ডেড কালচারাল সোসাইটি বনাম এনসিপি

১৪৯ পঠিত ... ১৭:৩৭, জুন ২১, ২০২৫

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্রীদের ২০২৪-এর জুলাই থেকে আজ অবধি পতিত আওয়ামী লীগের সদস্য-সদস্যরা অশ্রাব্য ভাষায় সাইবার বুলি করে চলেছে। এই বিষয়টা নিয়ে কোন প্রতিবাদ চোখে পড়েনি। এর চেয়ে দ্বিগুণ প্রতিবাদ চোখে পড়লো সম্প্রতি একটি ব্যক্তিগত টেলিফোন বার্তা ফাঁস হবার পরে। পতিত স্বৈরাচারের সমর্থকেরা, যারা বৈষম্যবিরোধী তরুণীদের গালাগাল করে; তারা ফেসবুকে নেমে এলো জাতির বিবেক হিসেবে, শালীনতার পরাকাষ্ঠা হিসেবে।

আওয়ামী লীগ আমলে এর সিপি গ্যাং নারীদের যথেচ্ছ অশালীন ভাষায় গালাগাল করতো; তা সম্পর্কে ডেড কালচারাল সোসাইটিতে স্পিকটি নট অবস্থা ছিল। কিন্তু সাড়ে চুয়াত্তর টিভির পঞ্চায়েতি জার্নালে লীগের এমবেডেড জার্নালিস্ট আমানপোর ভাট্টি প্রবীণ ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে অশালীনভাবে 'জামায়াত' তকমা দেয়ায়; ব্যারিস্টার মইনুল মেজাজ হারিয়ে তাকে চরিত্রহীন বলেন। সাংবাদিক যখন দলীয় ক্যাডার হিসেবে টিভি শোতে অশালীন তকমা দেয়; সেটা তো সাংবাদিকের চরিত্র হারানোর পরিচয়। মইনুলকে 'জামায়াত' বলে গালি দেয়া কোন অপরাধ নয়; গালির প্রেক্ষিতে চরিত্রহীন বললে সেটা আওয়ামী নারীবাদীদের আন্দোলনের অংশ হয়ে যায়।

আওয়ামী লীগের এই রাজনীতি অনেক পুরোনো; নারীদেরকে শিকারের টোপ হিসেবে ব্যবহার করা। ক্ষমতা ও দুর্নীতির অর্থ সমাগমের লোভে অনেক নারী স্বেচ্ছায় এরকম টোপ হতে এগিয়ে আসে। আর এই টোপদের পক্ষে সিলেক্টিভ নারীবাদ চর্চা করে; বাংলাদেশের নারীবাদের সবচেয়ে বড় সর্বনাশ করেছে আওয়ামী লীগ।

ভিন্নমতের বুদ্ধিজীবীদের ফেসবুক ইনবক্সে আওয়ামী টোপ নারী পাঠিয়ে আলাপ জমিয়ে; স্ক্রিনশট ফাঁস করে গান্ধা কইরা দেয়াও খুব পরিচিত কৌশল। বলাই বাহুল্য, এই কৌশল কলকাতায় প্রচলিত ঊনবিংশ শতক থেকে। বৃটিশ সাহেবদের প্রমোদের নামে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাকে ভেড়া বানিয়ে কার্যসিদ্ধি অত্যন্ত প্রসিদ্ধ কৌশল।

২০০৯ সালে ভারত সমর্থিত আওয়ামী লীগ ঢাকায় গদিনশীন হলে; সংস্কৃতির নামে হানি ট্র্যাপের টোপ প্রশিক্ষণ কর্মসূচি শুরু হয়। বোম্বের 'উৎসব' চলচ্চিত্রে রেখা যেভাবে ষোলা শৃঙ্গার ও বাৎসায়ন শেখান; সেইভাবে প্রশিক্ষিত হয়ে ওঠে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের বিলাসী জীবনে আগ্রহী তরুণীরা। সেই থেকে হানি ট্র্যাপের খপ্পরে পড়ে রাজনীতিক, সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা আত্মাহুতি দেয়। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার কৌটার মধ্যে প্রাণভ্রমর আটকা পড়লে তখন সার্বভৌমত্ব সার্বভারত্ব হয়ে দাঁড়ায়।

জুলাই-এর বর্ষা বিপ্লবের পর দশ মাস কেটে গেছে; কিন্তু আওয়ামী লীগের প্লে বুক সক্রিয় রয়ে গেছে ভাষারীতিতে ও হানিট্র্যাপে। ৫ অগাস্টের পর যারা হাইব্রিড বিএনপি হলেন, তারা কথা বলছেন আওয়ামী লীগের ভাষায়। ৫ অগাস্টের পর যেসব ইনফ্লুয়েন্সার প্রাইভেট ডিটেকটিভ হয়ে পড়লেন, তারা হানি ট্র্যাপের রিং মাস্টার হয়ে প্রতিপক্ষকে শিকার করে বেড়াচ্ছেন। বলাই বাহুল্য; যারা ৫৪ বছরের পুরোনো ব্যবস্থাটা টিকিয়ে রেখে অতি দ্রুত রুলিং এলিট হতে চান; তাদের সবার প্রতিপক্ষ এনসিপি। এনসিপি তাদের দুধভাতে উতপাত; এনসিপি যাদের দুর্নীতি ও পেশীশক্তির পুরোনো ব্যবস্থার জন্য ঝুঁকি।

এনসিপির অধিকাংশ নেতা-কর্মী জেন জি; অল্প সংখ্যক মিলেনিয়াল। যাদের বয়স ১৬ থেকে ৩৫ এর মধ্যে, তারা নতুন পৃথিবীর বাসিন্দা। এইখানে নারী-পুরুষের ব্যবধান নেই। এরা সবাই পারসন। কাজেই যারা নারী-পুরুষ সম্পর্কের পুরোনো রসায়ন মাথায় নিয়ে বসে আছেন; তাদের চিন্তা দিয়ে নতুন প্রজন্মকে বোঝা অসম্ভব; যে প্রজন্মের ফেসবুকে সকাল বিকাল রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস বদলায়। এই প্রজন্মকে বুমারস, জেনএক্স বা প্রৌঢ় মিলেনিয়ালদের মতো হতে বলা; ইউটোপিয়া ছাড়া আর কিছু নয়।

বর্ষা বিপ্লব শক্তি ও ক্ষমতার পুরোনো মিথ ভেঙে দিয়েছে। এখানে কিশোরী-তরুণীরাই ছিল মিছিলের অগ্রভাগে; ছেলেদের নিরাপত্তা হয়েছে মেয়েরা। গণমাধ্যমে কথা বলার ক্ষেত্রে তরুণীদের কণ্ঠের ঋজুতা ও প্রতীতী আমরা দেখেছি।

কাজেই নারীকে অবলা, স্বর্ণলতা ও লবঙ্গলতিকা বলে আদর করে যেসব সংস্কৃতি মামা এতোকাল তাদের মন ভেজাতে কবিতা লিখেছেন ও গান গেয়েছেন; নারী ঘরের শোভা, ঢাইকা ঢুইকা রাহো বলে যেসব ধর্ম মামা তাদের নিজস্ব সম্পদ করে রাখতে চেয়েছেন; ঐসব মামারা আসলে একেবারেই তামাদি বা ডেট এক্সপায়ার্ড। কারণ আজ ও আগামীটা নারীর। আবহমান কাল ধরে নারী সভ্যতার আকাশটা ওপরে তুলে ধরেছে; অথচ তাদের পেশীশক্তি দিয়ে দমিয়ে রেখেছে লিঙ্গগর্বী পুরুষেরা। একবিংশ শতক সেই পুরোনো ব্যবস্থার পতন ঘটিয়েছে। বাংলাদেশের বর্ষা বিপ্লবে নারী তার সেই জায়গাটুকু অধিকার করেছে, যোগ্যতা দিয়ে। কাজেই এই নারীকে সালিশ বসিয়ে তাকে দোররা মারা, কপালে ছ্যাকা দেয়া, কিংবা কংস মামা হয়ে তার পক্ষে চুক চুক করতে আসাগুলো একবিংশের শরীরে ঊনবিংশের আত্মা। নারী ঐ কংস মামা ও খালাদের সহানুভূতি নেবার জন্য বসে নেই।

আমি নব্বই দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের ছাত্র ছিলাম। ইংরেজি ও বিশ্বসাহিত্য পাঠ যেহেতু বিশ্বনাগরিক মনন তৈরি করে; ফলে নব্বই দশকের ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের তরুণীরা ছিল ক্ষমতায়িত। বর্ষাবিপ্লবের নারীদের দেখে মনে হয়েছে ইন্টারনেট প্রযুক্তি পুরো নারীসমাজকেই ক্ষমতায়িত করেছে। আমাদের ইংলিশ ডিপার্টমেন্টেও রোমান্টিক ও প্রেমিক ছেলেরা ইতস্তত প্রেম প্রস্তাব দিত। মেয়েরা তাদের অত্যন্ত সাবলীলভাবে তাতে না বললেও, নো হার্ড ফিলিংস বলে ঠিকই বন্ধুত্বের সম্পর্কে রয়ে যেত। মেয়েরাও ছেলেদের প্রেম প্রস্তাব দিত, সে ক্ষেত্রে আর্ট অফ সেয়িং নো ছিল শেখার বিষয়। প্রেম প্রস্তাব দিলে বা ডেটিং-এ যেতে বললেই চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করতে হবে; পাড়ার মামা-খালারা চলে আসবে সালিশ বসাতে; এসব কি আধুনিক সমাজে কল্পনা করা যায়। নিজের আনইভেন্টফুল বোরিং লাইফ বলে, অন্যের ব্যক্তিগত জীবনে ঢুকে চাটনি আহরণ করতে হবে; এ কি ভাবা যায়।

আমি আমার ছাত্র-ছাত্রী, ছেলে ও অল্পবয়সী কাজিনদের লাইফস্টাইল দেখি আর তাদেরকে যখন প্রাচীন চিন্তার শিক্ষক, খালু-ফুপা, বড় ভাই-বোনদের হিতোপদেশ দিতে দেখি, আমি মনে মনে হাসি, বোর করছে এদের। ফেসবুকের প্রাচীন চিন্তার বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতি খালু, ধর্ম ফুপা ও সবজান্তা বড় ভাই-বোনেরা বড্ড বোর করছে।

আরেকটা মুশকিল হয়েছে; কিছু বড় ভাই ও বোন পশ্চিমে গিয়ে মাস্টার্স ও পিএইচডি করে একটা কোন চাকরি বাকরি করছে। এরা কিন্তু পশ্চিমের জীবনে আত্মীকৃত হতে পারেনি। সাহা বাড়ির মেয়েটির জন্য অনাবাসী পুজোর অনুষ্ঠান, কাজি বাড়ির ছেলেটির জন্য অনাবাসী ঈদের অনুষ্ঠান, বড় জোর সাহিত্য-সংস্কৃতির ওরস কিংবা জামাই ষষ্ঠী। মাঝে মধ্যে একটা পশ্চিমা গোরার সঙ্গে ছবি দিয়ে বর্তে গেলেও, ইন্টিগ্রেশন সুদূর পরাহত। এরা বাংলা ইংরেজি মিশিয়ে আচরণবিধি শেখাতে আসে। ওখানকার সমাজের কি নিয়ম, অফিসের কি এটিকেট এসব শেখায়।

এরা এতো অনাকর্ষণীয় যে পশ্চিমে কোন ছেলে এদের কফি খেতেও ডাকেনা, কোন মেয়ে অফিসের ডেস্কে বসে ফ্লার্টও করে না। ফলে তাদের কাছে জীবন অনাবিষ্কৃত এক মরুভূমি। এতো বোরিং লোকজনের সঙ্গে কি কেউ মিশতে চায় নাকি।

ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক উপদেশ দুটোই বোরিং। অল্প বয়সী ছেলেমেয়েদের জীবন থেকে শিক্ষা নিতে দিতে হয়। কারো বাণী চিরন্তনী শুনে নির্ভুল জীবনযাপন কে কবে করেছে।

এনসিপির ছেলেমেয়েদের মাস্তি কি পাঠশালা গড়তে হবে। ছেলে-মেয়ে পারসন হিসেবে মিশতে হবে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হোক কিংবা প্রেমের সিদ্ধান্ত হোক; হ্যা বা না বলার ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, ভিন্নমত হলেও - প্রেম না হলেও বন্ধুত্বে থাকতে হবে। সম্পর্কের সুষমা জীবনব্যাপী বন্ধুত্বের উপহার কাছে নিয়ে আসে। সুযোগ পেয়ে আমিও দুটি উপদেশ দিয়ে ফেললাম; বয়স হচ্ছে বোঝা যায়।

(থাম্বনেইলের ছবিতে ডেড কালচারাল সোসাইটি)

১৪৯ পঠিত ... ১৭:৩৭, জুন ২১, ২০২৫

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top