তিলা: হ্যালো, কী অবস্থা, কেমন আছ?
পাভেল: এই তো আছি। তোমার কী খবর?
তিলা: ভালো আছি। শোনো, তোমার সঙ্গে আমার একটা জরুরি কথা আছে।
পাভেল: কী হয়েছে? কোনো সমস্যা!
তিলা: হ্যাঁ, সমস্যা। আমি আসলে তোমার মন খারাপ করিয়ে দিতে চাই না। যদিও জানি এতে তোমার মন খারাপ হবে।
ফোনটা কানে রেখে পাভেল কোনো কথা না বলে ভাবছে, এসব কী বলছে তিলা! সে কী আমার সঙ্গে ব্রেক-আপ করতে চায়? ও গড, প্লিজ। আমি তো মারাই যাব। কীভাবে বাঁচব ওকে ছাড়া!
তিলা: কী হলো? কথা বলছ না কেন? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, কথাটা তোমাকে কীভাবে বলব। আমি চলে যাচ্ছি।
পাভেল: মানে? কোথায় চলে যাচ্ছ? তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি, তিলা। আমাকে কেন কষ্ট দিতে চাও?
তিলা: আমি অনেক দূরে চলে যাচ্ছি। আমি নিউইয়র্ক চলে যাচ্ছি।
পাভেল: কেন আমেরিকা যাচ্ছ? আমি কীভাবে থাকব? তোমাদের ফ্যামিলির তো কেউ সেখানে থাকে না, তাহলে যাচ্ছ কেন?
তিলা: আব্বু আমাকে বিদেশ পাঠিয়ে দিচ্ছেন। আমার এক খালা থাকেন সেখানে। তিনি সব ব্যবস্থা করেছেন।
পাভেল: আই কান্ট বিলিভ। তুমি এত দিনের জন্য আমাকে ছেড়ে চলে যাবে? কেন? (তিনবার প্রতিধ্বনি হবে)। তুমি আমাকে ছেড়ে যেয়ো না।
তিলা: উপায় নেই। তুমি তো চেনো আব্বুকে। আমাকে মেরেই ফেলবে। কাল বিকেলে আমার ফ্লাইট, মাত্র জানলাম। আব্বুও যাচ্ছেন আমার সঙ্গে। যাওয়ার আগে তোমাকে আমার একটা জিনিস দেওয়ার আছে আর আমি তোমাকে দেখতে চাই।
পাভেল: (হালকা কান্না) কী জিনিস! আর আমিও তোমাকে দেখতে চাই।
তিলা: আমিও চাই। তুমি বাসার সামনের পার্কটাতে চলে আসো। আমি আম্মুকে ফ্লেক্সিলোডের কথা বলে নিচে নামছি।
পাভেল: আমি আসছি এক্ষুনি।

২০ মিনিট পর পাভেল গিয়ে হাজির হলো ওই পার্কে। পুরো দুনিয়া অন্ধকার হয়ে আসছে তার। শরীরের রক্ত ঝিমঝিম করে তিলার চলে যাওয়ার প্রতিবাদ জানাচ্ছে হৃৎপিণ্ডের প্রতি বিটে বিটে।
পার্কে তারা দেখা করল। পাভেল পরে এসেছে একটা লাল রঙের জ্যাকেট। আর তিলার পরনে একটা মিকি মাউস টাইপ টি-শার্ট। তার ওপর কালো একটা জ্যাকেট। পাভেল তিলাকে বুকে অনেকক্ষণ ধরে জড়িয়ে ধরে রাখল, মাথায় হাত বোলাল, কানের পেছনে আদর করল। একসময় তিলা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, আমাকে এখন যেতে হবে। আর এই যে একটা চিঠি, এটা তোমার জন্য। বাসায় গিয়ে পোড়ো, এখন না।
তারপর তারা পরস্পরকে আবার জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ। ওই সময় বুড়িগঙ্গার বুকে কোনো জল বইল না, থমকে গেল ঘড়ির কাঁটা। সময় এবং স্রোত অপেক্ষা করে রইল তাদের জন্য। বাসায় ফিরেই পাভেল তিলার দেওয়া চিঠিটা পড়তে শুরু করল। গোটা গোটা হাতে সেখানে লেখা:

প্রিয় পাভেল,
তুমি ইতিমধ্যেই জানো যে আমি আব্বুর সঙ্গে চলে যাচ্ছি আমেরিকা। কিছু সত্যি কথা আছে, যা সামনাসামনি বলা যায় না। তাই এই চিঠির আশ্রয় নিতে হলো। সত্যি হলো, আমি তোমাকে কখনোই ভালোবাসিনি। আমি তোমাকে ঘৃণা করি। তুমি একটা কুমির। কখনোই তোমার সঙ্গে কথা বলতে আমার ভালো লাগেনি। আমি কখনোই চাইনি তোমার সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে। তুমি কখনোই বুঝতে পারোনি আমি তোমাকে কতটা ঘৃণা করি। আমি এখন চলে যাচ্ছি, কাজেই আমার মনে হচ্ছে তোমার আমার একদম মনের কথাটা জানানো দরকার ছিল। আমার মনে হয় আমি তোমাকে যতটা ঘৃণা করি আর কাউকেই এর চেয়ে বেশি ঘৃণা কোনো দিন করিনি। আমি তোমাকে কখনোই দেখতে চাই না। কুমির, এই চিঠিটা তুমি সঙ্গে রেখো। কারণ এটাই তোমাকে দেওয়া আমার শেষ কিছু। তোমার জন্য অনেক অনেক ঘৃণা, ঘৃণা আর ঘৃণা।
ইতি, তিলা

চিঠি পড়তে পড়তে কোনোভাবেই পাভেল তার চোখের পানি ধরে রাখতে পারল না। হু হু করে কেঁদে উঠল। সারা দুনিয়া চোখের সামনে চক্কর খেতে লাগল। এ কী হলো! এর চেয়ে যে মৃত্যু অনেক ভালো ছিল। এই জীবনের কোনো মানে হয় না। এসব ভাবতে ভাবতে সে সিদ্ধান্ত নিল আত্মহত্যা করবে। কীভাবে আত্মহত্যা করা যায় সেটা নিয়েই সে ভাবতে ভাবতে দিন-রাত পার করে ফেলল। দুই দিনেই তার চুল-দাড়ি উষ্কখুষ্ক হয়ে পড়ল। চোখ লাল। চেহারা পুরোপুরি বসে গেছে। যে-ই দেখে, সে-ই আঁতকে ওঠে।

দুই দিন পরে হঠাৎ পাভেলের মোবাইলটা বেজে উঠলে সে তাকিয়ে দেখে তিলার বন্ধু নয়ন তাকে ফোন দিয়েছে।
পাভেল: হ্যালো, নয়ন।
নয়ন: কী খবর, পাভেল ভাই।
পাভেল: খুব খারাপ আছি। আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না তিলা আমার সঙ্গে এমনটা করতে পারল। কীভাবে পারল সে। এতই যদি আমাকে সে ঘৃণা করবে তাহলে সে আমার সঙ্গে এত দিন কেন এই ছলনা করল?
নয়ন: ও, আপনি তিলার কথা বলছেন। শোনেন, সে চলে যাওয়ার আগে আমাকে একটা মেসেজ দিয়ে গেছে। সেই মেসেজটা দিতেই আপনাকে আমি ফোন করেছি। সে বলেছে, আপনি যেন আপনার লাল জ্যাকেটের ডান পকেটটা চেক করেন।
পাভেল: লাল জ্যাকেটের ডান পকেট? আচ্ছা আমি দেখছি। আমি রাখলাম তাহলে ফোন।
নয়ন: আচ্ছা ঠিক আছে। পরে কথা হবে পাভেল ভাই।

পাভেল তাড়াতাড়ি তার লাল জ্যাকেটটা খুঁজে বের করে ডান পকেটে একটা চিরকুট খুঁজে পেল। ওই চিরকুটে লেখা:

আমার প্রিয় পাভেল,
আশা করছি, তুমি আমার বড় চিঠিটা পড়ার আগেই এই চিরকুটটা খুঁজে পেয়ে পড়েছ। আমি জানি, তোমার আব্বু কী ভয়ংকর রাগী। আমার আগের অনেক চিঠির কারণে কতবার তোমাকে মার খেতে হয়েছে, সেটাও জানি। আমি চাই না, আগের চিঠির কারণে তুমি আবার মার খাও। তাই তোমার আব্বু যাতে ওই চিঠিটা পড়ে কিছু বুঝতে না পারে সে জন্য ওই চিঠির কিছু শব্দ আমি এদিক-সেদিক করে দিয়েছি। ওই চিঠিটা পড়ার সময় তুমি কিছু শব্দ নিচের মতো উল্টো করে পড়ে নেবে। শব্দগুলো আমি এখানে দিলাম।

ভালোবাসি=ঘৃণা, ঘৃণা=ভালোবাসা
কুমির=সুইট ছেলে, কখনোই=সব সময়
না=হ্যাঁ, চাইনি=চেয়েছি

পাভেল, আমি তোমাকে খুব খুব ভালোবাসি। আমি যত দ্রুত পারি চলে আসব আবার ঢাকায়। আমিও তোমাকে ছাড়া কোথাও থাকতে পারব না। আমার জন্য অপেক্ষা কোরো। আমি ঢাকা এলে আমরা আবার নাচব, দৌড়াব, খেলব, রং করব একসঙ্গে। যখন আমরা ক্লান্ত হব তখন একে অপরের গায়ে হেলান নিয়ে চুপচাপ বসে থাকব, হাত ধরে। তুমি অনেক অনেক ভালো থেকো।
তোমার-ই, তিলা

এই চিরকুট পেয়ে পাভেল আবার কাঁদতে শুরু করল। ও মাই গড, তিলা এখনো আগের মতোই ভালোবাসে। সে সত্যিই আমাকে অনেক অনেক ভালোবাসে। আমি কী ভুলটাই না বুঝেছিলাম! তিলা যখন পার্কে আমাকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে ছিল, তখন নিশ্চয়ই সে আমার জ্যাকেটে এই চিরকুটটা গুঁজে দিয়েছিল। একটুও টের পাইনি আমি। আমি কত্ত বড় স্টুপিড! ও গড!

[বিদেশি কাহিনি অবলম্বনে]