লেখা: আরিফ রহমান
শেখ হাসিনার পুংবর পুত্র সজীব ওয়াজেদের আজকের স্ট্যাটাস পড়ে আমার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সাদুল্লাহর লেখা 'ইস্ট পাকিস্তান টু বাংলাদেশ' বইটার কথা মনে পড়ল।
জয় লিখেছেন—তথাকথিত 'জুলাই দাঙ্গা'য় যারা ভুল করে অংশ নিয়েছিল তাদের প্রতি তার নাকি কোন ক্ষোভ নাই। তারা নাকি আমাদের ক্ষমা করে বুকে টেনে নিতে রাজি আছে।
তো ব্রিগেডিয়ার সাদুল্লাহের কাহিনী বলি। ভদ্রলোক ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে পূর্ব বাংলায় পোস্টিং নিয়ে আসছেন। আইসা বাংলাদেশ ঘুরতে গিয়ে দেখেন বিভিন্ন স্কুলের সামনে শহীদ মিনার। ভদ্রলোক বর্ণনা দিচ্ছেন—
'হাইস্কুল পেরুবার সময় আমরা দেখলাম একটা শহীদ মিনার। এই জিনিসটা কি জিনিস একটু বর্ণনা দেয়া যাক, কোথাকার কোন ভাষা আন্দোলনের সময় নাকি ঢাকার দুই-তিনজন ছাত্র মারা যায়, তারপর থেকেই হিন্দুয়ানী বাংলার স্কুলে স্কুলে শহীদ মিনার গজায়। মিনারের পাদদেশে আছে একটি কবর। প্রতিদিন সকালে মিনার প্রদক্ষিণ একটা রিচুয়াল। খালি পায়ে, হাতে ফুল নিয়ে প্রভাতফেরিতে অংশ নিতে হয়।'
আপনি আমি তো বাংলাদেশে ৫৪ বছর ধরে আছি, আমরা সবাইই জানি শহীদ মিনারে কোন কবর নাই আর কোন স্কুলেই এটার চারপাশে ঘোরার রিচুয়াল নাই।
বাঙালির উপরে এরকম বহু মিথ্যা অব্জারভেশন চালিয়ে দিয়ে তাকে হিন্দু এবং নিধনযোগ্য প্রমাণ করে তারপর গোটা একাত্তর জুড়ে নিধন করেও যখন বাঙালির হাতে পরাজিত হয়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী, জামায়াত আর আলবদরকে পালাতে হয়েছিলো ইদুরের মতো- একটু মনে করে দেখেন- সেসময় তাদের আলাপ কি ছিলো?
সাদুল্লাহ লিখেছেন, স্কুলে স্কুলে হিন্দুদের প্ররোচনায় শহীদ মিনার থাকলেও অধিকাংশ মানুষ ধর্মপ্রাণ মুসলমান। অনেকে ভারতের প্ররোচনায় ভাষা আন্দোলন করলেও পরে ভুল বোঝে।
ঠিক যেমন সজীব ওয়াজেদ বলেছেন অনেক মানুষ ভুল তথ্য শুনে তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল, এখন ভুল বুঝতে পারছে।
খেয়াল করেন বাঙালি জাতির উপর পঞ্চাশ বছরে দুইবার গণহত্যা পরিচালনা করা হয়। একবার ১৯৭১ সালে একবার ২০২৪ সালে। দুইবারই যারা গণহত্যা পরিচালনা করেছে তাদের টোন, তাদের যুক্তি, তাদের ব্লেইমিং এটিচিউড একই রকম।
একাত্তরে পরাজয়ের পর পাকিস্তানে পালায় রাজাকার সর্দার গোলাম আজম, প্রথমে পাকিস্তানে এরপর পাকিস্তান থেকে লন্ডনে। সেখান থেকে চালু করে 'পাকিস্তান পুনঃরুদ্ধার কমিটি'। আশির দশকের শেষভাগ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে দেশে বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানের সাথে যুক্ত করার জন্য শক্ত লবিং করে। বিভিন্ন দেশে চিঠি পাঠায় বাংলাদেশকে যেন স্বীকৃতি দেয়া না হয়।
একেবারে সেইম কায়দায় আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতারা এখনো পলাতক শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী সম্বোধন করে। বিভিন্ন দেশের কাছে চিঠি পাঠিয়ে বলে সরকার উৎখাত করতে। আমাদের এককালের বড়ভাই ব্যারিস্টার নিঝুম মজুমদার দেখলাম একটা ভারতীয় টেলিভিশনে বলছেন ভারতীয় সেনাবাহিনী যেন বাংলাদেশে আক্রমণ চালিয়ে বাংলাদেশ দখল করে নেয়। গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডাক্তার ইমরান এইচ সরকারও ভারতকে আহ্বান জানান বাংলাদেশের সমস্যা মীমাংসা করে দিতে।
একেবারে খাপে খাপে গোলাম আজমের ভূমিকায় অবতীর্ণ আওয়ামী লীগের এক্টিভিস্টেরা। অবাক লাগে না?
ঠিক এরকম আরেকটা বিষয় হইতেসে শহীদ সামান্যীকরণ। হাসিনার সমর্থকেরা একশ পুলিশ হত্যা হয়েছে- দিয়ে শুরু করে বাড়াতে বাড়াতে তিন হাজার পুলিশ হত্যাকান্ডে নিয়ে গেছে, কিন্তু নিজেরা জুলাইতে কোন হত্যাকাণ্ড করেছে স্বীকার করে না। অথচ অন্তত এক হাজার ভিডিও ফুটেজ বহাল আছে তাদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের। সেইসব ভিডিওতে তারা হাসে। মজা নেয়। নোংরামি করে।
একইভাবে দেখবেন জামাতিরা একাত্তরের শহিদের সংখ্যা কমাতে কমাতে পঞ্চাশ হাজারের নিচে নিয়ে আসতে চায়, কিন্তু বিহারি হত্যাকাণ্ডের কথা উঠলেই তিন লাখের নিচে নামতে রাজি না। মজার ব্যাপার হচ্ছে যেই গবেষকের বরাতে একাত্তরে বিহারি হত্যাকাণ্ডকে তিন লাখ দেখানো যায় (রুডলেফ জোসেফ রামেল, স্ট্যাটিস্টিকস অফ ডেমোসাইড) সেই একই গবেষক বলেন একাত্তরে বাঙালি হত্যা হয়েছে তিরিশ লাখ। ঐটা আবার তাদের ভালো লাগে না।
একই ভাবে আওয়ামী লীগও জাতিসংঘ রিপোর্টের যেই অংশটা ৫ আগস্টের পরের তিনদিনের সহিংসতার কথা বলে ওই অংশ নিয়ে সোচ্চার- কিন্তু জাতিসংঘের রিপোর্টের প্রাণভ্রমরা যেই সাধারণ, বেসামরিক, নিরস্ত্র ছাত্র হত্যার খতিয়ান—সেটা নিয়ে কোনো আলাপ করে না।
আরে ভাই জাতিসংঘের প্রচ্ছদের রিকশায় যেই ছেলেটার লাশ—সেই শহীদ নাফিজ কি পুলিশের লোক, নাকি আওয়ামী লীগ করতেন?
বাংলা মায়ের দুর্ভাগ্য নিজের দেশের মানুষের হাতেই তার সন্তানদের বারবার মরতে হয়েছে।
বছর ঘুরে জুলাই আবার এসেছে। অনেক হতাশা আছে, অনেক না পাওয়া আছে, অনেক দুঃখ-লজ্জা-ক্লেদ আছে। একজন জুলাই শহীদের কন্যা বাবার কবর জিয়ারত করে ফেরার পথে ধর্ষিত হয়েছে, পরে আত্মহত্যা করেছে। তারপর সেদিন মুরাদনগরে সংখ্যালঘু নারীটির উপর চরম নির্মমতা- জেলায় জেলায় মব, পিটিয়ে মানুষ মেরে ফেলা। এইসব লজ্জা আমরা কোথায় রাখব?
হতাশা আছে, দুঃখ আছে, অনেকবার মাথা নিচু হয়ে যাওয়া আছে- এইসব ক্লেদ নিয়েও জুলাই আমাদেরই। জুলাইকে ডিজওউন করে বাংলাদেশে আর এক কদম সামনে হাঁটা যাবে না।
জুলাই শত্রু চেনায়...
জুলাই বাংলাদেশকে ফেরায়...
পাঠকের মন্তব্য