'অমর একুশে' নিয়া ২১টা ভুল ধারণা

১০৮০ পঠিত ... ১৫:৩৯, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২২

21-feb-vul-dharona

 

'অমর একুশ' 'অমর একুশ' টাইপ আদিখ্যেতা  দেখলে ইদানিং মেজাজ খারাপ হয়। 

চাকরি-বাকরির বাজারে, উচ্চশিক্ষাসহ সর্বোপরি সমাজের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার কোনো দাম নাই, সারাবছর খোঁজ-খবর নাই, অথচ ফেব্রুয়ারি আসলেই বাংলা ভাষা নিয়া ল্যাদকালেদকি আবেগ!

বলেন, আমার এই মেজাজ খারাপ হওয়াটা কি অযৌক্তিক?

তাছাড়া আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা নিয়াও বাঙালির ভুল ধারণার অভাব নাই।

যেমন, আন্তর্জাতিক মার্তৃভাষা দিবসের মানে এইটা না যে বাংলাই দুনিয়ায় একমাত্র কাবিল ভাষা। মানে বাংলা ভাষা সেরা এটাও না। একটা ভাষা অন্য কোনো ভাষার চাইতে সেরা বা উন্নত হয় না। ভাষার  ফার্স্ট সেকেন্ড মাপার কোনো *অবজেক্টিভ* মানদণ্ড নাই।  

ভাষা সামাজিক জীবনরে সহজ করার জন্যে কালচারাল টুল (বা চৌকি!) মাত্র। যে কোনো ভাষা সুন্দর, ওই ভাষাভাষী লোকের কাছে প্রিয়। প্রতিটি ভাষার নির্দিষ্ট সমাজের ভাষিক/যোগাযোগের প্রয়োজন মেটাতে গড়ে ওঠে। এবং নির্দিষ্ট সমাজের মতো নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়। 

এস্কিমোদের ভাষায় বরফ/তুষার-এর প্রায় অর্ধশত সমার্থক শব্দ আছে, যা অন্য ভাষাতে নাই। তার মানে এমনটা নয় যে, এস্কিমোদের ভাষা পৃথিবীর সেরা ভাষা। জাস্ট এস্কিমোদের লাইফস্টাইলে বরফের উপস্থিতি অনেক বেশি, সেটারই প্রতিফলন ঘটছে তাদের ভাষায়।  

ইংরেজি ভাষায় শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ, বিশেষত প্রযুক্তি ও সায়েন্টিফিক পরিভাষা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ইংরেজি ভাষায়। কারণ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভোল্যুশনের সময় জ্ঞান বিজ্ঞান, যোগাযোগ আর কলোনিসমহ বিশাল সাম্রাজ্যের ভাষা  ছিলো ইংরেজি৷

তার মানে কি ইংরেজি শ্রেষ্ঠ ভাষা? না।

এতো বিশাল ভোকাবুলারি আছে, অথচ এতো বাংলাভাষার অনুভুতিজ্ঞাপক শব্দদ্বৈত-এর মতো ফিচার ইংরেজিতে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় নাই। বেশিরভাগ ইউরোপীয় ভাষায় নাই। শব্দদ্বৈত বাংলা ভাষার মোটামুটি একটা ইউনিক ফিচার।  

'বুকটা খা খা করা'  'ভয়ে গা ছম ছম করা', 'ফোড়া টনটন করা', 'উড়ু উড়ু ভাব' ইত্যাদি এক্সপ্রেশন বাংলা ভাষায় যত বেশি, অধিকাংশ ইউরোপিয় ভাষায় সেটা নাই। তার মানে কি ওই সকল ভাষা কিংবা ইংরেজির চাইতে বাংলা উন্নত বা সেরা? কাবিল ভাষা?

মোটেই না!

এর মানে হইতেছে, প্রতিটি ভাষাই ভাব প্রকাশের বিশিষ্ট বা ইউনিক বৈশিষ্ট্য নিয়া গড়ে ওঠে; বাংলাও। সমাজ, রাজনীতি ও ইতিহাসের প্রয়োজন অনুযায়ী ভাষার শরীর ও মন তৈরি হয়, সেগুলা মাপার কোনো অবজেক্টিভ মাপকাঠি নাই। 

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস মানে  যে কোনো দেশের যে কোনো জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো। মানুষের মাতৃভাষায় বলা, লেখা ও অন্যান্য কাজের অধিকার। মাতৃভাষার ও কালচারের জন্যে খালি বাঙালির সংগ্রাম আছে, আর কারও নাই- এমন ধারণা নিয়া থাইকেন না কাগুগণ।

হাতের কাছেই আসামের লোকের আছে। নিজের ভাষা ও কালচাররের প্রশ্নে লড়াইয়ে তামিলদের আরও বেশি গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আছে। এখনও তামিলরা হিন্দির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ চালিয়ে যাইতেছে।

'৫২-তে আপনার পূর্বপুরুষেরা যে মাতৃভাষার অধিকারের জন্যে লড়াই করছে, একই অধিকার চাকমা-মারমা সহ এই দেশের যেকোনো জনগোষ্ঠীর আছে,  তারা সংখ্যায় গুরু না হইলেও।

দেশের বিহারীদেরও আছে, যেই অধিকার আপনার বাংলা নিয়া আছে। আরজে বা যে কারও বাংলা-ইংলিশ মেশানো ভাষায় কথা বলার ও লেখার রাইট আছে, যদি তারা চায়। একুশ মানে আপনার কাছে যা 'খিচুড়ি ভাষা' সেই ভাষাতেও তাদের বলতে লিখতে  বাধা না দেওয়া।

একুশের মর্ম আপনি বুঝে থাকলে, এখন যদি উর্দুভাষী বা চাকমা বা অন্য কোনো জনগোষ্ঠী তাদের মাতৃভাষায় লেখা পড়া ও অন্যান্য অফিশিয়াল কাজকর্ম করার অধিকারে সংগ্রাম করে, আপনার উচিৎ তাদের সমর্থন দেওয়া। এই সহজ বিষয়টাও চিল্লায়ে বলা লাগে। কারণ অমর একুশে ও 'আবহমান বাঙালি চেতনা'র নামে এদেশে চলতেছে এক ধরনের কালচারাল ফ্যাসিবাদ ।

কিন্তু ২১শে ফেব্রুয়ারির সবচেয়ে বড় আইরনি কি জানেন?

একটা জনগোষ্ঠী আন্দোলন করলো, জীবন দিলো বাংলারে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে। অথচ পাইলো 'আন্তর্জাতিক  মাতৃভাষা দিবস'-এর স্বীকৃতি। কিন্তু রাষ্ট্রের সর্বস্তরে সেই ভাষা ব্রাত্য। (আন্তর্জাতিক  মাতৃভাষা দিবসের ধারণা একটা ভালো, সুইট জিনিস৷  কিন্তু মনে রাখা উচিত ৫২'র আন্দোলন আন্তর্জাতিক  মাতৃভাষা দিবসের জন্যে হয় নাই, রাষ্ট্রভাষার দাবিতে হইছিলো। দুইয়ের মধ্যে বিশাল তফাৎ)

বাংলাদেশের যেকোনো আন্দোলনের ফলাফলের মতো ভাষা আন্দোলনেও একই জিনিস ঘটছে। বিভিন্ন কাঠামোগত পরিবর্তনের জন্যে আন্দোলন হয়, কিন্তু সমস্ত আন্দোলনের ফলাফল কী হয়?

ভিসির পদত্যাগ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান কিংবা পুলিশদের ফুলেল শুভেচ্ছা!

এতো বড় সড়ক আন্দোলন হইলো, কিছু বদল কি ঘটছে? এখনও দেশের মানুষ বাস-মালিকদের কাছে, বাস-সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি। এখন আরও বেশি জিম্মি, ভাড়াও আগের চেয়ে অনেক বেশি, অন্যায্যভাবে। 

বাংলারে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ভাষা-আন্দোলন হইলো, অনেক শহীদের রক্ত ঝরলো, অথচ আমরা পাইলাম আন্তার্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি ও গৌরব!

এবং সমাজে সবচেয়ে কম সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায় 'বাংলা' জানলে। ভার্সিটিতে সবচেয়ে নিচের দিকের, দূর্বল সাব্জেক্ট বাংলা; যা বাধ্য না হইলে কেউ পারতপক্ষ পড়াশোনার বিষয় হিসেবে নিতে চায় না! এমনই রাষ্ট্রভাষা 'বাংলা' আমরা বানাইছি!

রাষ্ট্রভাষা মানে সর্বত্র সেই ভাষার ব্যবহার। উচ্চশিক্ষা, আইন-আদালত থেকে শুরু দেশের সর্বস্তরে ভাষার প্রচলন করা না গেলে রাষ্ট্রভাষা কেমনে হয়?

উপযোগিতা, ক্ষমতা, মর্যাদা কোনো দিক দিয়াই রাষ্ট্রে একটা ভাষার দুই পয়সার দাম না থাকলে সেইটা কেমন রাষ্ট্রভাষা?

প্রশ্ন: কিন্তু রাকিব, শিরোনামে ২১টা ভুল ধারণার কথা বললেন, অথচ লেখায় দুই তিনটার বেশি খুজে ভুল ধারণার বেশি পাইলাম না!  ক্লিকবেইট হইলো না?

উত্তর: জ্বি, ঠিক বলছেন। আমি একটু ক্লিকবেইট করলাম। 'অমর একুশ নিয়া একুশটা ভুল ধারণা' হেডলাইন হিসাবে ক্যাচি, এটেনশন গ্র‍্যাবিং, ক্লিকেবল কিন্তু মূলত একটা ফাচুকি হেডলাইন।

সত্যি বলতে, অমর একুশে নিয়া আমাদের অতি আবেগও এই ক্লিকবেইটের মতো একটা ফাচুকি জিনিস!

 

 

 

১০৮০ পঠিত ... ১৫:৩৯, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২২

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top