গান্ধা কইরা দেওয়া শিল্পের ইতিবৃত্ত

২৭১ পঠিত ... ১৬:২৬, জুন ১৫, ২০২৫

হাজার বছরের সংস্কৃতিতে গান্ধা কইরা দেয়া শিল্পের যে অভাবনীয় বিকাশ ঘটেছে; তার অস্থিধারণ করে সোশ্যাল মিডিয়া ও মূলধারার মিডিয়াভিত্তিক গান্ধাকরণ কৌশলটি গড়ে উঠেছে।

তুলনামূলক/প্রতিযোগিতামূলক জীবন যাপন ও জমি-চর দখল ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে গান্ধা কইরা দেয়ার ব্যাপারটা সমাজের এক জরুরি অনুসঙ্গ হিসেবে সংস্কৃতির অংশ হয়ে পড়েছে। প্রথমে পরিবার, এরপর সমাজ, এরপর রাষ্ট্রীয় জীবনে এর প্রচলণ ঘটে।

বৃটিশেরা উপনিবেশ স্থাপনের প্রয়োজনে গান্ধা কইরা দেয়ার চর্চা নিয়মিতভাবে করত। ভারতীয় প্রাচীন চিন্তক চাণক্য ক্ষমতা সংহত রাখতে প্রতিপক্ষকে গান্ধা করার কৌশলাদি লিপিবদ্ধ করেন। ফলে বৃটিশেরা সুতানুটি বন্দরে পৌঁছানো মাত্র চাণক্যের গ্রন্থ হাতে বাঙ্গালিরা পৌঁছে যায় তাদের ফুলমাল্যে বরণ করতে।

বৃটিশেরা তখন বাঙ্গালিদের চাণক্যের দিব্যি দিয়ে প্রতিপক্ষকে গান্ধা করে দেয়ার বৈজ্ঞানিক কৌশল শেখায়। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার বেডরুমের কাল্পনিক কাহিনী ফেঁদে তখন ইঙ্গ-বাঙ্গালি যৌথ কাহিনীকাররা বাজিমাত করে দেয়।

কলকাতার বঙ্গদর্শন পত্রিকা, আকাশবাণী, আনন্দবাজার পত্রিকা, আজতক টিভি, রিপাবলিক টিভি; দেড়শো বছর ধরে প্রতিপক্ষকে গান্ধা করে দিতে ‘সিরাজকে গোবর ছোঁড়’ মিডিয়া কৌশল অবলম্বন করে চলেছে।

অভিজাত ভাষায় অনভিজাত প্রচারণা কৌশলকে বৃটিশেরা রেনেসাঁ ও সেকুলারিজম নামকরণ করলে বৃটিশের তাবেদারি করে নতুন ভদ্দরলোক সাজা লোকেরা তা লুফে নেয়। এদের গান্ধা কইরা দেয়া মেথডটি অত্যন্ত নান্দনিক। এরা প্রথমে শ্রোতাদের সামনে একটি গোলাপের কুঁড়ির গল্প বলে, প্রাতে উঠিয়ে জল সিঞ্চন করিতে গিয়া দেখিলাম, গোলাপ গাছে নতুন কুঁড়ি আসিয়াছে; উহাকে পূজার অর্ঘ্য দিবো বলিয়া স্থির করিলাম। বাগানের মালি খালেককে বলিলাম, দেখিয়াছ ম্লেচ্ছ, গোলাপ গাছে কুঁড়ি আসিয়াছে। পাখিরা গান গাহিতেছিল। আকাশ জুড়িয়া শরতের ঘন মেঘ। বোধ করি বৃষ্টি হইবে। বৃক্ষ শাখে পাখি বাসা বাঁধিয়াছে। কে জানি উহার ডিম ভাঙ্গিয়া ফেলে; অনেক কষ্টে একটি ডিম সংরক্ষণ করিয়াছিলাম। পাখির বাসায় উঁকি দিয়া দেখি ডিমখানি ভাঙ্গা; মনটা বিষণ্ণ হইলো। আরেকটু ঝুঁকিয়া দেখি, পাখির একটি ক্ষুদ্র বাচ্চা চিঁ চিঁ করিতেছে। আনন্দে ভুবন নাচিয়া উঠিলো।

এই বর্ণনা শুনে শ্রোতা ধারণা করে, সাক্ষাত দেবদূত উপস্থিত হয়েছেন। এরপর দেবদূত কুঁচ কুঁচ করে বিদ্বেষ উগরে প্রতিপক্ষকে গান্ধা করে দিলে; শোতা তার প্রতিপক্ষকে রীতিমতো দানব বলে মনে করে।

পূর্ববঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে, সেইখানে এইরকম অভিজাত ভঙ্গিতে অনভিজাত গান্ধা কইরা দেওয়ার জোরদার শিক্ষা চলে। বৃটিশ কলকাতা থেকে তারা অভিজাত হওয়ার ছদ্ম স্বপ্নটি শেখে। তখন নিজের চেয়ে কাউকে সহজাতভাবে একটু অভিজাত মনে হলেই তাকে গান্ধা করে দেয়ার শিল্পকলা চর্চা চলতে থাকে। কলকাতার ঐ ভ্রান্ত শ্রেষ্ঠ, সেরা, প্রথম হবার প্রতিযোগিতামূলক ও তুলনামূলক জীবন যাপনের শোরগোল ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছে যায়। ফলে পূর্ববঙ্গের যে সাম্যচিন্তার সমাজ; তা ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যেতে থাকে।

কৃষক-কারিগরের ছেলে-মেয়ে ও নাতি-নাতনি ঢাকায় পড়তে এসে গ্রামের মানুষকে ক্ষ্যাত বলে গান্ধা করে দিতে শেখে। বৃটিশ উপনিবেশের ডাকাতেরা এরকম ইনফেরিয়রিটি কমপ্লেক্সজনিত সুপিরিয়রিটির বোধ থেকে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষকে পেযান্টস, ইঁদুর ইত্যাদি বলতো। তাদেরকে কপি করে বংকিম চন্দ্র নিম্নবর্গের মানুষ, মুছুম্মান ইত্যাদি তকমা প্রচলন করে। ঢাকায় নতুন গজিয়ে ওঠা চার্চিল ও বংকিমেরা তখন নিজের বাপ-দাদাকে ছোট করে অভিজাতের পৈতে পরতে শুরু করে।

বৃটিশ কোলাবরেটর কলকাতা ও লাহোরের নতুন বড় লোক নতুন ভদ্দরলোকেরা এই শিক্ষা সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেয়, গরিব মানুষকে খাট্টা তামাশা করলে লোকে তোমাকে অভিজাত ভাববে।

শেখ হাসিনা দিল্লিতে প্রণব মুখার্জির কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে ঢাকায় ফিরলে; বাংলাদেশে গান্ধা কইরা দেয়ার সোনালি যুগ শুরু হয়। শেখ হাসিনা বাঙালি সংস্কৃতির অভিভাবকে পরিণত হলে; গান্ধা শিল্পে নানারকম বিকাশ ঘটে। অভিজাত ভঙ্গিতে অনভিজাত গীবত করতে সক্ষম সংস্কৃতি মামা ও খালারা যোগ দেয় তার লেটুর দলে। তাদের অনেক দিনের স্বপ্ন, কলকাতা ও লাহোরের বৃটিশ কোলাবরেটরদের মতো স্যুডো এলিট হয়ে ওঠা। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের পোশাক পরে সমাজে তারা এসে পড়ে রেনেসাঁ ও সেকুলারিজমের সনদ বিতরণের কাজে।

ফলে বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, প্রকৌশল শাস্ত্রের ছাত্র-ছাত্রীরা রেনেসাঁ ও সেকুলারিজমের সনদ পেতে আওয়ামী লীগের প্লে বুক থেকে কিছু গান্ধা কইরা দেয়ার শব্দাবলী মুখস্থ করে। ঐ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অকৃতকার্য ছাত্রেরা তখন সিপি গ্যাং খুলে গান্ধা কইরা দেয়ার কোচিং সেন্টার খুলে। তারা কলকাতার গান্ধা কইরা দেয়া অভিধানের সঙ্গে চর কুঁকড়িমুকড়ির চর দখলের লড়াইয়ের গান্ধা কইরা দেয়া কৌশল যুক্ত করে চরম উৎকর্ষ ঘটায়।

বৃটিশেরা দক্ষিণ এশিয়ায় উপনিবেশ গড়ার উপহার হিসেবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাংলাদেশ থেকে লুন্ঠিত অর্থ ও সিপি গ্যাং-এর চলিষ্ণুগালিকল্পদ্রুমদের উপহার পায়। ফলে লণ্ডন মাখামাখি হয়ে যায় লুন্ঠনের টাকা আর সিপি গ্যাং-এর ফাঁকা বুলিতে। এদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, নিজের একশোটি ছিদ্রের ঝাঁঝর চেহারাটি নিয়ে বড্ড বড় মুখ করে অন্যের একটি ছিদ্র অন্বেষণ করা।

২০০৯-২৪ ( ৫ অগাস্ট) সিপি গ্যাং-এর গান্ধা কইরা দেয়া শিল্প হাসিনা সরকারের হ্যাপি ওয়ার্কস স্বীকৃতি পাওয়ায়; তাদের তৈরি আওয়ামী গালির প্লে বুকটি রেনেসাঁ ও সেকুলারিজমের প্রতীক হয়ে পড়ে। ফলে তরুণ তরুণীদের অনেকেই ধরে নেয়; প্রকাশ্যে খিস্তি দিতে পারাই কুল হওয়া; আর আওয়ামী লীগের প্লে বুকের গালি দিলেই রেনেসাঁ ও সেকুলারিজমের গর্ব লাভ করা যাবে। তাকে বেশ খানিকটা সাংস্কৃতিক দেখাবে।

তবে বৃটিশ কলকাতার তৈরি করা সিরাজের বেডরুমের গল্প করে গান্ধা কইরা দেয়া প্রকল্পটি বাংলাদেশের সর্বদলীয় মহলে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তীব্র যৌন অবদমন, অনিষ্পন্ন আকাংক্ষা, বৈচিত্র্যহীন জীবন চর্যা; বেডরুমের কাহিনীর প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ তৈরি করেছে সর্বমহলে। এখানে দুঃশ্চরিত্র শতছিদ্রের ঝাঁঝরদের আরেকজনের একটি ছিদ্র খুঁজে তাকে দুঃশ্চরিত্র প্রমাণের মাধ্যমে নিজে বিরাট সাধু ও বিশুদ্ধ মানব হিসেবে পরিচিতি লাভের আকাংক্ষাও কাজ করে।

সমাজের মানুষের হাতের কংকন আর্শিতে দেখার প্রবণতা গান্ধা কইরা দেয়া শিল্পকে জনপ্রিয় করে। একজন মানুষকে স্বচক্ষে দেখার পর; তার সুকৃতি বছরের পর বছর প্রত্যক্ষ করার পরেও; ফেসবুক বা ইউটিউবের গান্ধাশিল্পীর গু’জব শুনে সে বলে ওঠে, আজ হইতে আপনার প্রতি সকল শ্রদ্ধা হারাইলাম। সমাজে এই ফাঁপা শ্রদ্ধা লাভের আকুতি মুক্ত হতে পারলে এইসব গান্ধাকলাকৈবল্যকে ইগনোর করে শান্তিতে জীবন যাপন সম্ভব বলে মনে হয়।

গোবরে মাখামাখি না হলে যে সমাজে ক্ষমতা কাঠামোতে যাওয়া যায় না ও সেলিব্রেটি হওয়া যায় না; সে সমাজে শ্রেষ্ঠ, সেরা হওয়ার ইঁদুর দৌড় থেকে দূরে থাকাই সভ্য জীবনযাপনের পূর্বশর্ত।

 

২৭১ পঠিত ... ১৬:২৬, জুন ১৫, ২০২৫

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top