মোহনলাল, যোগেন মণ্ডল ও দীপক গোস্বামীর কথা

৬০ পঠিত ... ১৭:১৭, জুন ২৩, ২০২৫

আজ পলাশী দিবসে দেশপ্রেমিক মোহনলালের কথা মনে পড়ছিলো; যিনি লড়েছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাদলের বিরুদ্ধে। কোম্পানির কোলাবরেটর মীরজাফর, জগতশেঠেরা যখন দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বৃটিশদের হাতে তুলে দিতে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত; তখন একমাত্র মোহনলালকেই পাশে পেয়েছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা।

অভয়নগরে হিন্দুপাড়ায় দলান্ধদের ত্রাস নেমে এলে; লালমনিরহাটে হিন্দু-পিতা-পুত্রকে ধর্মান্ধরা লাঞ্ছিত করলে; মনে পড়ে দেশপ্রেমিক মোহনলালের কথা কিংবা তার জাতিস্মর যোগেন মণ্ডলের কথা যিনি বৃটিশ কোলাবরেটর হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে মুসলিম লীগের পক্ষে রাজনীতি করেছিলেন। যিনি ভারতের অন্তর্ভূক্তি থেকে ১৯৪৭ সালের পূর্ববঙ্গকে বাঁচাতে জীবনপণ করেছিলেন।

কিন্তু বঙ্গে যেরকম বৃটিশ কোলাবরেটর হিন্দু জমিদার ছিলো, পাঞ্জাবে ঠিক সেরকম বৃটিশ কোলাবরেটর মুসলমান জমিদার ছিলো। ফলে নিম্নবর্গের হিন্দু তকমা দিয়ে কলকাতার জমিদার যেমন যোগেন মণ্ডলদের ওপর নিপীড়ন করেছিলো, লাহোরের জমিদারেরা ঠিক তেমনি হিন্দু তকমা দিয়ে যোগেন মণ্ডলকে ভয়ভীতির মুখে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছিলো।

কলকাতার হিন্দু জমিদারেরা আমাদের বাঙালি বলে স্বীকৃতি দেয়নি; লাহোরের মুসলিম জমিদারেরা আমাদের মুসলমান বলে স্বীকৃতি দেয়নি। ইনফেরিয়রের সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স-এর কোন ধর্ম থাকে না; এ হচ্ছে মানসিক রোগ বিশেষ।

ইসলাম ও হিন্দু ধর্ম উভয়েরই সমন্বয়ী ধর্ম। কিন্তু কথিত আশরাফ মুসলমান ও ব্রাহ্মণ হিন্দুর ভ্রান্ত আর্য কল্পনা বাংলাদেশের হিন্দু ও মুসলমানদের বিভ্রান্ত করেছে। ভাইয়ের বিরুদ্ধে ভাইকে লড়িয়ে দিয়ে ওয়াহাবি ইসলামপন্থার  উদগাতারা বাংলাদেশের মানুষকে মিসকিন ডেকেছে, জয় শ্রীরাম হিন্দুত্ববাদের উদগাতারা আমাদের কাঙ্গলাদেশ ডেকেছে।

অথচ বাংলাদেশের এক শ্রেণীর লোক কট্টর ইসলামপন্থা ও কট্টর হিন্দুত্ববাদের দীক্ষা নিয়ে বন্ধুত্বের বাতাবরণকে শত্রুতায় রুপান্তর করেছে। একই জমিনের মানুষ অথচ ধর্ম পরিচয়ের ছদ্ম বিভাজনে বিদ্বেষ উন্মুখ। আসলে ধনী ও দরিদ্রের বিভাজনই যে একমাত্র বিভাজন; সেই সত্য লুকিয়ে রাখতে এইসব ধর্মের নামে দলাদলি।

সংখ্যাগরিষ্ঠের ভুল অহংকার বাংলাদেশের দারিদ্র্য সীমার নীচের মুসলমানদের লুকিয়ে রাখে। ভারতে যে অহংকার দিয়ে দারিদ্র্য সীমার নীচের হিন্দুদের লুকিয়ে রাখা হয়েছে।

ভারত সমর্থিত আওয়ামী লীগের ফ্যাসিজমকালে যে সংখ্যক মুসলমান অখণ্ড ভারত পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করেছে; জনসংখ্যার অনুপাতে সে সংখ্যক হিন্দু ভারতের আগ্রাসনকে সমর্থন দেয়নি। আওয়ামী লীগের সাংবাদিক মোজাম্মেল বাবু যখন জয় বাংলা জয় হিন্দ বলে মোদির ধুতি পিন্দেছেন, রাজনৈতিক বিশ্লেষক গৌতম দাস তখন হ্যাঁচকা টানে ভারতীয় ছায়া উপনিবেশের পর্দা ছিঁড়ে ফেলেছেন। আওয়ামী লীগের মুসলমান সংস্কৃতি মামারা যখন ভারতীয় মিডিয়া প্রোপাগান্ডা ফেসবুকে প্রচার করেছে, হিন্দু থিয়েটার কর্মী দীপক কুমার গোস্বামী তখন ভারতীয় মিডিয়া প্রোপাগান্ডাকে চ্যালেঞ্জ করে প্রামাণ্যচিত্র বানিয়েছেন। থোকায় থোকায় মুসলমান সাংবাদিক যখন "প্রশ্ন নয় প্রশংসা করতে এসেছি"-র আসরে শেখ হাসিনার সরকার বারবার দরকার বলেছে, ইউটিউবে পিনাকী ভট্টাচার্য তখন ভারত সমর্থিত হাসিনা শাহীর পতনের জন্য দুর্মর আন্দোলন করেছেন। আওয়ামী লীগের বুদ্ধিজীবীরা যখন হাসিনার উন্নয়ন ঢোল বাজাচ্ছিলো, অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য তখন বলেছেন, মিথ্যার বেসাতির উন্নয়ন বিজ্ঞাপন দ্রুতই মুখ থুবড়ে পড়ে যাবে।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে সাজানো শাহবাগ যখন হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখার নাটক হয়ে দাঁড়ালো; রায় বাড়ির বন্ধুরা তখন প্রত্যাখ্যান করেছিলো এই প্রতিপক্ষের ব্যাংক ও ব্যবসা দখল আর পত্রিকা নিষিদ্ধ করার ফ্যাসিজম। আমাকে জানালো, অপরাধীর শাস্তি দাবি করা ন্যায়বিচারের আকাংক্ষা, কিন্তু অপরাধীর ফাঁসি হলে বিরিয়ানি ও মিষ্টি খাওয়া ক্যানিবালিজমের ক্ষুধা; ওরা এখন মানুষ খাবে।

মনে করে দেখুন আপনার হিন্দু শিক্ষকটি আপনাকে কতটা সস্নেহে পড়াতেন, এলাকার হিন্দু দোকানির কাছে গেলে, আপনি জানতেন ওজনে কম দেবে না, ভেজাল বিক্রি করবে না এই লোকটি। যে উদীচীকে মুসলমান কর্মীরা ভারতের কালচারাল উইং করে তুলেছিলো, হিন্দু কর্মীরা সেই অশুভ চর্চা প্রত্যাখ্যান করে জুলাই-এ প্রতিবাদী হয়েছে; অগাস্টে দ্রোহযাত্রায় শামিল হয়েছে।

একজন মুসলমানের যেমন হজ্জ্ব ও ওমরাহ পালনে সৌদি আরবে যেতে হয়; একজন হিন্দুর তেমনি তীর্থ যাত্রায় ভারতে যেতে হয়। এতে তারা কেউই সৌদি আরব কিংবা ভারতের এজেন্ট হয়ে যায়না। এজেন্ট গাছে ধরে না যে ঝাড়া দিলেই পড়বে।

ফেসবুকে অনুজ প্রতিম সুদীপ্ত বিভু ২০১৪-র প্রহসনের নির্বাচনের পর থেকে জুলাই বিপ্লব অবধি যেরকম ঋজুতার সঙ্গে মোদি-হাসিনার নৃশংসতার প্রতিবাদ করেছে; ব্যাঙ্গ বিদ্রুপে জর্জরিত করেছে; আমি বিস্মিত হয়েছি তার সৎ সাহসে। মোদির আগমন বিরোধী মিছিলে কন্যাপ্রতিম জয়িতা রায় ও আদৃতা রায়ের সাহসী উপস্থিতি দেখে বুঝেছি; আমাদের কন্যারাই সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সক্রিয় থাকবে। আমি পরে জুলাই-এ শহীদ সিলেটের এক হিন্দু তরুণের মায়ের কন্ঠে যখন শুনেছি, হিন্দু-মুসলমান আবার কি; ভেতরে সবার একই রক্ত; আমার অন্য ছেলেরা তো বেঁচে আছে। বাংলাদেশ মাকে খুঁজে পেয়েছি তাঁর ভালোবাসার আঁচলে।

ভারতের মিডিয়া লেন্সে পাকিস্তানের হিন্দুদের দেখে যারা ভেবে বসে; সেখানে হিন্দুরা অত্যাচারিত; ২০১০ সালের পর ইসলামের নামে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সামাজিক ঐক্যের প্রেক্ষিতে সেখানকার বদলে যাওয়া বাস্তবতা জানা দরকার। শেষ বার কয়েকটি হিন্দু পরিবার ভারতে চলে গেলে পাকিস্তান পিপলস পার্টি সরকার তাদের ফেরত আনে। শেষবার মন্দির ভাঙ্গা হলে ইমরান খান এরচেয়ে অনেক বড় করে মন্দির নির্মাণ করেছেন। করাচী ও লাহোরে বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক হিন্দু ধর্মের মানুষ। চিকিতসক হিসেবে হিন্দু ডাক্তারদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। শোবিজে সেই পুরোনো কালের হিন্দু প্রযোজক-পরিচালকের ধারাবাহিকতায় নতুন প্রজন্মেও তাদের অংশগ্রহণ রয়েছে। করাচীতে পুজোর যে মিছিল হয়; তা মহররমের মিছিলের চেয়েও দীর্ঘ। ২০০০ সালের আগে হিন্দুদের ভারতে চলে যাওয়া ও মুসলমানদের পাকিস্তানে চলে যাওয়ার প্রবণতা ছিলো; কিন্তু এরপর এই প্রবণতা হ্রাস পেয়েছে। পাকিস্তানে সংখ্যালঘু নিরাপত্তা আইন প্রযুক্ত হয়েছে। ব্লাসফেমি আইনের ব্যবসাটা প্রায় বন্ধের পথে। ইতিহাসের ভ্রান্তি থেকে পাকিস্তান সমাজ শিক্ষা নিয়েছে বলে মনে হয়। সংসদে সংখ্যালঘুদের সংরক্ষিত আসন ও মন্ত্রীত্ব রাজনীতিতে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছে। অনুভূতিতে আঘাতের দায়ে কোন হিন্দু বা খ্রিস্টানকে লাঞ্ছিত করার চেষ্টা করা হলে ২৪ ঘন্টার মধ্যে অপরাধী মুসলমানদের গ্রেফতারের নিয়ম চালু হয়েছে। পাকিস্তান প্রেক্ষাপট তুলে ধরা জরুরি এ কারণে যে; ভারতের কল্পনার পাকিস্তান থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে হিন্দুদের লাঞ্চিত বা উচ্ছেদ করার কষ্টকল্পনা যেন বাংলাদেশে আর না দেখা যায়।

বাংলাদেশের নাগরিক; এটুকু পরিচয়ই যথেষ্ট হওয়া সভ্যতা। ধর্ম পরিচয়ে কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নাই; আর প্রতিষ্ঠিত ধর্মের মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব কাউকে দেয়া হয়নি। মানুষ মসজিদ, মন্দির, চার্চ, প্যাগোডায় যাবে; সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করবে। মানুষ আর খোদার মধ্যে কোন ধর্মের ম্যানেজার দরকার নেই।

৬০ পঠিত ... ১৭:১৭, জুন ২৩, ২০২৫

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top