টাওয়ারে একটা ছেঁড়া ছাতা বাঁধা, বাতাসে পৎপৎ করছে, ফায়ার ব্রিগেড পর্যন্ত নামাতে পারেনি, ওই উপলক্ষে অধীন কিঞ্চিৎ, অতি যৎকিঞ্চিৎ সাহায্য করতে—’

একজন ছোকরা কেরানি আঁতকে উঠে বললে, ‘সর্বনাশ! ওটার তালাশি যে এখনও শেষ হয়নি!’

বুড়ো বললেন, ‘আমরা তো কিছু শুনছি না।’

বুড়োর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরুতে গেলে তিনি কাউন্টারের ফ্ল্যাপটা তুলে আমার সঙ্গে দোর পর্যন্ত এলেন– পরে শুনলুম, এ-রকম বিরল সম্মান ইতোপূর্বে নাকি মাত্র দু-একজন বিদেশিই পেয়েছেন। আমি কিছু শুধাবার পূর্বেই তিনি যেন বুঝতে পেরে তাঁর মাথাটি আমার কানের কাছে নিচু করে, এবং সঙ্গে সঙ্গে বুড়ো আঙুলের ডগা বুকে ঠুকে ঠুকে ফিসফিস করে বললেন, ‘আমি তিনবার, আমি তিনবার!’ তার পর অত্যন্ত সিরিয়াসলি শুধোলেন ‘বছর তিনেক পূর্বে এক ডাচ স্টুডেন্ট বললে বুঝতেই পারছ, এ রসিকতাটা আমি শুধু বিদেশি ছাত্রদের সঙ্গেই করে থাকি, সুন্ধুমাত্র জানবার জন্য, তারা কতখানি সত্যকার জর্মন ঐতিহ্যের যুনি ছাত্র হতে পেরেছে। স্টুডেন্টরা নাকি ক্রমেই হারছে!’ কণ্ঠে রীতিমতো আশঙ্কার উৎপীড়ন।

আমি তাঁর প্রসারিত হাত ধরে হ্যান্ডশেক করতে করতে বললুম, ‘তিন বছর পূর্বে, ইয়া। কিন্তু তার পর জানেন তো, আমি আর আপনার মতো মুরুব্বিকে কী বলব, কৃষ্ণতম মেঘেরও রুপালি সীমান্তরেখা থাকে– এল জর্মনিতে অভূতপূর্ব বিরাট বেকার সমস্যা, যেটা এখনও চলছে। ফলে ছেলেরা ম্যাট্রিক পাস করে এদিকে-ওদিকে কাজে ঢুকতে না পেরে বাধ্য হয়ে ঢুকছে য়ুনিতে, আগে যেখানে ঢুকত একজন, এখন ঢেকে দশজন। ওদিকে সরকারের পয়সার অভাবে পুলিশের গুষ্টি না বেড়ে বরঞ্চ কমতির দিকে। আমরা এখন দলে ভারি, বস্তুত আমরা এখন নিশাচরবৃত্তি পরিত্যাগ পূর্বক দিবাভাগেই তাদের সম্মুখসমরে আহ্বান করতে পারি– করি না, শুধু শতাধিক বত্সরের ঐতিহ্য ভঙ্গ হবে বলে।’ তার পর একটু থেমে গম্ভীরতম কণ্ঠে বললুম, আর যদি কখনও সে দুর্দিনের চিহ্ন দেখি, তবে সেই সুদূর ভারত থেকে ফিরে আসব আ-মি। সামনের পরীক্ষায় পাশ করি আর ফেলই মারি, সেই পরাজয় প্রতিরোধ করার জন্য য়ুনিতে ঢুকে ছাত্র হব আবার-আ-মি।

‘আম্মো’।

৫১৫ পঠিত ... ১৬:৫১, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২৩

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি


Top