তৃতীয় পর্ব
যে ছেলেটি স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে মুখচোরা ছিলো; মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে লজ্জা বোধ করতো; ইন্টারনেট আসার পর বেশি বয়সে তার যৌবন (লেট ইয়ুথ) এসে যায়; এই যৌবন জ্বালায় সে সোশ্যাল মিডিয়ায় মেয়েদের পোস্টে গিয়ে গালিগালাজ শুরু করে।
যত্রতত্র খানকি, বেশ্যা, মাগী এসব গালাগাল করে ফেসবুকের হিরো হীরালাল হয়ে পড়ে। গালিতে এই দক্ষতার কারণে সিপি গ্যাং-এ একটা চাকরিও জুটে যায়। গালিগালাজ সম্বলিত পোস্টের জন্য তিনশো টাকা আর মন্তব্যে গালির জন্য একশো টাকা। গালিতে দক্ষ লোক খুঁজতে প্রকাশ্যে টাকার লোভ দেখিয়ে কর্মী সংগ্রহ করতে আমরা দেখেছি।
এইসব গালিগালাজ দেখে ধারণা করা যায়, এদের নিজেদের পরিবারে নারীর মর্যাদা ছিলো না। নারীকে এভাবে গালি দেয়া হতো। ফলে শৈশব থেকে এসব গালাগাল ডাল-ভাত তাদের কাছে।
ফেসবুকে মেয়েদের গালাগাল করে যারা; তাদের বেশিরভাগেরই জীবনে ব্যর্থ প্রেমের ইতিহাস থাকে। অনেক কষ্টে ক্লাসের কবি বাতেনকে দিয়ে একখানা প্রেম পত্র লিখিয়ে আকলিমাকে দেবার পর সে মুখ ঝামটা দিয়ে প্রত্যাখ্যান করেছিলো। পরে বাতেনের সঙ্গে আকলিমার প্রেম হয়ে গেলে; ইউনিভার্সিটি লাইফে পথিকৃত বাতেন ও আকলিমা নদী হিসেবে তারা কালচারাল উইং-এ পরিণত হয়। কালক্রমে বাতেন ও আকলিমা সেই প্রেমে ব্যর্থ বন্ধুকে দিয়ে "আমাদের লোক নয়" এমন নারী ও পুরুষকে ফেসবুকে গালি দিয়ে পুলক অনুভব করতে থাকে।
একটি মেয়ে ফেসবুকে ছবি দেয়া মাত্র শরিয়ত তাকে গিয়ে পর্দা-পুসিদা সহকারে চলতে বলে। নারী পোশাক নিয়ে পুরুষ মানুষের এরকম আগ্রহ দেখে মনে হয়, ঐ পুরুষের একটি নারীমন রয়েছে অথবা হরমোনাল ইমব্যালান্স রয়েছে; নইলে পুরুষ মানুষ কেন নারীর ইচ্ছার স্বাধীনতা পোশাক নির্বাচন বিষয়ে কথা বলবে। শিবব্রত অবশ্য তারিয়ে তারিয়ে নারী সৌন্দর্য্য উপভোগ করে লিখে দেয়, অপূর্ব দেহবল্লরী। মেয়েটি এতে মুগ্ধ হয়ে শিবুদার কাছে মোদি প্রগতিশীলতার দীক্ষা নেয়। মেয়েটি শিবুদার কাছ থেকে শিখে ফেলে মুমিন, মোসলমান, বাঙ্গু মুসলিম, জঙ্গি এসব শব্দ ঘন ঘন ব্যবহার করলে এক্কেবারে পরীক্ষিত পোগোতিচিল হওয়া যায়। তাতে ক্ষেপে গিয়ে শরিয়ত ভাই তার গালির ঝাঁপি খুলে বসে। কারণ শরিয়ত ভাইয়ের ধর্মের অনুভূতি প্রবল। সে শিবব্রতের মতো প্রবল ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে মুখে সেকুলারিজমের নাটকটা একেবারেই শিখতে পারে না।
শরিয়ত ভাই যেটা বুঝতে চায় না, তা হলো আরব বিশ্বের মোমেরও পুতুল মোমের দেশের মেয়েরা কক্ষণো ইসলাম কেন কোন ধর্মকে কটাক্ষ করে কথা বলে না। ইউরোপের মেমেরও পুতুল মেমের দেশের মেয়েদের মুমিন, মোসলমান, বাঙ্গু মুসলিম, জঙ্গি শব্দ বলে প্রগতিশীল সাজতে হয় না। সেইখানে কোন দু'চারটা নতুন স্মার্ট মেয়ে মোদি প্রগতিশীলতায় দীক্ষা নিয়ে মুসলমানদের নিয়ে আজে বাজে কথা বলছে তাতে কি এসে যায়।
১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর থেকে কিছু কুঁচকুঁচানি হিন্দু বৃটিশ প্রভুদের আশীর্বাদ পেতে নবাবী, মুঘল ও সুলতানী আমলের শাসকদের গালাগালি করতে করতে একসময় ডিএনএ-তে মুসলমানদের গালি দেবার চল এসে যায়। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য তাই ইগনোর করতে হবে এসব উস্কানি।
হিন্দুদের মাঝেই দেখবেন ইতিহাসবিদ ও পণ্ডিতেরা মুসলিম শাসক ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুত্ববাদী প্রচারণার মুখোশ উন্মোচন করেছেন। বুদ্ধিবৃত্তিক সততা রয়েছে বলে ভারতে মুসলিম নির্যাতনের প্রেক্ষিতে হিন্দু কৃতি মানুষেরা জাতীয় পুরস্কার জমা দিয়েছেন। কাজেই বাংলাদেশ প্রেক্ষিতে যে কোন রকমের হিন্দু নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো মুসলমানের কর্তব্য।
একজন বৃদ্ধ নাপিত মহানবীকে নিয়ে অশালীন কথা বললে মহানবীর সুকৃতিতে কোন মালিন্য আসে না। কারণ গোটা পৃথিবীতে তিনি একজন নন্দিত ব্যক্তিত্ব। বরং মহানবীর সম্মান রক্ষার কথা বলে, নাপিতকে প্রহার করলে; তা হয় ইসলামের শিক্ষা থেকে দূরে সরে আসা। পৃথিবীর ইতিহাসে মদিনা সনদ একটি দৃষ্টান্তমূলক শিক্ষা; যেখানে মুসলমান-ইহুদি ও খৃস্টানদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করা হয়েছিলো।
ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি ও গালাগালির চর্চাটা মুসলিম বিশ্বে নেই। দক্ষিণ এশিয়াতে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি ও গালাগালিটা বেশি। কলকাতার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের মুসলমানদের গালি দেয়ার কালচার থেকে শেখার কিছু নেই। বাংলাদেশে যেন হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃস্টান ও অন্যান্য বিশ্বাসের মানুষের কোন অসম্মান না হয়; সেদিকে লক্ষ্য রাখা প্রতিটি মুসলমানের কর্তব্য।
ইসলাম ধর্ম, মহানবী আকাশের মতো বিস্তৃত বিষয়; তাই ইসলাম কিংবা মহানবীর সম্মান রক্ষার অজুহাতে দলপাকিয়ে হুজ্জোতি করা অনেকটা চড়ুই পাখির পা দু'খানা ওপরে তুলে আকাশ ভেঙ্গে পড়া ঠেকানো কল্পনা করার মতো।
ইসলাম ধর্মের উতপত্তি যেখানে, সেখানে ধর্ম পালন অত্যন্ত সহজ। ইসলাম থেকে সততার শিক্ষা নেয় মানুষ। সে যে নামাজ ও রোজা করে; এগুলো করে নীরবে। শবে বরাতে সেখানে কোন জাকজমক থাকে না। ধর্ম প্রদর্শনের রোগটা দক্ষিণ এশিয়ার। ধর্ম নিয়ে জাকজমকের ব্যাপারটা দক্ষিণ এশীয় ট্রাইবাল কালচার। ইসলাম আন্তর্জাতিক ধর্ম। আন্তর্জাতিকতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এসব আঞ্চলিক ধর্ম প্রদর্শনের বাতিক থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
হিন্দুদের দেব-দেবী নিয়ে কোন রকম অশালীন শব্দ ব্যবহার ইসলামের শিক্ষার পরিপন্থী। আর এই বোধ কমনসেন্সের অংশ। বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মের অভিভাবক যেহেতু ভারত রাষ্ট্র; সে সারাক্ষণ বসে আছে হিন্দু নির্যাতনের ছবি ও ভিডিও সংগ্রহের জন্য। ভারত নিজে অসংখ্য মসজিদ ভেঙ্গেছে; মুঘল স্থাপনা ভেঙ্গেছে; বুলডোজার দিয়ে মুসলমানদের বাড়ি গুড়িয়ে দিয়েছে; ফ্রিজে গো-মাংস থাকার জন্য মুসলমানদের হত্যা করেছে, মুসলিম নারীর সম্ভ্রমহানি করেছে, গুজরাটে মুসলিম গণহত্যা করেছে, কাশ্মীরকে জীবন্ত কারাগার বানিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে খিলক্ষেতের সরকারি জমিতে অস্থায়ী পূজা মণ্ডপকে অবৈধভাবে মন্দিরে রুপান্তরে বাধা দেয়ায় বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার চেয়েও বড় ঘটনা হিসেবে চিত্রিত করেছে। অখণ্ড ভারতে বিশ্বাসী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষিতরা 'প্রতিমা কেন যথাযোগ্য মর্যাদায় বিসর্জন দেয়া হলো না' এই প্রশ্ন তুলে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের কান্না জুড়েছে। এইটা দক্ষিণ এশিয়ার ধর্মীয় অনুভূতির প্যাটার্ন। মুসলমানেরা কথায় কথায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের কান্না জুড়ে দিলে বোঝা যায়; হিন্দু ধর্মের অতি স্পর্শকাতরতার আদলেই এখানে ইসলাম ধর্মের অতি স্পর্শকাতরতার রোগ তৈরি হয়েছে। নইলে মুসলিম বিশ্বের অন্য কোথায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের ধুপ্পু তুলে নৈরাজ্যের ঘটনা ঘটে না কেন!
(চলবে)
পাঠকের মন্তব্য