লেখা: জুয়াইরিজা মৌ
গায়ক নোবেল-এর ওপর ধর্ষণ মামলার রায় হয়েছে। নোবেলের আইনজীবী জসীম উদ্দিন ও এসআই ইলা মনি প্রথম আলোকে জানান, ধর্ষণ মামলার বাদী আদালতে উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া আসামি নোবেলের পক্ষ থেকে আদালতে লিখিতভাবে বিয়ে করার জন্য অনুমতি চাওয়া হয়। বাদী ও আসামি উভয় পক্ষের সম্মতি সাপেক্ষে বিয়ের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
এই রায় নারীর যথাযথ বিচার পাওয়ার যে আন্দোলন দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে, সে আন্দোলনের গালে অনেক বড় চপেটাঘাত।
প্রথমত, দীর্ঘদিন ধরে গ্রামের সালিশগুলোতে যে ধর্ষিতাদের ধরে ধরে ধর্ষকের সাথে বিয়ে দেওয়ার প্রচলনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা হচ্ছে, সেই সালিশগুলোর সাথে আজকের আদালতের রায়ের কোনো তফাৎ আমি অন্তত দেখতে পাচ্ছি না।
নোবেলের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে, ধর্ষণের অভিযোগ। এখন হয় তিনি ধর্ষণ করেছেন, নয়তো করেননি। ধর্ষণ করলে ধর্ষণের শাস্তি হবে, যে শাস্তি সুস্পষ্টভাবে বাংলাদেশের আইনে লেখা আছে। ধর্ষণ বা ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স কোনোটা না করলে, মেয়েটা মিথ্যা অভিযোগ করেছে প্রমাণিত হলে মেয়েটার শাস্তি হবে বা নোবেল বেকসুর খালাস পাবে।
দ্যাটস ইট।
ব্যাপার এটাই তো?
ধর্ষণ বা যেকোনো অপরাধের শাস্তি ‘বিয়ে’ কী করে হতে পারে?
আমি ChatGPT-কে জিজ্ঞেস করেছিলাম এই বিষয়ে ইতিহাস জানতে, যে আদালত কি কোনো অপরাধে বিয়ের নির্দেশ দিতে পারে?
উত্তর এল:
সাধারণভাবে, আদালত কোনো অপরাধের সাজা হিসেবে ‘বিয়ে করার নির্দেশ’ দিতে পারে না—এটি আইনত গ্রহণযোগ্য নয় এবং নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনের শামিল হতে পারে। তবে কিছু নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে আদালতের পর্যবেক্ষণ বা মন্তব্যের ভিত্তিতে এই ধরনের নির্দেশ বা পরামর্শ কখনো কখনো শোনা গেছে, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশে। নিচে বিষয়টি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করছি:
আইনগত দৃষ্টিকোণ থেকে:
বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, ফৌজদারি বা দেওয়ানি আইনে এমন কোনো বিধান নেই যেখানে আদালত একজনকে বাধ্য করতে পারে কাউকে বিয়ে করতে, এমনকি যদি তাদের মধ্যে প্রেম বা যৌন সম্পর্কের ইতিহাসও থাকে।
সংবিধান অনুযায়ী, বিয়ে ব্যক্তির মৌলিক অধিকার ও সম্মতির বিষয়। কোনো ব্যক্তি বা আদালতের এর ওপর বলপ্রয়োগ করার অধিকার নেই।
ভারতের কিছু মামলায় দেখা গেছে যে আদালত অভিযুক্ত ধর্ষণের মামলায় ভিকটিমকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছেন বা অভিযুক্ত নিজে এমন প্রস্তাব দিয়েছে—কিন্তু এই প্রস্তাবগুলো সুপ্রিম কোর্ট বা উচ্চ আদালতের সমালোচনার মুখে পড়েছে। এমন নির্দেশ অবৈধ, অনৈতিক ও ভিকটিমের অধিকারের পরিপন্থী।
(বাংলাদেশের আইন সম্পর্কে যাদের বিস্তারিত ধারণা আছে, তারা আরও ভালো বলতে পারবেন নিশ্চয়ই)
এখন যে ভুল ধারণা সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলো নতুন করে—
স্থানীয় বা নিচু আদালতের কিছু পর্যবেক্ষণ বা আপসনির্ভর রায় থেকে মানুষের মধ্যে এই ভুল ধারণা জন্ম নিতে পারে যে বিয়ে আদালতের সাজা হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
কোনো পক্ষ যদি আপসে পৌঁছে যায় এবং সেটি আদালতে উপস্থাপন করে, তখন আদালত সেটিকে গ্রহণ করে মামলার নিষ্পত্তি করে—কিন্তু সেটা কতটা ইতিবাচক বাংলাদেশের সামগ্রিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, এটাই এখন ভাবার বিষয়। যেখানে বছরের পর বছর একেকটা ধর্ষণ মামলা ঝুলে থাকে।
গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা:
ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন বা বাল্যবিবাহের মামলায় কোনোভাবে বিয়ের শর্তে আপস আদালত অনুমোদন করে না—এরকম ধারণাই প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল যেকোনো মামলার ক্ষেত্রেই।
কারণ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ অনুযায়ী, ধর্ষণের মামলায় ভিকটিমকে বিয়ে করলেও অপরাধী ছাড়া পেতে পারেন না।
আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, আজকের এই রায় আরও চৌদ্দটা প্রকৃত ধর্ষণ মামলার ভিকটিম নারীর জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। সালিশের ‘ধর্ষকের সাথে বিয়ে’ রেওয়াজের বিরুদ্ধে কথা বলে বলে আদালতে যান, মামলা করেন—এর যে কালচার অনেক কষ্টে প্রতিষ্ঠিত করার পথে আছেন নারী আন্দোলন কর্মীরা, এই রায় সেই আন্দোলনের জন্য হুমকিস্বরূপ দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়াবে, যদি উচ্চ আদালতে এই মামলা না গিয়ে এটাই সর্বশেষ রায় হয়।
ব্যাপারটা অত্যন্ত নেতিবাচক, দুঃখজনক।
পাঠকের মন্তব্য