চলিষ্ণুগালিকল্পদ্রুম (চতুর্থ পর্ব)

২৭ পঠিত ... ১৮:০৯, জুলাই ০২, ২০২৫

চতুর্থ পর্ব 

একজন মানুষ যখন আঞ্চলিক ভাষায় নিজ এলাকায় বন্ধুদের মাঝে গালি দিয়ে কথা বলে; তখন তার গ্রামীণ পরিবেশ, পোশাকের সঙ্গে মানিয়ে গিয়ে তা রসসঞ্চার করে।  গ্রামের মানুষের বোধ রয়েছে, মুরুব্বি-নারী ও শিশুদের সামনে ওসব শব্দ ব্যবহার করা যায় না; যা তারা বন্ধুদের আড্ডায় ব্যবহার করে।

কিন্তু একজন মানুষ শার্ট-প্যান্ট পরে যখন নাগরিক পরিবেশে ও সোশ্যাল মিডিয়ায় একই গালি দেয়; তখন তা ভীষণ অশ্লীল শোনায়। আমরা যে বাংলাদেশে বেড়ে উঠেছি, সেখানে শার্ট প্যান্ট পরা লোক অশালীন গালি দেওয়ার প্রচলণ ছিল না।

এরশাদ বিরোধী আন্দোলনকে উপজীব্য করে আওয়ামী লীগ ও কালচারাল উইং নাগরিক জনপরিসরে গালাগালির কালচার নিয়ে আসে। আর এটাকেই হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি বলে প্রচারণা চালায়।

পুরান ঢাকাতে প্রচলিত যে নাগরিক গালাগাল; সেগুলো কাউকে অপমান করার জন্য ব্যবহৃত হয় না। বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে রস বিনিময়ের শব্দ ওগুলো। কিন্তু মুরুব্বি-নারী ও শিশুদের সামনে ওসব শব্দ তারা ব্যবহার করে না।

কাউকে নাগরিক পরিসরে অপমান করতে গালির প্রচলন করে আওয়ামী লীগ তার কালচারাল উইং-এর মাধ্যমে। আমরা দেখেছি, কতগুলো উসকো খুশকো চুল-গাল ভাঙ্গা-শার্টে চিতে পরা ছেলে খুব আয়েশ করে টিএসসিতে বসে গালি দিচ্ছে। এসব গালির মাধ্যমে তারা একটি কতৃত্ব দেখাতে চেষ্টা করছে। আমরা নব্বুই-এর দশকে বিতর্ক আন্দোলনের মাধ্যমে গালাগালিহীন যৌক্তিক সমাজ বিনির্মাণের আপ্রাণ চেষ্টা করে বেশ কিছুটা সফলও হয়েছিলাম। সমাজের আগের মূল্যবোধ আর বিতর্ক আন্দোলনের মাঝ দিয়ে ২০০৮ সাল পর্যন্ত মোটামুটি একটি পরিচ্ছন্ন সামাজিক পরিবেশ নির্মাণ করা গিয়েছিলো।

কিন্তু খোদ আওয়ামী লীগের যারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিতর্কের সংস্কৃতিতে আকৃষ্ট হয়েছিলো; টিএসসির গালিবাজদের পাশ কাটিয়ে বিতর্কের আসরে এসে বসে মন দিয়ে বিতর্ক দেখতো; তাদের পাশ কাটিয়ে সম্পূর্ণ হাইব্রিড আওয়ামী লীগের আত্মপ্রকাশ ঘটলো ফেসবুকে। ২০০৯ সাল থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নাম করে সিপি গ্যাং চ-বর্গীয় শব্দের মেলা বসালো জনপরিসরে। অথচ মুক্তিযুদ্ধ-স্বদেশ চেতনা বিতর্ক আন্দোলনের সর্বাঙ্গ জুড়ে ছিলো। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দখল নিয়ে নিলো সিপি গ্যাং।

যারা পরিচ্ছন্ন শব্দ ব্যবহার করে যৌক্তিক আলোচনা করে, মনোযোগ দিয়ে পড়ালেখা করে জীবনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে; স্বোপার্জিত জীবন ও জীবিকার শক্তি যাদের রয়েছে; তারা হাসিনার ফ্যাসিজমের বিকাশ নিয়ে প্রশ্ন তুললে; সিপি গ্যাং লেলিয়ে দিতে শুরু করে কালচারাল উইং। তখনো কালচারাল উইং চ-বর্গীয় শব্দ উচ্চারণে কিছুটা লজ্জা পেতো; তাই সিপি গ্যাং-এর চ-কর্মী ভাড়া করতো ভিন্নমত পোষণকারীদের ফেসবুক পোস্টে গিয়ে চ-বর্গের মল ঢেলে দিয়ে আসতে। পরে কাজ হয়ে গেলে, কালচারাল মামা ও খালারা সিপি গ্যাং কর্মীদের মুখে পেস্ট্রি তুলে খাওয়াতো। সেসব ছবিও এসে পড়ত ফেসবুকে।

এইসময় যে তরুণ-তরুণীরা বড় হচ্ছিলো, তারা সিপি গ্যাং স্টাইলের ভাষারীতি শিখতে শুরু করলো। যেহেতু বাসায় তেমন গাইডেন্স নেই; বাবা-মায়ের মূল্যবোধ তাদের কাছে আউটডেটেড মনে হয়; তাই তারা শিখলো চ-বর্গীয় গালি দেয়াই স্মার্টনেস ও সেকুলারিজম।

যেহেতু হিন্দুত্ববাদী ভারতের প্রত্যক্ষ সমর্থনে হাসিনার ফ্যাসিজমের ঈগল ডানা মেলছিলো; ফলে বিজেপির গালাগালের অভিধান থেকে শব্দ এসে আওয়ামী লীগের গালাগালের অভিধানকে আরো পুঁতিগন্ধময় করে তুললো।

যেহেতু সাম্যবাদী চিন্তার মানুষেরা সতত সংগ্রামশীল; তাই তাদের মধ্যে যারা বিজেপি ও লীগের বশ্যতা স্বীকার না করে; ইসলামোফোবিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুললো; অমনি "বামাতি" বলে তকমা দিয়ে তাদের ওপর শুরু হলো সিপি গ্যাং-এর হানা।

ইন্টারনেটে যেহেতু প্রতিটি কুকর্মের চিহ্ন রয়ে যায়; ফলে আমরা দেখলাম; কীভাবে হিন্দুত্ববাদী আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে দূষিত করতে শুরু করলো। সেই দূষণ এতটাই ছড়ালো যে, সব মত ও পথের তরুণ-তরুণীদের মাঝে গালাগাল ব্যাপারটা ডালভাত হয়ে গেলো।

ব্যাপারটা কীভাবে ঘটলো, তা জুলাই বিপ্লবের এক বছর পূর্তির লগ্নে ১ জুলাই থেকেই দেখতে পাচ্ছেন আপনারা। জুলাই সিডি আই বলে লীগ যে চ বর্গীয় ক্যাম্পেইন চালু করেছে; এটাই তাদের সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়। তারা উস্কানি দিচ্ছে গালির নর্দমায় নামতে। কিন্তু এতে বিক্ষুব্ধ হয়ে জুলাই বিপ্লবী তরুণ-তরুণীরা একই রকম শব্দ ব্যবহার করলে এতে কিন্তু আওয়ামী লীগই জিতে চায়। পরাজিত এই দলটির একান্ত চাওয়া বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে আওয়ামী নর্দমায় নামানো। শেয়ালের লেজ কাটা পড়লে, সে যেমন সব শেয়ালের লেজ কাটাতে চায়; আওয়ামী লীগ তেমনি তার আবাল্যের চর্চার চ-বর্গ কালচার জনপ্রিয় করতে চায় জনারণ্যে।

পনেরো বছর দুর্নীতির টাকায় চেহারা বার্ণিশ করে, হাতে রোলেক্স ঘড়ি পরে, প্রাডো হাঁকিয়ে, নক্সী পাঞ্জাবি পরে কথায় কথায় জন্মদিনের কেক কেটে একটু চেকনাই এসেছিলো যাদের; মাত্র এগারো মাসে দেখুন; তাদের অরিজিন্যাল চেহারা ফিরে এসেছে। এটা কিন্তু তাদের খোদা প্রদত্ত চেহারা নয়; শৈশব থেকে চ-বর্গীয় গালি চর্চা করে; আর পনেরো বছর ধরে অবিরাম অশালীন আচরণ করে চেহারার এই গড়নটি তৈরি করেছে তারা নিজেই। গালাগালের জ্যামিতিক রেখা মুখের মাংস পেশীতে ছাপ ফেলে। লুন্ঠিত অর্থে ময়ূরপুচ্ছ লাগিয়েছিলো; এগারোমাসে তা ঝরে পড়ে কাকের আসল রুপ বেরিয়ে গেছে।

সে কারণেই নতুন বাংলাদেশের নতুন কারিগরদের প্রতি অনুরোধ রইলো, আওয়ামী লীগের গালাগালির সংস্কৃতি থেকে সমাজকে মুক্ত রাখার। জুলাই বিপ্লবের একমাত্র শিক্ষা হচ্ছে, কথায় ও কাজে আওয়ামী লীগের মতো না হওয়া।

আমি থিওরি অফ এক্সকমিউনিকেশনে বিশ্বাসী। ফেসবুকে কেউ গালাগাল দেয়া মাত্র তাকে ব্লক করে দিলে দেখবেন, নর্দমার গন্ধ আর আসবে না। তখন বুঝতে পারবেন, মিষ্টি একটা গন্ধ, রয়েছে ঘরটা জুড়ে।

(চলবে) 

তৃতীয় পর্বের লিংক 

২৭ পঠিত ... ১৮:০৯, জুলাই ০২, ২০২৫

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top