বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে আসলে কী হয়েছে?

১২৯ পঠিত ... ২২:৩৮, ডিসেম্বর ১৬, ২০২৫

পাকিস্তানিরা কত বদ ছিল, সহজভাবে বুঝাই। ১৯৭১ সাল যে টুপ করে পড়ে নাই, এটাও খুব সহজে বুঝতে পারবেন। কোটা আন্দোলন যারা করেছেন, এবং এই আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধ যত বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা হচ্ছে, তাদেরকেও তাদেরই আন্দোলনের উদাহরণ দিয়েই খুব সংক্ষেপে বুঝাচ্ছি। এই যে সেভেন সিস্টার্স আপনারা চাইতেছেন, এর অন্তত আসাম যে পূর্ববঙ্গের মানচিত্রে থাকতেই পারত, কেন থাকল না, সেটাও বোঝাচ্ছি।

একাত্তর বুঝতে হলে প্রথমে ১৯৪০ লাহোর প্রস্তাব বুঝতে হবে। এই প্রস্তাবের ভিত্তিতেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম। এই প্রস্তাবের উত্থাপক ছিলেন বাংলারই নেতা শেরে বাংলা ফজলুল হক। লাহোর প্রস্তাবে সুনির্দিষ্টভাবে বলা ছিল, ‘ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান এলাকাগুলো ‌‘স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ’ (Independent States) গঠন করতে পারে। অর্থাৎ মুসলিমদের রাষ্ট্র হবে দুইটা। একটা পশ্চিমে আরেকটা পূর্বে।

জিন্নাহ দ্বিজাতি তত্ত্বে অটল থাকলেন। তিনি চাইলেন ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র ভাগ হবে। ফলে রাষ্ট্র হয়ে গেল দুইটা। একটা ভারত, একটা পাকিস্তান। র‍্যাডক্লিফ অবিশ্বাস্য দ্রুততায় ভারত ভাগ করল। দুই ভাইয়ের উঠানের মাঝদিয়ে চলে গেল মানচিত্রের দাগ। কারও রান্না ঘর পড়ল এক দেশে, শোবার ঘর পড়ল আরেক দেশে। আসাম চলে গেল ভারতে। অথচ শেরে বাংলা ভেবেছিলেন, পূর্ববঙ্গ ও আসাম মিলে হবে আরেকটা রাষ্ট্র।

তবু পাকিস্তান মেনেই নিয়েছিল এই বঙ্গের মুসলিমরা। তারা চেয়েছিল একটা রাষ্ট্র। মানুষ কেন রাষ্ট্র চায়? কেন স্বাধীনতা চায়? গল্প-কবিতা-আবেগ-ইমোশন বাদ দেন। সহজ হিসাব, আমার রাষ্ট্র থাকলে আমি সুযোগ-সুবিধা সমান পাব। আমার ছেলেটা সরকারি চাকরি পাবে। আমার কষ্ট কমবে।

বাংলার মুসলমানরা প্রথম ধাক্কা খায় ১৯৫২তে। এটা নিয়ে বিস্তারিত বললাম না। যেটা নিয়ে কেউ তেমন কোনো কথা বলে না, চলেন একেবারে ১৯৬২-তে চলে যাই।

১৯৫৪ সালে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেয় গণপরিষদ। ১৯৫৬ সালে সেটি পাকিস্তানের সংবিধানে গৃহীতও হয়। এর পরও শরিফ শিক্ষা কমিশন সুপারিশ করে, পাকিস্তানের শিক্ষার ভাষা হবে উর্দু। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে ইংরেজি হতে হবে বাধ্যতামূলক। বিনামূল্যে শিক্ষা বিতরণ আর হবে না। টাকা দিয়ে কিনতে হবে শিক্ষা। আর এখন থেকে বাংলা লিখতে হবে রোমান হরফে। ‌‘আমি’ লিখতে হবে ‌‘ami’।

তাহলে বলেন, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া ধোঁকাবাজি ছাড়া আর কী? শরিফ কমিশনের সুপারিশের প্রতিটাই তো বাংলার প্রান্তিক মানুষের জন্য আঘাত। এই বাংলার বেশির ভাগ মানুষ খেটে-খাওয়া। নুন আনতে পান্তা ফুরাবে কী, পান্তাই তো জোটে না ঠিকমতো। তাদের শিক্ষা ‌‘কেনার’ সামর্থ্য কি আছে? অসুখ হলে তাবিজই এখন যাদের মূল ভরসা, তাদের জন্য শিক্ষা তো বিলাসিতা। তাহলে কি চাষার ছেলে কখনো শিক্ষা পাবে না? আজীবন জোয়াল টেনে যাবে?

উর্দু আর ইংরেজি শিখতে হলে পিছিয়ে পড়তে হবে আরও। পশ্চিম পাকিস্তানের আশরাফ পরিবারের ছেলেটা যেভাবে উর্দু পারে, পূর্বের একজন কৃষকের ছেলের পক্ষে কি তা পারা সম্ভব? চাকরির ক্ষেত্রে তো অসময় প্রতিযোগিতা তৈরি করে ফেলল আইয়ুব খান। এ জন্যই ছাত্ররা রুখে দাঁড়াল।  ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি আইয়ুব খানের নির্দেশে গ্রেপ্তার করা হলো সোহরাওয়ারর্দীকে। সেখান থেকেই এই আন্দোলন ফুঁসে ওঠে। শিক্ষা আন্দোলন ছিল আইয়ুব খানের শাসনকে প্রথম সরাসরি চ্যালেঞ্জ করা।

১৯৬৫-র ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিমারা কলোনি ছাড়া তারা কিছুই ভাবেনি। সামরিক দিক দিয়েও দুর্বল করে রেখেছে। পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র একটি ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন, সেটিও পূর্ণ শক্তিতে ছিল না। হাতেগোণা কয়েকটি মাত্র ট্যাংক, ভারী আর্টিলারি প্রায় নেই বললেই চলে, তেজগাঁওয়ে একটিমাত্র বিমানঘাঁটি, হাতে গোণা কয়েকটা F-86 Sabre জেট।

এই যুদ্ধ বুঝিয়ে দিল, পূর্ব পাকিস্তানকে স্রেফ একটা উপনিবেশ ছাড়া পাকিস্তান কিছুই ভাবে না। এখান থেকে তারা শুধু শুষে খেতে চায়, বিনিময়ে এর সুরক্ষা দিতে সামান্য উৎসাহীই নয়। ভাবেন তো, ৬৫তেই যদি ভারত পূর্ব পাকিস্তান দখল করে নিত?

ষাটের দশকের শুরু থেকেই, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপকেরা তথ্য-উপাত্ত দিয়ে প্রমাণ করে দিচ্ছিলেন, যে আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গের মুসলিমরা পাকিস্তান রাষ্ট্রে সামিল হয়েছে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় বড় ভূমিকা রেখেছে; তারাই শোষিত-বঞ্চিত। 

অর্থনীতির মূল ভরসা যে রিজার্ভ, তার পুরোটাই জমা থাকত পশ্চিম পাকিস্তানে। এমনকি এই অঞ্চলে সংগৃহীত রাজস্ব ও কর এই অঞ্চলের উন্নয়নে কীভাবে ব্যবহার হবে, তাও ঠিক হতো পশ্চিম পাকিস্তানে। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তো দূর, সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার পরও সরকারি চাকরিতে পূর্ব পাকিস্তানিদের সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ ৩৫ শতাংশ, ৬৫ শতাংশই চাকরি পেত পশ্চিম পাকিস্তানীরা। তাও অসন্তোষ দানা বাধার কারণে হারটি বাড়াতে বাধ্য হয়ে এই পর্যায়ে যায়। সেনাবাহিনীতে সেটা ছিল মাত্র ৫ শতাংশ।

এই বৈষম্য থেকে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে শেখ মুজিব ছেষট্টির ছয়দফা ঘোষণা করেন। যেখানে আলাদা রিজার্ভ, আলাদা মুদ্রা ও অর্থনীতি-ব্যবসাবাণিজ্য, রাজস্ব থেকে আয় স্বাধীন অঙ্গরাজ্য হিসেবে নিজেরাই ব্যবহার করার পূর্ণ স্বাধীনতা…এই দফাগুলো ছিল। এটাও মোটামুটি আপনারা জানেন। যেটা নিয়ে লেখা হয় না, সেনাবাহিনীর একটা অংশ কিন্তু সত্যি সত্যি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল বৈষম্যবঞ্চনা থেকে। এদের নেতৃত্বে ছিলেন লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন।

তার এই গোপন তৎপরতা ফাঁস হয়ে যায়। তাদের এই রাষ্ট্রদোহিতা ও ছয়দফা দুটিকে এক করে হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। শেখ মুজিব, মোয়াজ্জেমসহ এই মামলার আসামীদের ফাঁসির রায় যখন প্রায় নিশ্চিত, সেই সময়ই আসে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান। আইয়ুব খানের পতন হয়। আসে ইয়াহিয়া। আসে সত্তরের নির্বাচন।

সেখানে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্টতা পাওয়ার পরও ক্ষমতা দিতে শুরু হয় টালবাহানা। কেন, কারণ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষেরা শাসন করবে, এটা নাক উঁচু পশ্চিম পাকিস্তানিরা মানতেই পারছিল না। ক্ষমতা হস্তান্তরের নামে বৈঠক ডেকে গোপনে ধীরে ধীরে এখানে সেনাবাহিনীর সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছিল। এল ২৫ মার্চ, এল একাত্তর।

বাকি ইতিহাস আপনারা মোটামুটি জানেন। এত সংক্ষেপে এত বড় ইতিহাস বলা প্রায় অসম্ভব। তবু চেষ্টা করেছি।

সামারি বলি: ইংরেজ শাসিত ভারতে সরকারি চাকরিতে হিন্দুদের ছিল একক আধিপত্য। তারা শিক্ষায় এগিয়ে ছিল। ইংরেজিও ভালো জানত। মুসলিমরা দেখেছে, তারা অনেকভাবেই সুবিধাবঞ্চিত। আলাদা রাষ্ট্র হলে সেই বৈষম্য থাকবে না। কিন্তু আলাদা রাষ্ট্রের পরও পূর্ববঙ্গের মুসলিমরা দেখল, যে লাউ সেই কদু। এমনকি নিয়মতান্ত্রিক নির্বাচনে জেতার পরও তারা ক্ষমতা পেল না।

পাকিস্তানিরা বরাবরই বাঙালি মুসলমানকে নিম্নস্তরের মুসলমান ভাবত। বাঙালির খর্বকায়, দুবলো শরীর নিয়ে হাসিঠাট্টা করত। বাঙালি মাছ কীভাবে খায়, এটা নিয়েও মজা করত। আরও পরিষ্কার করে বললে, বাঙালির শরীর থেকে মাছের আঁশটে গন্ধ তাদের ঘেন্না লাগত।

স্বাধিকার-স্বাধীনতা বড় কঠিন শব্দ। বাংলার মেহনতি জনতা তা বোঝে না। তারা বোঝে মুক্তি শব্দটা। পেটের ক্ষুধা থেকে, দারিদ্র থেকে, অসুখ হলে ওষুধ কিনতে না-পারার, চিকিৎসা না-পাওয়ার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি। চাষার ছেলেটা, সঞ্চয়হীন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেটা একদিন, বেশি বেতন না হোক, ভদ্রগোছের চাকরি পাবে—এই পথের সামনের বাধা থেকে মুক্তি। একাত্তর ছিল সেই মুক্তিরই সংগ্রাম।

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে কী হয়েছে। যেমন ধরেন, আমরা নিজেদের একটা ক্রিকেট দল পেয়েছি। সেই ক্রিকেট দল যেমন পাকিস্তানকে বহুবার হারিয়েছে, অর্থনীতিতেও আমরা এখন পাকিস্তানকে হারিয়ে দিয়েছি। আজকের হিসাবেই বাংলাদেশি ১ টাকার মুদ্রামান = পাকিস্তানের ২.২৯ রুপি। বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) এখন ২ হাজার ৬২১ ডলার। অন্যদিকে ভারতের ২ হাজার ৬১২ ডলার এবং পাকিস্তানের ১ হাজার ৪৭১ ডলার।

ভাই রে, একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা যে কী, সেটা ফিলিস্তিনিদের দিকে তাকায় বোঝেন। আমরা সত্যি ভাগ্যবান আমাদের একটা রাষ্ট্র আছে। ধীরে হলেও আমরা উন্নতি করছি।

আশা করি কেন কীভাবে আমরা বিজয় পেলাম আপনারা বুঝেছেন। এখন যে আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে এই বাংলাদেশ নির্মাণ হয়েছে, সেটাও যেন বৈষম্যের আরেক কারাগার না হয়। আসেন, সবাই মিলে সেই ন্যায্য বাংলাদেশ গড়ি।

বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা।

১২৯ পঠিত ... ২২:৩৮, ডিসেম্বর ১৬, ২০২৫

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top