যে ছেলেটি শাহবাগে একটি মেয়েকে ‘ওড়না ঠিক করে পরা’র কথা বলে চাকরি হারালো, যে সাংবাদিকটি একটি আবাসিক হোটেলে গিয়ে বিভিন্ন কক্ষে নক করে সেখানে অবস্থানরত নারী-পুরুষকে জেরা করলো তারা স্বামী-স্ত্রী কিনা! আর গত ২৪ ঘন্টা ধরে বেআইনিভাবে ফাঁস হওয়া টেলিফোন আলাপের সূত্র ধরে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও নারীকে বিষাক্ত জিহবার দোররা দিয়ে পেটাল যারা; এরা সবাই একই গোয়ালের গরু। এরা শহরে বসবাস করলেও এদের মস্তিষ্কের মধ্যে রয়েছে ঊনবিংশ শতকের সংশপ্তক গ্রামের বটগাছতলা; যেখানে মাতবর সাহেব, কান কাটা রমজানের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে হুরমতীর কপালে ছ্যাঁকা দিতো।
ডিএনএ-তে অন্যের প্রাইভেসিতে ফুচকি দেয়ার যে নেশা; এরজন্য কাউকে ঠিক দায়ী করা যায় না। কারো নানী-দাদীর অন্যের বাড়ির বেড়ার ফাঁক দিয়ে ফুচকি দেবার অভ্যাস থাকলে; নাতি নাতনি মাদ্রাসায় পড়ুক আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুক; ফুচকি সে দেবেই। কাউকে ওড়না ঠিক করতে বলা, কারও হোটেল কক্ষে গিয়ে বিয়ের কাবিন দেখতে চাওয়া কিংবা বে আইনি কল ফাঁসের সূত্র ধরে ঐ কলে সংশ্লিষ্ট নারী-পুরুষকে বিষাক্ত জিভের ছোবল দেয়া; এসবই যে অনধিকার চর্চা; এই বোধ আসলে কমনসেন্স। কিন্তু শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলো এই কমনসেন্স তৈরি করতে ব্যর্থ হয়। ফলে ডিএনএ-এর অনুশীলনগুলোই ফিরে ফিরে আসে।
ঠিক এ কারণেই ধর্মচিল ও প্রগতিচিল বলে দুটি আলাদা বর্গ তৈরি করে যে কালচারাল ওয়ার চলে; সেটাকে দুই পয়সার মূল্য দিই না আমি। কারণ মাল তো সব একই; অন্যের প্রাইভেসিতে ফুচকি দিয়ে অনধিকার চর্চা করাই এদের বংশগতি।
আপনি লক্ষ্য করে দেখবেন, পরিশ্রমী মানুষের কিন্তু অন্যের ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলানোর সময় নেই। এসব কাজ অলসদের। ঊনবিংশ শতকের নানী-দাদী, মাতবর-কানকাটা রমজান; এরা ছিলো অলস লোক। তাই উকুন তোলার আসর কিংবা পঞ্চায়েতি সালিশ বসিয়ে পরচর্চা ও পরনিন্দা ছিলো এদের প্রধান কাজ। শেখ হাসিনা ঠিক যেরকম ‘প্রশ্ন নয় প্রশংসা করতে এসেছি’-র আসরে পরচর্চা ও পরনিন্দা করতেন আর কান কাটা সাংবাদিকেরা সেখানে বসে ফোড়ন কাটতো।
এসব বদ অভ্যাস খালেদা জিয়া, ড ইউনুস, তারেক রহমান, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের নেতা নাহিদের নেই। এরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশীর প্রতিনিধিত্বশীল। যারা নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।
পুরো বাংলাদেশের প্রত্যন্ত এলাকায় ঘোরাঘুরি করার অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি; মানুষ ভীষণ কর্মব্যস্ত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের ছাত্র হওয়ায় আর সেখানে ছাত্রীর সংখ্যা বেশি হওয়ায়; নারীবন্ধুদের সখ্যে সময় কেটেছে। কক্ষণো সেখানে কানাকানি-ফিসফিসানি কিংবা অন্যের প্রাইভেসিতে ইন্টারফেয়ার করার পশ্চাদপদতা দেখিনি।
নব্বুই-এর গণ অভ্যুত্থানকে ঘিরে সেই শেখ হাসিনা কিছু ছাত্রকে প্রশিক্ষণ দেন, এরশাদের চরিত্রহনন করতে হবে। সেই প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে সংশপ্তকের গ্রামকে নেমে আসতে দেখেছিলাম। এরশাদের সঙ্গে সখ্য আছে এরকম গুজব তুলে বেশ কজন সম্মানিত নারীকে লাঞ্ছিত করা হয়েছিলো টিএসসি এলাকায়। লক্ষ্য করুন, পরে সেই শেখ হাসিনা এরশাদকে বিশেষ দূত বানালেন। তার প্রশিক্ষিত সেই তরুণেরা মাঝবয়সে এসে পাপিয়ার জলসাঘরের খদ্দের হলো। মাঝখান থেকে সেই নারীলাঞ্ছনার ঘটনা রয়ে গেলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলংক হয়ে।
এরশাদকে লম্পট বলে তকমা দিয়ে কবিতা ও গান বাঁধতেন যারা; পরে দেখলাম সেইসব সংস্কৃতি মামার বেশিরভাগেরই অর্ধেক বয়েসী সাধনসঙ্গী ছাড়া চলেই না। যে লোকটি ঢাকার সমাজে নিজেকে অত্যন্ত বিশুদ্ধ চরিত্রের দাবী করে অন্যের চরিত্র হননে ব্যস্ত থাকে, ব্যাংকক কিংবা ইউরোপে গিয়ে বিমান থেকে নেমেই সে লালবাতি এলাকার খোঁজ করে। আর অনেককাল ধরেই যারা দিনের বেলায় লোকজনকে চরিত্র সনদ দিয়ে বেড়ায়; রাতে তারা রমনা থেকে ভাসমান রজনীগন্ধ্যা তুলে নিয়ে গিয়ে শ্যাম্পু দিয়ে স্নান করিয়ে তাকে এসথেটিকস শেখায়।
প্রজন্মের পালাবদলে ভেবেছিলাম সমাজ এইসব হিপোক্রেটের হাত থেকে মুক্তি পাবে। কিন্তু শেখ হাসিনা তার দেড় দশকের সংশপ্তকে হিপোক্রেসিকে ডেমোক্রেসি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেন। সমাজ পেলো বেশ কিছু ধর্মচিল ও পোগোতিচিল; যাদের কাজই হচ্ছে নানারকম পুলিশি করে বেড়ানো। ধর্মচিলকে আমির খসরুর কাওয়ালি গাইতে দেখে, পোগোতিচিলকে ফ্রিডেরিশে নিটশের উবারম্যানের আলাপ করতে দেখে আশা জেগেছিলো; এবার হয়তো ওড়না-কাবিন-টেলিফোন কল ফাঁসের সংশপ্তকের গ্রাম থেকে আমরা ইস্তাম্বুল ও বার্লিনের মতো নন ইন্টারফেয়ারিং উদার চিন্তার সমাজ গড়তে পারবো!
কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের অবাক করে দিয়ে সৃজিত হলো সংশপ্তকের বিজন গ্রাম; যেখানে অন্যের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে রগড় ছাড়া আর কোন বিনোদন নেই যেন। এতো আনসফিস্টিকেটেড মনোজগত পৃথিবীর আর কোন সমাজে আপনার চোখে পড়বে না; একমাত্র ভারতের গদি মিডিয়া ছাড়া। ফলে আনন্দবাজার ও আজতকের অনুকরণে বে আইনি টেলিফোন কল ফাঁস নিয়ে বে আইনি সাংবাদিক কালের কন্ঠ ও কালবেলায় একের পর এক রিপোর্ট করে। আর মন্তব্য ঘরে ডানা ঝাপটায় কানকাটা রমজান ও কালু। দুর্ভাগ্য আমাদের, এক্কেবারে ভারতীয় মিডিয়ার ক্যারেক্টার অ্যাসাসিনেশন কাঁচামালে তৈরি এসব মিডিয়া।
(ছবিতে: সংশপ্তক নাটকের কানকাটা রমজান ও কালু)
পাঠকের মন্তব্য