বানিয়ালুলু নামে যে একটা দেশ আছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতায় না এলে এটা কারও জানাই হতো না। জানা হতো না, লুলু নামে বানিয়ালুলুর একটা দাপ্তরিক ভাষা আছে এবং সোয়া কোটি লোক সেই ভাষায় কথা বলে।
যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করতে গিয়ে এই দেশটির অস্তিত্ব ফাঁস হয়ে গেছে। কীভাবে সেটা ঘটল, সেই কাহিনি একাধারে কৌতুকময়, চমকপ্রদ এবং কিছুটা শ্বাসরুদ্ধকরও বটে, কেননা এর সঙ্গে একজনের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার যোগ আছে। যিনি নিখোঁজ হয়েছেন, তিনি একজন সাংবাদিক। তাঁর কথা আমি যথাস্থানে বলব। এখন শুরুর কথা শুরুতে।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সাতটি দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে একটি নির্বাহী আদেশ জারি করেন। এই সাতটি দেশ হলো ইরান, লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন, সোমালিয়া, শাদ ও উত্তর কোরিয়া। এই নিষেধাজ্ঞা স্থায়ী। দুপুর ১২টা ৩৫ মিনিটে এটি স্টেট ডিপার্টমেন্টের মাধ্যমে জারি করা হয়। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, এটি ছিল ওই দিন একই বিষয়ে জারি করা দ্বিতীয় আদেশ। এর আধা ঘণ্টা আগে, দুপুর ১২টা ৫ মিনিটে যে আদেশটি জারি করা হয়েছিল, তাতে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার তালিকায় ছিল আটটি দেশের নাম। অস্বাভাবিক দ্রুততায় সেই আদেশ বাতিল করে দ্বিতীয় আদেশ জারি করা হয়। সেখানে নিষেধাজ্ঞার তালিকায় সাতটি দেশের নাম দেখা যায়। যে অষ্টম দেশটির নাম কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে, সেটি বানিয়ালুলু। এই দেশটির নাম আগে কেউ কখনো শোনেনি। এই নামে কোনো দেশ নেই।
হোয়াইট হাউসের অফিশিয়াল ঘোষণায় কী করে অস্তিত্বহীন একটি দেশের নাম এল, তা নিয়ে কেউ খুব বেশি মাথা ঘামায়নি। অনেকেই এটিকে দাপ্তরিক প্রমাদ হিসেবে ধরে নেন। তা ছাড়া সাত দেশের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা নিয়ে যে হইচই শুরু হয়, সবার নজর সেদিকে সরে যায়। প্রশাসনের কর্মকর্তারা এতে হাঁফ ছাড়েন এবং ভেবেছিলেন, হোয়াইট হাউসের আসন্ন বহু কেলেঙ্কারির মধ্যে অন্তত একটি আপাতত চাপা দেওয়া গেছে। তাঁদের এই ভাবনা যে ভুল ছিল, বড়দিন আসার আগেই সেটা বোঝা যায়।
এখন আমি আমাদের সেই সাংবাদিক বন্ধুর কথা বলব, যিনি ২৪ সেপ্টেম্বরের প্রথম ঘোষণাটির দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে ছিলেন এবং দ্বিতীয় ঘোষণা আসার পরও যার কুঁচকানো ভ্রূ সোজা হয়নি। তিনি এর মধ্যে ইঁদুর মরার গন্ধ পেয়েছিলেন এবং সেই গন্ধ তাঁর নাকে ক্রমাগত প্রবল হয়েছে। একাধিক সূত্র তাঁকে নিশ্চিত করেছে, ২৪ সেপ্টেম্বর প্রথম ঘোষণার কেলেঙ্কারির পরপরই ওই দিন দুপুরে হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্টের অতি আস্থাভাজন ‘ইনার সার্কেল’ তাৎক্ষণিক জরুরি রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসে এবং ওই দিন সন্ধ্যার আগেই কয়েকটি দপ্তরের পাঁচজন কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। পুরো বিষয়টির মধ্যে ছিল একটি অস্বাভাবিক তাড়াহুড়ো এবং সবকিছুর ওপর গোপনীয়তার একটা চাদর টেনে দেওয়া হয়েছিল।
চাকরি হারানো পাঁচ কর্মকর্তার একজন ছিলেন স্টেট ডিপার্টমেন্টের রেকর্ড শাখার আর্কাইভিস্ট। কয়েক সপ্তাহ পর, অক্টোবরের কোনো এক বিকেলে ম্যানহাটানের নবম ও দশম ব্লকের মাঝে ডেমি জোনস নামের একটি ক্যাফেতে তাঁকে বসে থাকতে দেখা গেছে। তাঁর সামনে বসে ছিলেন বাতিকগ্রস্ত সেই সাংবাদিক। তাঁকে এখন থেকে আমরা ‘র্যাট স্মেলার’ নামে ডাকব। আর্কাইভিস্ট ও র্যাট স্মেলার সেখানে ৪৫ থেকে ৫০ মিনিট বসে ছিলেন। তাঁরা নিচু স্বরে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন। কথা শেষে বিল মিটিয়ে তাঁরা ট্যাক্সি নিয়ে দুজন, দুদিকে চলে যান।
শোনা যায়, র্যাট স্মেলার তাঁর দেড় কক্ষের ক্ষুদ্র অ্যাপার্টমেন্টে পাঁচ হাজার শব্দের একটি প্রতিবেদন তৈরির কাজ অনেকটা এগিয়ে নিয়েছিলেন। বেশ কিছু দলিলপত্রও জোগাড় করে ফেলেছিলেন তিনি। প্রতিবেদনের প্রস্তাবিত শিরোনাম তিনি দিয়েছিলেন: **‘বানিয়ালুলু একটি দেশের নাম’**। আটলান্টিকের ওপারে একটি ইংরেজি ট্যাবলয়েডের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়েছিল বলেও জানা যায়, তবে কেউ নিশ্চিত নন, নির্মীয়মাণ প্রতিবেদনটির কোনো অসম্পূর্ণ খসড়া তিনি সেই পত্রিকার অফিসে পাঠিয়েছিলেন কি না। তত দিনে তাঁর অনুসন্ধানের বিষয়বস্তু নানাভাবে প্রচার পেতে শুরু করেছে এবং তিনি কী বিষয়ে অনুসন্ধান করছেন, সেটা জানাজানি হয়ে গেছে।
নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে র্যাট স্মেলার নিখোঁজ হন। অনেকে বলেন, তাঁর অনুসন্ধানের বিষয়বস্তুর সঙ্গে এই অন্তর্ধানের যোগ আছে। থাকাটাই স্বাভাবিক।
র্যাট স্মেলার একটি বিস্ফোরক তথ্য প্রচারে নেমেছিলেন। তাঁর দাবি, ট্রাম্পের প্রথম ঘোষণায় কোনো দাপ্তরিক ভুল ছিল না। বানিয়ালুলু নামে একটি দেশের অস্তিত্ব সত্যি আছে। বেলজিয়াম, দক্ষিণ আফ্রিকা বা প্যারাগুয়ের মতোই এর অস্তিত্ব, কিছুতেই কম নয়। তফাত এই, জাতিসংঘের সদস্য দেশের তালিকায় এর নাম নেই, পৃথিবীর কোনো মানচিত্রে এটির উল্লেখ নেই এবং কোনো ভূগোলের বইতেও এর সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই।
স্টেট ডিপার্টমেন্টের শ্রেণিবদ্ধ দলিলের গোপন কুঠুরি থেকে র্যাট স্মেলার যেসব তথ্য-উপাত্ত জোগাড় করেছেন, সেগুলোর ভিত্তিতে বানিয়ালুলুর কিছু বিবরণ দাঁড় করানো সম্ভব। তবে স্বীকার করতে হবে, সেই বিবরণ বড়ই ছেঁড়াছেঁড়া, অসম্পূর্ণ এবং জোড়াতালি দেওয়া। এগুলো দেশটি সম্পর্কে কোনো অখণ্ড, সুসংগঠিত ছবি হাজির করে না। যেমন, আমরা বানিয়ালুলুর রাজধানীর নাম পাই না, অথচ রাজধানীর পূর্ব প্রান্তে ইমাহাতি নামে একটি মহল্লা আছে এবং সেখানে ৩৩৬ ও ৩৩৭ নম্বর বৈদ্যুতিক খুঁটির দূরত্ব যে ১৬ গজ—এই অপ্রয়োজনীয় তথ্য আমরা জানতে পারি। দেশটির দাপ্তরিক ভাষা লুলুর নিজস্ব লিপি নেই, এটি একাধিকবার উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু জানা যায় না, এটি কোন ধার করা লিপিতে লেখা হয়। একটি পরোক্ষ সূত্রে বলা হয়েছে, নেপোলিয়নের অস্টারলিৎস যুদ্ধে জয়ের সময় থেকে লুলু ভাষা মান্দারিন লিপিতে লেখা হচ্ছে। কিন্তু এর মাধ্যমে চীনের সঙ্গে কোনো যোগসূত্র অনুমান করার সুযোগ নেই।
বানিয়ালুলু সম্পর্কে কিছু বিবরণে শুধু সঙ্গতির অভাব নয়, কিছু তথ্য পরস্পরবিরোধীও। যেমন কিছু সূত্রে দেশটি সিরিয়া ও আজারবাইজানের মাঝামাঝি কোনো মালভূমিতে অবস্থিত বলে মনে হয়। আবার অন্যত্র বলা হয়েছে, এটি বাল্টিক সাগর তীরবর্তী। কেউ কেউ নামের ধ্বনিগত বৈশিষ্ট্য দেখে আফ্রিকা মহাদেশে এর অবস্থান কল্পনা করেন, আবার কেউ লাতিন আমেরিকাও সন্দেহে রাখেন। তবে দুটি বিষয়ে সন্দেহ নেই—এক, বানিয়ালুলু দ্বীপ রাষ্ট্র নয়, এটি কোনো এক বৃহৎ মহাদেশীয় ভূখণ্ডে অবস্থিত। দুই, এটি বিষুবীয় অঞ্চলের দেশ নয়।
র্যাট স্মেলার যেসব দলিল জোগাড় করেছেন, সেগুলো থেকে দেশটির ভূপ্রকৃতি, কৃষি, জলবায়ু ও মানুষের জীবনযাত্রা নিয়ে তুলনামূলক সুসংহত ধারণা পাওয়া যায়। কিছু বিবরণ রেমব্রান্টের ছবির মতো জীবন্ত। যেমন, একটি বিবরণে আদ্দিশ নামের এক পাহাড়ের পাদদেশে সাত সদস্যের একটি পরিবারের এক দিনের কর্মকাণ্ড তুলে ধরা হয়েছে। একটি মেয়ে পাতকুয়া থেকে বালতি দিয়ে পানি তুলছে, এমনকি সেই বালতির প্রতিটি রিভেটে হলুদে মরচে ধরার বিবরণও আমরা পাই। বসতবাড়ি থেকে কিছু দূরে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বয়ে চলেছে একটি নদী, যার জলের নিচে খেলা করা প্রতিটি মাছের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ আছে—নামের সঙ্গে সঙ্গে আঁশে পড়া রোদের ঝিলিক পর্যন্ত।
এছাড়াও র্যাট স্মেলার বানিয়ালুলুর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত দ্বিতীয় বর্ষের উদ্ভিদবিজ্ঞান বইয়ের (রুশ ভাষায় অনূদিত) পঞ্চম অধ্যায়ের পুরোটা জোগাড় করেছেন। সেখানে ছয়টি বায়ুপরাগী ফুলের প্রস্থচ্ছেদের ছবি রয়েছে। পাঁচটি পরিচিত, তবে ষষ্ঠটি দেখতে জবা ফুলের মতো হলেও পাপড়ির বিন্যাসে কিছু অমিল আছে।
ষাটের দশকে দেশটিতে খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছিল বলে একটি দলিলে উল্লেখ আছে, তবে প্রধান ফসল কী, তা বলা হয়নি। এক জায়গায় ভুট্টাজাতীয় একটি ফসলের উল্লেখ আছে, কিন্তু তা থেকে সিদ্ধান্তে যাওয়া ঠিক হবে না।
র্যাট স্মেলার একটি গ্রামাঞ্চলের বিয়ে উপলক্ষে বনের দীর্ঘ বিবরণ দিয়েছেন, যা থেকে সামাজিক আচার, পোশাক ও খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। চারটি বিয়ের গীতের গীতলিরিক থেকে লোকবিশ্বাস ও জনগণের মনোজগৎ আঁচ করা যায়। শেয়াল-কাকের গল্পগুলোর একটি সিরিজ এই সমাজের কাঠামো ও জীবনচর্যার ইঙ্গিত দেয়।
মুদ্রা ও ব্যাংকব্যবস্থার অল্প কিছু বিবরণ, শিল্প অঞ্চলের একটি কারাগারের পঞ্চাশজন বন্দির অপরাধের বিবরণ থেকে আইন-শৃঙ্খলা ও বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা মেলে।
সব মিলিয়ে র্যাট স্মেলার যে সব দলিল ও বিবরণ উদ্ধার করেছেন, তা দিয়ে বানিয়ালুলুর একটি ছবি আঁকা যায় বটে, তবে তা অনেকটা ছেঁড়া গ্রুপ ফটো, যাতে প্রকাশের চেয়ে অপ্রকাশই বেশি।
সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো—বানিয়ালুলুর অস্তিত্ব এত দিন গোপন থাকা, এমনকি তার মানচিত্রে না থাকা, এ বিষয়ে র্যাট স্মেলার কোনো ব্যাখ্যা নেই।
আমি নিজেও ব্যাপক অনুসন্ধান করে বুঝেছি, এখানে অগ্রগতির সুযোগ খুবই সীমিত। বানিয়ালুলুর অনস্তিত্ব কোনো নিরীহ ঘটনা নয়, বরং এর পেছনে সুবিশাল একটি ষড়যন্ত্র কাজ করছে। যার উদ্দেশ্য পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা।
আমার অনুমান, বানিয়ালুলুকে গোপন রাখার জন্য ‘কালচারাল ডিজইন্টিগ্রেশন’ নামের একটি পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছে, যেমনটা টমাস মানরো অ্যাজটেক মন্দিরের প্রসঙ্গে বলেছেন। সব তথ্য এমনভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে কেউ পুরোটা বুঝে উঠতে না পারে।
হতে পারে, বানিয়ালুলু চিরতরে হারিয়ে গেছে। এখন শুধু পরোক্ষ কিছু আভাস আমরা মাঝে মাঝে খুঁজে পেতে পারি।
র্যাট স্মেলার আদৌ নিখোঁজ কি না, তাও নিশ্চিত নয়। হয়তো তিনি কোনোভাবে বানিয়ালুলুতে পৌঁছে গেছেন। কিংবা তিনি এখনো ম্যানহাটানের রাস্তায় আমাদের পাশে হেঁটে বেড়াচ্ছেন, আমাদের অজান্তেই।
পাঠকের মন্তব্য