ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এফ রহমান হলের গণরুমে ঢোকার পরেই জীবনের সবচেয়ে বড় কালচার শক খেয়েছিলাম।
মিডিয়াম সাইজের একটা রুমের পুরো ফ্লোর কয়েকটা তোষক দিয়ে ঢাকা, বালিতে কিচকিচ করছে। এইটাই ফ্লোর, এইটাই বিছানা। এইটুকু রুমে ৩৮ জনের সঙ্গে থাকতে হবে।
আমাদের জীবন ছিল ভয়াবহ মাত্রায় করুণ। যেহেতু হলে উঠতে হতো ছাত্রলীগের আন্ডারে, কাজেই সপ্তাহে তিনদিন রাত দশটায় বাধ্যতামূলক গেস্টরুম হতো। ইমিডিয়েট সিনিয়ররা এসে চোখ রাঙিয়ে মা-বাবা তুলে গালাগাল করতেন আর হুমকি দিতেন।
গালাগালের কারণ একটাই: আমরা ছাত্রলীগের জন্য ডেডিকেটেড না, ছাত্রলীগের প্রোগ্রাম নিয়ে সিরিয়াস না। হুমকিটাও একটাই: ছাত্রলীগের কাজে আবার গাফিলতি ধরা পড়লে হলে থাকতে দেওয়া হবে না।
বড় ভাইরা ঠিক কীসের তাড়নায় এসব করতেন, প্রথমদিকে সেই প্রশ্নের উত্তর আমি বহুদিন পাইনি। কেন সেকেন্ড ইয়ারে পড়া একটা ছাত্র পড়ালেখা বাদ দিয়ে দিনের বেলা ছাত্রলীগের প্রোগ্রামে পড়ে থাকে আর রাতের বেলা গেস্টরুমের নামে জুনিয়রদের সময় নষ্ট করে, আমি বুঝতাম না।
আমি তাদের সবাইকেই ব্যক্তিগতভাবে জিজ্ঞেস করতাম: ছাত্রলীগ করলে মাসে কোনো নির্ধারিত বেতন আছে কি না। ভাইরা উত্তর হিসেবে না বলতেন এবং কেউ কেউ মুখ লুকিয়ে ফেলতেন।
এদিকে, হল থেকে বের করে দেওয়ার ব্যাপারটা কেন একটা ভয়ংকর হুমকি, সেটাও আমার মাথায় ঢুকতো না তখন। হল থেকে বের করে দিলে একজন ছাত্র টাকা খরচ করে মেস ভাড়া নিয়ে থাকবে, এটা তো বরং হলে থাকার চেয়ে ভালো। হল তো এমন কোনো স্বর্ণখনি না যে, এখানে থাকতেই হবে! এরকম তুচ্ছ একটা বিষয় নিয়ে দিনের পর দিন হাস্যকরভাবে হুমকি দেওয়ার কী আছে?
আমার এই দুই প্রশ্নের উত্তর একসঙ্গে পেয়েছিলাম মাগুরার ছেলে বোরহানের কাছ থেকে, চার মাস পর।
বোরহান আমার সঙ্গে এফ রহমান হলের গণরুমে থাকত, ডিপার্টমেন্ট ছিল সমাজবিজ্ঞান। চুপচাপ ঠান্ডা ছেলে। সবাইকে বন্ধু বলে ডাকত, কিন্তু আমার ধারণা, ওর কোনো সত্যিকারের বন্ধু ছিল না।
লিকলিকে, শুকনা, দেখতে কালোমতো বোরহান ছিল ছাত্রলীগের ডেডিকেটেড কর্মী। আমাদের প্রোগ্রাম ছিল দুইবেলা—দুপুরে মধুতে, রাতে টিএসসিতে। বোরহান দুই প্রোগ্রামেই থাকত। যেদিন ওর ক্লাস থাকত, সেদিন প্রোগ্রাম থেকে সোজা ক্লাসে চলে যেত। ক্লাস শেষে আবার প্রোগ্রামে ঢুকে যেত।
চারমাস পরে, মে মাসের এক সন্ধ্যায় বোরহানকে দেখলাম মহসিন হলের মাঠের পাশে রাখা এক ঠেলাগাড়ির উপর মন খারাপ করে শুয়ে আছে, আকাশের দিকে তাকিয়ে, একা।
আমি তখন DUDS থেকে বেরিয়ে হলে ফেরত যাচ্ছি। বোরহানকে দেখে ডাক দিলাম।
সেদিন প্রথম বোরহানের সঙ্গে আমার একটা গভীর কথোপকথন হয়।
দুটো কঠিন প্রশ্নের জট এখানেই খুলে যায় আমার।
কণ্ঠ শুনেই বোঝা যাচ্ছিল, সেদিন বোরহান ছিল ভীষণ বিষণ্ণ।
কিছুক্ষণ কথা বলার পর আমি হালকা সুরে জিজ্ঞেস করলাম, ছাত্রলীগের ডেডিকেটেড কর্মীর মন খারাপ কেন আজকে?
বোরহান ঠেলাগাড়িতে শুয়ে আবার আকাশের দিকে তাকাল। বলল, জানিস বন্ধু, আমার এসব ভালো লাগে না।
– কোনসব?
– এই যে, রোজ দুই বেলা প্রোগ্রাম, রাতের বেলা গেস্টরুম, গালিগালাজ, কথায় কথায় হুমকি... এসবের কিছুই ভালো লাগে না।
– তাহলে করছিস কেন এসব?
বোরহান বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিল। সেটা দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে এল নিজের ভেতর থেকে। বলল, আমার ফ্যামিলির টাকা নাই রে বন্ধু। ঢাকা শহরে আমাকে কেউ ফ্রিতে থাকার জায়গা দেবে না, এত সস্তায় খাওয়ার ব্যবস্থাও করবে না। আমি হলে আছি, কারণ আমার আসলে থাকার জায়গা নাই।
আমার ফ্যামিলি আমাকে খাওয়ার টাকাও ঠিকমতো দিতে পারে না। আমি টাকার অভাবে অনেক সময় সকালে নাস্তা করতে পারি না, দুইবেলা খাই।
আমি হলে ছাড়া অন্য কোথাও কীভাবে থাকব বন্ধু?
আমার যদি টাকা থাকত, আমি কোনোদিন হলে থাকতাম না, আল্লাহর কসম করে বললাম!
সেদিন ছিল আমার জন্য একটি বড় শিক্ষা। আমি বুঝেছিলাম দারিদ্র্য কতটা নির্মম। আমি বুঝেছিলাম, যা তুমি নিজের চোখে দেখো, সেটাই শেষ সত্য নয়।
সেদিনের পর থেকে আমি আর কাউকে বিচার করিনি।
পাস করার পর বোরহান পুলিশের এসআই হিসেবে সারদায় ট্রেনিংয়ে যায়: সম্ভবত ৩৯তম ব্যাচে, ঠিক মনে নেই।
যাওয়ার আগে আমার সঙ্গে দেখা করেছিল। ওর উচ্ছ্বাস ছিল দেখার মতো।
আমরা সেই অর্থে কখনো বন্ধু ছিলাম না, কিন্তু সেদিন চোখে পানি নিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, আল্লাহ আমার কষ্টের দিন শেষ করল বন্ধু। টাকার অভাবে অনেক কষ্ট করেছি জীবনে। দোয়া করিস, মা-বাবাকে ভালো রেখে নিজেও যেন একটু ভালো থাকতে পারি।
সুদিন আসার আগেই সেই বোরহান ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে আসামি ধরতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে।
আমার প্রশ্নের জট খোলা বোরহান, মরে গিয়ে নতুন এক প্রশ্ন আমার ভেতরে গেঁথে দিয়ে গেল।
সারাজীবন কষ্টে রেখে, সুদিনের আশা দেখিয়ে, এই যে উপরওয়ালা বোরহানের সঙ্গে এমন নিষ্ঠুরতা করলেন, এই আয়রনিটা তিনি কেন শুধু বোরহানদের সঙ্গেই করেন?
পাঠকের মন্তব্য