প্রথম পর্ব
জুলাই বিপ্লবের পর নতুন যে সমাজ গড়ার কথা কল্পনা করা হয়েছে; তার শুরুটা ঠিক কীভাবে করা যায়?
এর উত্তর খুবই সহজ। আমাদেরকে রেগে গেলে কী ভাষায় কথা বলতে হয়; সেটা শিখতে হবে। এটা শিখতে হবে এ কারণেই যে; কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা পারিবারিক ও সামাজিক পরিবেশ আমাদের ক্রোধ প্রকাশের ভাষাটা শেখাতে পারেনি।
যে কারণে রেগে গেলে ফইন্নির ঘরের ফইন্নি, ছাপড়ি, ক্ষ্যাত, বাঙ্গি, ইতর, শূয়োর, ছাগু, চাড্ডি, টোকাই ইত্যাদি গালি বেরিয়ে আসে; আর সেইসঙ্গে চ বর্গীয় বা এফ শব্দের গালি বেরিয়ে আসে আমাদের মুখ থেকে।
এসব গালি বেরিয়ে আসে নিজেকে উৎকৃষ্ট বা সুপিরিয়র আর অন্যকে ইনফেরিয়র বা নিকৃষ্ট প্রমাণের জন্য। মুশকিলটা হচ্ছে যেটা প্রমাণ করতে হয়; এত কসরত করে; সেইখানে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়ে পড়ে।
বাংলাদেশের দুর্নীতি বিপ্লবের বেনিফিশিয়ারি হিসেবে আমরা ফইন্নি থেকে বড়লোক হয়েছি। যোগ্যতা দিয়ে কোনো কিছু অর্জন তো করিনি। ফলে একটু টাকা-পয়সার মুখ দেখলেই আমরা অপরকে ফইন্নি বলে গালি দিই।
এই তো বৃটিশ-পাকিস্তান আমলেও আমরা ছাপড়ায় বসবাস করতাম। ফলে রাজনৈতিক পরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে আমরা যখন পাকা দালানে উঠলাম; তখন আমাদের মাথা খারাপ হয়ে গেলো, অন্যকে ছাপড়ি বলতে শুরু করলাম।
আমাদের দাদা-নানা ও প্রপিতামহেরা গর্বিত কৃষক ছিলেন। শস্যক্ষেত্রে সোনা ফলিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়েছেন; মানুষের মুখে অন্ন তুলে দিয়েছেন। বৃটিশ উপনিবেশ ও মিডলম্যানেরা আমাদের শেখালো কেরানি হওয়া উতকৃষ্ট, আর কৃষক হওয়া নিকৃষ্ট। তখন নব্য কেরানির মেয়েরা ঠোঁট ফুলিয়ে অন্যদের ক্ষ্যাত বলতে শুরু করলো। সিনেমার নায়িকাদের বেশ ভূষা দেখে শিখে চাষার নাতনি স্মার্ট হয়ে চাষা শব্দটিকে গালাগালে রুপান্তর করলো।
অধুনা একটু ইংরেজি শিখে পশ্চিমা এটায়ার পরে চুইংগাম খেতে শিখলে স্বজাতিকে বাঙ্গি বলে গালি দিতে ইচ্ছা হয়। অথচ যতই পশ্চিমা পোশাক পরি; জাতে তো আমরা বাঙ্গিই। হঠাত শীতকালে পায়ে লোশন দেয়া শিখেছি; কিন্তু আমাদের ডিএনএ-র শীতকালে পা বাঙ্গি ফাটাই থাকতো। কাজেই কাকে তুচ্ছ করছি আমি; এভাবে ঠিক কত ওপরে উঠতে পারবো।
আমরা যখন অন্যকে ইতর বলি, তখন নিজের ভেতরের ইতরতা ফুটে ওঠে। আমার বউ পারসোনায় ঘষামাজা করে কেইট উইন্সলেট হয়ে ঘুরছে; ছেলে-মেয়ে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে ইংরেজি ফুটাচ্ছে আর নিজে জর্জ ক্লুনি সেজে ঘুরছি বলেই কি রাতারাতি নিজে উতকৃষ্ট মানুষ আর অন্যে ইতর হয়ে গেছে! এটা নিতান্তই ভুল ধারণা; দালাল-ফড়িয়া-মধ্যস্বত্বভোগী ডিএনএ-র চেয়ে বড় ইতর আর নেই। আজকের যে অসম সমাজ; ধনী দরিদ্র্যের বিশাল ব্যবধান; গাড়িতে আমার ছেলে খেলনা হাতে বসে; আর গাড়ির জানালায় সে খেলনার দিকে তাকিয়ে থাকা ছিন্নমূল শিশু; আমাদের বাপ-দাদা কিংবা আমি সুবিধাভোগী সমাজের অংশ বলেই আজ আমার শিশুটি নধর গোলগাল আর ঐ শিশুটি হাড্ডিসার।
ফেসবুকে শুয়োর বলছেন কাকে? ও তো কখনো পার্টির দালালি করেনি, অমুক সরকার বারবার দরকার বলে গলে পড়েনি; অমুক ভাই তমুক ভাইয়ের সঙ্গে ছবি দিয়ে বর্তে যায়নি। ও তো বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা সংস্কৃতি অঙ্গন থেকে হিপোক্রেসি শেখেনি; তাই সে স্পেডকে স্পেড বলে। সারাজীবন আমরা রুলিং এলিট থাকবো; প্রত্যেক মন্ত্রীসভায় আত্মীয়-বন্ধু থাকবে; তেলে মাথায় তেল দিতে থাকবো; পরিবর্তনকে ঠেকিয়ে রাখবো কথার মারপ্যাঁচে, আর সেই সত্যটা বললেই তাকে শূয়োর বলতে হবে। আসলে অন্যকে শূয়োর ডাকার সময় নিজের ঘোঁত ঘোঁত শুনতে পাইনা আমরা।
ইউনিভার্সিটির হলে সবুজ লুঙ্গি পরে বুড়িগঙ্গার ডাইল খেয়ে সংস্কৃতি শিখতে যেতাম; আর আজ তেলাঞ্জলি দিয়ে একটু এফলুয়েন্স অর্জন করে, অন্যকে টোকাই বলে ডাকছি। ছ এর উচ্চারণটা হয়না দেখে বলসি, খাইসি, বলসি বলে খুব একেবারে ট্রেন্ডি হয়ে উঠছি; টোকাইরা তো এমনই হয়। তারা এফলুয়েন্ট লাইফের বৈশিষ্ট্য, পোশাক, কথা বলার ভঙ্গি টুকিয়ে একটা কিছু হয়ে ওঠে। আচ্ছা আমাদের এতো কিছু হতে হয় কেন! যারা ঢাকা টু কলকাতা কালচারাল টুর করেছেন; কিংবা ভাগ্য ভালো হলে ঢাকা টু ইউরোপ কালচারাল টুর করেছেন; তারা কি কখনো দেখেছেন ওখানে কেউ কিছু হবার জন্য ডিগবাজি দিচ্ছে? শ্রেষ্ঠ হওয়া-সেরা হওয়া-প্রথম হওয়া-তাক লাগিয়ে দেয়া; এইসব রোগ মনোবিকার তৈরি করেছে বলেই মানুষকে টোকাই বলে তুচ্ছ করার অসভ্য আচরণ আমরা করি।
এই যে যারা অপরাধীর গলায় জুতা ঝুলিয়ে চড় দিয়ে ভাবছেন ন্যায় বিচার কায়েম করছেন; তারা কি জানেন, যে অপরাধীদের গলায় জুতার মালা পড়াচ্ছেন ও চড় দিচ্ছেন; এরাও দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিবর্তনের বাঁকে বাঁকে সেসময়ের অপরাধীদের গলায় জুতার মালা পরিয়েছিলো বা চড় দিয়েছিলো। আমাদের সমাজে চক্রাকারে এই ঘটনাটা ঘটতে থাকে। নিউটনের তৃতীয় সূত্র হচ্ছে, প্রত্যেক ক্রিয়ার একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে। সুতরাং আপনি যদি এই গলায় জুতা পরানো ও চড় দেয়া বন্ধ না করেন; আপনার জীবনেও এটা ঘটবে আরেকটি রাজনৈতিক পরিবর্তনের পরে। সুতরাং ঐ চেইন রিএকশানের ট্র্যাডিশন এখানেই ব্রেক করে; বরং বিচার ব্যবস্থার সংস্কারে আন্দোলন করুন; যাতে বিচার বিভাগের মাধ্যমে ন্যায়বিচারের ব্যবস্থাটা গড়ে ওঠে।
এই যে আজ আপনাকে যারা মব বলছে; এরা ছিলো এর আগে ক্ষমতায় থাকা দলগুলোর মব। এরা ক্রসফায়ার ও গুমে হাততালি দেয়া মব। জঙ্গীবিরোধী নাটকে আটক ব্যক্তিকে উটের ডিম দিতে চাওয়া মব; লাইলাতুল ইলেকশনে আঙ্গুলে ভুয়া ভোট দেয়ার কালি মেখে ফেসবুকে ছবি দেয়া মব, অন্যায় দেখে চুপ করে অন্যায় ঘটতে দেয়া মব; আর এদের জীবনের খাওয়া ও পরা জড়িয়ে গিয়েছিলো ক্ষমতাসীনের অন্যায় দেখে চুপ করে থাকা ও ইনিয়ে বিনিয়ে জাস্টিফাই করা মবহুডে। এখন সে ক্ষমতা হারিয়ে বৃথা ভদ্রলোক সাজার চেষ্টা করছে, কথায় কথায় মব শব্দটা উচ্চারণ করে বড্ড গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের রুদালি সাজতে চাইছে। মনে রাখতে হবে, আজ যে মব কাল সে করে ক্ষমতাসীনের ডার্টিজব। সুতরাং তাদের পরিণতি দেখে সাবধান হতে হবে। মব হবেন না; তাহলেই ক্ষমতাসীনের ডার্টি জব করতে হবে; পরে কোন রাজনৈতিক পরিবর্তনে অপরাধী হলে নতুন প্রজন্মের লোক এসে গলায় জুতা পরালে তখন সারিন্দাদের নিয়ে শতমুখে মব মব করতে হবে।
এই দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এই যে দালালি করে যারা ৫৪ বছরে জীবনের ফুল ফুটিয়েছে আর গতরে চর্বি জমিয়েছে; তারা দেখবেন দালালি হারিয়ে অন্যকে দালাল বলে ডাকছে। সমকালের ভারতের কোলাবরেটর যেমন আগ বাড়িয়ে লোকজনকে ৫৪ বছর আগের হারিয়ে যাওয়া অতীত ও ভৌগলিক দূরত্বের পাকিস্তানের রাজাকার বলে। দালালস্য দালাল মাত্রই মনে করে দালালি ছাড়া গাড়ি বাড়ি ভুঁড়ি অর্জন করা যায় না। যেদিন নিজের শ্রম-মেধা ও যোগ্যতার ওপর বিশ্বাস ফিরে আসবে এ সমাজে, সেইদিন সভ্যতা ফিরে আসবে। দালালি শব্দটা যেদিন নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে; বুঝবেন সমাজ পরিবর্তন হয়ে গেছে; মানুষ তখন সততার অন্নে লালন করবে সন্তান। সন্তানের বয়েসীদের জন্য একটি সুন্দর সমাজ রেখে যাওয়াই আমাদের সংকল্প।
(চলবে)
পাঠকের মন্তব্য