নেতানিয়াহুর স্কিৎজোফ্রেনিয়া

১৪০ পঠিত ... ১৭:১০, জুন ১৯, ২০২৫

আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থার প্রধান রাফায়েল গ্রোসি স্পষ্ট করে বলছেন, ইরান পরমাণু অস্ত্র বানাচ্ছে, এমন কোনো প্রমাণ নেই; ইরাক অভিযানের সময় ওই সংস্থার প্রধান এল বারাদেই স্পষ্ট করেছিলেন, ইরাকে জনবিনাশী মারণাস্ত্র নেই।

জাতিসংঘ প্রধান অসহায়ভাবে যেমন দাঁড়িয়ে দেখছেন, ইসরায়েলের ইরান অভিযান; সেসময় ওই সংস্থা প্রধান কফি আনান দাঁড়িয়ে দেখেছিলেন ব্রিটেন ও আমেরিকার ইরাক অভিযান।

ইসরায়েলের নেতানিয়াহু গোয়েবলসের মতো যেমন একই মিথ্যা একশবার বলে তাকে সত্য প্রমাণের চেষ্টা করছেন; সেসময় আমেরিকার জর্জ ডব্লিউ বুশ একই মিথ্যা একশবার বলেছিলেন।

ইরাক অভিযানের সময়ের সঙ্গে বর্তমান ইরান অভিযানের সময়ের পার্থক্য মিডিয়া বাস্তবতায়। ইরাক অভিযানের সময় সিএনএনের রিপোর্টার আমানপোর ভাট্টি এমবেডেড জার্নালিস্ট হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ট্যাংকের মধ্যে শুয়ে অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন; তোতাপাখির মতো মিথ্যা বলেছিলেন। কিন্তু আজকের বাস্তবতায় সোশ্যাল মিডিয়া ও অল্টারনেটিভ মিডিয়ার বিকাশের কারণে ইসরায়েলের তোতাপাখিদের মিথ্যা কথা আর কেউ বিশ্বাস করছে না।

১৯৪৮ সাল থেকে প্যালেস্টাইনে নাকবা গণহত্যা চালিয়ে; ইসরায়েল তার মানবতাবিরোধী অপরাধ ঢেকে রেখেছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি গণহত্যায় নিহত ইহুদিদের মৃত্যু শোক হলিউডের চলচ্চিত্রে, একাডেমিক পেপারে, গল্প-উপন্যাসে বর্ণনা করে। স্বজন হারানোর বেদনার কথা বলে প্যালেস্টাইনে নারী ও শিশু হত্যার জায়নিস্ট শঠতা ধরা পড়ে যায় সোশ্যাল মিডিয়ার বিকাশের পরে। ফলে জায়নিস্টের মিথ্যার প্রাসাদ ধসে যেতে থাকে। খোদ আমেরিকার এলিট ইউনিভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীরা জায়নিস্ট রাষ্ট্র ইসরায়েলের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ইহুদিরা প্রতিবাদী হয় এই প্যালেস্টাইন গণহত্যার বিরুদ্ধে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি হত্যাযজ্ঞ থেকে বেঁচে আসা প্রবীণেরা বলতে থাকেন, ইসরায়েলের মতো এমন মানবতাবিরোধী রাষ্ট্র আমাদের প্রয়োজন নেই। ইহুদি রাবাইয়েরা আমেরিকার পথে পথে জায়নিজমের নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে উচ্চকিত হন।

বিশ্বজনমত, বিশেষত পরিবেশ কর্মী গ্রেটা থুনবার্গের মতো পশ্চিমা তরুণ প্রজন্মের জায়নিজম বিরোধী অবস্থান নেতানিয়াহুর মতো ক্যানিবাল প্রজন্মকে হতাশ করেছে। সাতটি দশক ধরে চাপিয়ে দেওয়া মিথ্যা ন্যারেটিভ আর কাজ করছে না; এই হতাশা থেকে নেতানিয়াহু ইরান আক্রমণ করে বসেন। এ অনেকটা ফুরিয়ে যাওয়া বাজির শেষ নৃত্যের জিদ। বিশ্বরাজনীতিতে জায়নিজমের প্রমোদ প্রবীণেরা আমেরিকা ও ইউরোপে তাদের বহু ব্যবহারে জীর্ণ ন্যারেটিভে ইরানকে ঝুঁকি হিসেবে উপস্থাপন করছে। কিন্তু পদে পদে তাদের ন্যারেটিভ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে।

২০১৪ সালে হিন্দুত্ববাদী নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নেতানিয়াহুকে ব্রোমান্সে জাপটে ধরে। বজরঙ্গি ভাইজানেরা রীতিমতো ইসরায়েলে গিয়ে প্যালেস্টাইনে হত্যাযজ্ঞের সৈনিক হয়ে পড়ে। গদি মিডিয়ার নারী সাংবাদিকেরা নেচে নেচে তেলআভিভ থেকে বিজয়ী রিপোর্টিং করতে থাকে।

ইহুদি রাবাইদের প্যালেস্টাইনে হত্যাযজ্ঞ বিরোধী অবস্থান থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায়; মুসলিম বিদ্বেষের সঙ্গে যোগসাজশ নেই মধ্যপ্রাচ্য দ্বন্দ্বের। ভূমি দখল, খনিজ সম্পদ লুণ্ঠনের অভিসন্ধি জায়নিজমের পিঠে চড়ে হত্যাযজ্ঞে মেতেছে। কিন্তু মোদির জন্য মুসলিম বিদ্বেষটাই আসল। সে ট্রাম্প-নেতানিয়াহু যাকেই পাক; তাদের কানে মুসলিম বিদ্বেষ ঢেলে দিয়ে আসে।

ইসরায়েলের এক তরুণের ফেসবুক লাইভ দেখছিলাম। সে বলছে, ইন্ডিয়ানরা টুইটারে ফেক আইডি দিয়ে ইরানবিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছে। তরুণটি হাসতে হাসতে বলছিলো, যতই কসরত করো দাদা, ইসরায়েলি মেয়েরা তোমাদের প্রেমে পড়বে না।

গত একটি সপ্তাহে ভারতের গদি মিডিয়া যে ইরানবিরোধী প্রোপাগান্ডা চালিয়েছে; সিএনএন, বিবিসি, ইসরায়েলি টিভি সবাই মিলে তা চালাতে পারেনি। কারণ মুসলিম বিদ্বেষ কেউ যদি শিখতে চায়, তাকে মোদির ভক্তদের কাছে আসতে হবে। তবে ভারতে বিদ্বেষহীন কণ্ঠস্বর রয়েছে; যারা ইরানের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে মোদিভক্তদের সাইবার বুলির মুখোমুখি হয়েছে।

যে কোনো যুদ্ধে প্রথম হামলাটি যে চালায়; তাকেই সমালোচনা করে সাধারণ মানুষ। আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থা ইরানে পরমাণু অস্ত্র বানানোর কোনো প্রমাণ না পাওয়ার পরেও ইসরায়েল হামলা চালিয়েছে ইরানে। সুতরাং ইসরায়েল অপরাধ করেছে, এটা স্পষ্ট। সে শুধু বাইরে থেকেই হামলা চালায়নি; মোসাদের গুপ্তচরদের দিয়ে গুপ্ত হত্যা বা টার্গেট কিলিং করিয়ে চলেছে। বলাই বাহুল্য, ইরানে গ্রেফতার হওয়া মোসাদের গুপ্তচরদের মাঝে ভারতীয়রাও রয়েছে। তা তো থাকবেই; তার যে বাড়তি মুসলিম বিদ্বেষের প্রণোদনা রয়েছে।

আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ইসরায়েলের যে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে অভিযান; একে ক্ল্যাশ অফ সিভিলাইজেশন বলা ভুল সংজ্ঞায়ন। অতীতে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ যেমন ছিলো লুন্ঠনের জন্য অভিযান; হালের আফগানিস্তান, ইরাক, ইরান, সিরিয়া অভিযান ও মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি নব্য উপনিবেশবাদের লুন্ঠন কায়দা বিশেষ।

এসব লুন্ঠনের জন্য পশ্চিমা কালচারাল মামা ও খালাদের দিয়ে ডেমোক্রেটিক ভ্যালুজ, এনলাইটেনমেন্ট, উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট, সেকুলারিজম, লিবারেলিজমের গালগল্প নিয়ে হাজির হয় নব্য উপনিবেশবাদীরা। ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করে গেছে; সেই শিক্ষায় শিক্ষিত হলেই তো পশ্চিমা সাহেব-বিবি-গোলাম সাজার শখ হয় প্রাচ্যের আত্মবিশ্বাসহীন মানুষদের। আমেরিকান ও ব্রিটিশ এমব্যাসিতে দাওয়াত পেলে স্যুট-টাই পরে চলে গিয়ে গলায় ‘ফর সেল’ সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে ঘোরাঘুরি করে। তেহরানেও তাই হয়েছে। ফলে ইসরায়েল অভিযান চালানো মাত্র মোসাদের স্থানীয় চরেরা অন্তর্ঘাত শুরু করেছে।

এই আলোচনায় এটাও উল্লেখ করা দরকার, আমেরিকা ও ব্রিটেনের ইরাক অভিযানের সময় ইউরোপের পথে পথে পশ্চিমারা প্রতিবাদী হয়েছিলো। মানুষ সে প্রাচ্যেরই হোক কিংবা পাশ্চাত্যের হোক; তারা একই রকম। লুন্ঠক রাষ্ট্রের ক্ষমতা কাঠামো ও এর কালচারাল উইং থেকে সেসব দেশের সাধারণ মানুষকে আলাদা করে দেখতে হবে। যুদ্ধ যেন মানুষের প্রতি মানুষের বিদ্বেষ তৈরি না করে।

ইরান আত্মনির্ভর উন্নয়ন কৌশলের দেশ। প্রয়োজনীয় সব পণ্যই তারা দেশে উৎপাদন করে; আর সেসব জিনিসের দাম বেশ সস্তা। ইরানের শিক্ষা ও সংস্কৃতি অত্যন্ত বিকশিত। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে তারা সমসাময়িক বিশ্বের সঙ্গেই আছে। পশ্চিমা মিডিয়া ও ভারতের গদি মিডিয়ার লেন্সে ইরানকে দেখলে তা ভুল হবে। ফলে ইরানকে খুব সহজেই ধরাশায়ী করা কঠিন। ইরানে চীনের বিনিয়োগ রয়েছে; বিনিয়োগ নিরাপত্তার প্রয়োজনে চীন ইরানকে সম্ভব সবরকম সাহায্যই করবে।

ইসরায়েলের ইহুদি কিংবা ইরানের মুসলমান; মানুষের মৃত্যু মানেই সভ্যতার ট্র্যাজেডি। আমরা প্রত্যাশা করবো, ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘টু বি অর নট টু বি’ করতে করতে পিছিয়ে আসবেন লুণ্ঠন পরিকল্পনা থেকে। ইরাকে ব্যবহৃত চিত্রনাট্যে ইরান বধ নেহাত কষ্টকল্পনা বলেই মনে হয়। আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যস্থতায় যুদ্ধ থেমে যাবে বলে প্রত্যাশা রাখি। নেতানিয়াহুর স্কিৎজোফ্রেনিয়া থেকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত না হোক; সভ্যতার প্রচেষ্টা সেটাই হওয়া উচিত।

 

১৪০ পঠিত ... ১৭:১০, জুন ১৯, ২০২৫

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top