লেখা: রাজু নূরুল
১৯৯০ সালে ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন কুয়েত আক্রমণ করে বসল। সেই আক্রমণের পক্ষে দেয়া যুক্তিগুলো ছিল মজার। ইরাকের অভিযোগ ছিল, কুয়েত তাদের তেল চুরি করছে এবং কুয়েত আগে ইরাকের অংশ ছিল। তাই তারা কুয়েত দখল করবে।
কিন্তু আসল ঘটনা তা ছিল না। ১৯৮০ সালে শুরু হওয়া আট বছর ব্যাপী ইরাক-ইরান যুদ্ধের পর ইরাক ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে যায়। তখন তারা মূলত কুয়েতের তেল সম্পদে নজর দেয়।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে ইরাক জিতেও যায়। কুয়েতকে দখল করে ওটাকে তাদের সপ্তম প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু পরের বছর আমেরিকার নেতৃত্বে ‘অপারেশন ডেজার্ট স্টোর্ম’ শুরু হয়। সেই অপারেশনের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র ১০০ ঘণ্টা। সেই ১০০ ঘণ্টার যুদ্ধে ইরাকের বাহিনী কুয়েত ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। কুয়েত তার সার্বভৌমত্ব ফিরে পায়।
....
আমি বোধহয় তখন ক্লাস থ্রি/ফোরে পড়ি। আমাদের গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে। গ্রামের মাঝখানে ছোটখাটো একটা বাজার ছিল। এখনও আছে। বাজারের মাঝখানে ছিল মতু ভাইয়ের চায়ের দোকান। তখনও গ্রামে টেলিভিশন যায় নাই। বিকালের দিকে মতু ভাইয়ের চায়ের দোকানে একটা পত্রিকা যেত। কয়েকদিনের বাসি পত্রিকা! সেই পত্রিকা পড়ার জন্য বহু লোক জড়ো হত। মূল উদ্দেশ্য ইরাক-কুয়েতের যুদ্ধের খবর নেওয়া। কিন্তু গ্রামের অধিকাংশ মানুষের অক্ষর জ্ঞান নাই। আব্বা দোকানে যাওয়ার সময় আমাকে নিয়ে যেত সাথে।
পত্রিকার নাম এখন আর আমার মনে নাই। ইত্তেফাক কি? তখন তো এত পত্র-পত্রিকা ছিল না। আমার মনে আছে, চারদিকে গোল হয়ে বসে থাকা উৎসুক মানুষের মাখঝানে বসে আমি পত্রিকা পড়তেছি। হয়তো প্রথম পাতায় এক কলাম দুই ইঞ্চি জুড়ে সেই যুদ্ধ নিয়ে খবর বেরিয়েছে। আমি সেটা পড়তেছি। কয়েক লাইন পড়েই বাকি খবরের জন্য ভেতরের পাতা উল্টাচ্ছি। লোকজনের নিঃশ্বাস আটকে যাওয়ার মত অবস্থা। কিন্তু ওইটুকু খবরে তাদের মন ভরে না। তারা বলতো, ‘খুঁজে দেখ না। আরও খবর আছে কিনা দেখ! আরে ভাল করে দেখ।’
আমি খুব মন দিয়ে লাইন বাই লাইন খুঁজতাম। যখনই বলতাম যে, আর তো নাই। সবার চেহারায় হতাশা নেমে আসত। ব্যাপারটা এমন যে, এইটুকু?
আব্বা বাড়িতে ফিরে আবার রেডিওর নব ঘুরানো শুরু করতো। সারা সন্ধ্যা রেডিও থেকে ঘ্যা ঘ্যা ঘ্র ঘ্র একটা আওয়াজ আসত। ফ্রিকোয়েন্সি পাওয়া যেত না।তখন একটা নাম মুখস্থ হয়ে যায় আমার, পেরেজ দ্য কুয়েলার! জাতিসংঘের মহাসচিব ছিল। স্প্যানিশ নাম। যদিও মূল উচ্চারণটা হওয়ার কথা পেরেজ দ্য ক্যুয়ের! কিন্তু বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঠিকভাবে স্প্যানিশ নাম উচ্চারণ করা তখন বিরাট ব্যাপার! আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, একটা অন্যায্য যুদ্ধে যখনই দেখতাম সাদ্দাম হোসেনের ব্যাপারে দুই চারটা ভাল ভাল কথা লেখা থাকতো, লোকজন হুররে করে উঠত। তালি বাজাত। অথচ দুইটাই তো মুসলমান দেশ! কুয়েত ছোট দূর্বল শান্তিপ্রিয় একটা দেশ!
এটা বুঝে আসতো না যে, কুয়েত হারলে লোকজন খুশি হইতেছে কেন?
পত্রিকাওয়ালারা যুদ্ধ বোঝে। তখনও বুঝত। তারা সাদ্দাম হোসেনরে নিয়ে এমন সব মিথ্যে আজগুবি গল্প ছাপাত যে, বাংলাদেশে তার একটা ইমেজ দাঁড়াইয়া গেল। লোকজন কাউরে প্রশংসা করার সময় বলতো—সাব্বাশ! বাপের ব্যাটা সাদ্দাম… আপনার আশেপাশে দেখবেন, বহু বাংলাদেশী ছেলের নাম সাদ্দাম। খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন, এদের সবার জন্ম নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে। তার কারণ ওই যুদ্ধ! যুদ্ধে অস্ত্র ব্যবসায়ী, খাবার ব্যবসায়ী, রড সিমেন্ট ব্যবসায়ীর মত মিডিয়া ব্যবসায়ীরাও ফুলেফেঁপে কলাগাছ হয়ে ওঠে। টেলিভিশন রেটিং, ইউটিউব ভিউস, ওয়েবসাইট ট্রাফিক ও সোশ্যাল মিডিয়া এনগেজমেন্ট বহুগুণে বেড়ে যায়। ২০০৩ সালে আমেরিকা যখন ইরাকে হামলা চালালো, তখন CNN, BBC-র ভিউয়ারশিপ কয়েক’শ গুণ বেড়ে গিয়েছিল। আর এখনতো ক্লিকবেইটেই পয়সা... ইউটিউবে ভিউ দিয়ে টাকা আসে... তাই যুদ্ধ শুধু মাঠে হয় না। ইউটিউবেও হয়। ফেসবুকের রিলে হয়...
এই ভিউয়ারশিপ বাড়ানোর সবচেয়ে ভাল উপায় হচ্ছে, দুয়েকটা ক্যারেক্টারকে টার্গেট করে তাদেরকে মিথ হিসেবে হাজির করা।
এই যে ধরেন, এখন ইসরায়েল আর ইরানের যুদ্ধকে পুরোপুরিভাবে একটা ধর্মীয় ফ্লেভার দেয়া গেছে। বাংলাদেশের মিডিয়ার দিকে তাকালে মনে হবে না যে, এইটা বুঝি ধর্মীয় যুদ্ধ? যেমন তাদের শিরোনাম, তেমন তার খবরের নিচে দর্শকদের কমেন্ট! অথচ ব্যাপারটা তা না তো!
ইরানে প্রায় ৩ লাখ খ্রিষ্টান আছে। ১২ হাজার ইহুদীর সাথে জরথ্রুস্ট্রী আছে ২৫ হাজার। ইসরায়েলের ১৯% মানুষ মুসলমান। ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ ধর্ম যুদ্ধ না; ওইটা মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্যবাদের যুদ্ধ! বাংলাদেশের মিডিয়ায় প্রতি মুহুর্তে ইসরায়েল সেই যুদ্ধে হারে। নেতানিয়াহু এরই মধ্যে কতবার যে বন্দী হয়েছে... কিন্তু আনপপুলার ওপিনিয়ন হলো, গত তিন দিনে ইসরায়েল ও আমেরিকা মিলে ইরানকে তামা তামা করে দিয়েছে। একেবারে বলে-কয়ে যাদেরকে যাদেরকে মারা দরকার, তাদেরকে মেরে দিয়ে আসছে। খামেনিকে কোনো এক কারণে মারতে চাইতেছে না বলে উনি এখনও বেঁচে আছেন....
ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল উড়িয়ে দেওয়ার জন্য বিশ মিনিট সময় দিয়েছিল। ঊনিশ মিনিটের মাথায় সেটা উড়িয়ে দিয়েছে। বিবিসি সেটা লাইভ দেখাইছে। সত্যটা হলো, শিল্প সাহিত্য সিনেমা আর ঐতিহ্যে এই পৃথিবীর আধুনিকতম দেশগুলোর একটা ইরানকে শেষ করে দেবে এরা... তাই বাংলাদেশের মিডিয়ায় যুদ্ধের খবর পড়ে উল্লসিত হওয়ার দরকার নাই। আপনার লাইক, কমেন্ট আর ধর্মানুভূতি দিয়ে যখন আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য চলা এক যুদ্ধে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হবে না, তখন সবচেয়ে ভাল উপায় হতে পারে মানবিক হওয়া। যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলা!
কারণ, একমাত্র মৃতরা জানে, যুদ্ধে কেউ কোনোদিন জিতে নাই।
পাঠকের মন্তব্য