মানবতা বিরোধী অপরাধ করে বাংলাদেশ থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগের একটি কালচারাল উইং রয়েছে। যাদের কাজ আওয়ামী লীগের জন্য সম্মতি উৎপাদন আর প্রতিপক্ষের জন্য অসম্মতি উৎপাদন।
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে; দ্রুত মুক্তিযুদ্ধের সুফল কুড়িয়ে একটি নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে ওঠে। যেহেতু এরা মুক্তিযুদ্ধের পরে দরিদ্র অবস্থা থেকে মধ্যবিত্তে রুপান্তর হয়েছে; ফলে তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মালিক হিসেবে আওয়ামী লীগের একটি হীরক রাজার মূর্তি গড়ে তোলে। আওয়ামী লীগের নীতি হচ্ছে পড়ালেখায় সবচেয়ে দুর্বল লোকগুলোকে বুদ্ধিজীবী শ্রেণী হিসেবে গড়ে তোলা। আর সবচেয়ে অসত লোকগুলোকে দুর্নীতির মাধ্যমে দ্রুত ধনী করে তোলা।
আওয়ামী লিগের লোকেরা সতত ইংরেজি ভাষায় দুর্বল। ফলে তাদের পক্ষে ইউরোপের উদারপন্থা সম্পর্কে জানা ও বোঝাপড়ার সুযোগ ছিলো না। তাই উদারপন্থা শিখতে তাদের কলকাতার মুখাপেক্ষী হতে হয়, তাদের চিন্তার দৌড় সে পর্যন্তই। কলকাতার উদারপন্থা হচ্ছে মহাভারত ও রামায়ণের গল্প বলে সেকুলারিজম শেখানো; প্রগতিশীলের ভং ধরে হিন্দুত্ববাদের সেবা করা।
পরীক্ষায় নকল করে পাশ করা লোকেরা যেহেতু আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের মণ্ডল; তাই তারা পোশাকে-জীবন চর্যায়-চিন্তায় ও চর্চায় কলকাতাকে কপি করে পেস্ট করে নেয় নিজ নিজ জীবনে। ফলে আওয়ামী লীগের কাছে ভদ্রলোক হওয়া মানে কলকাতার বাবু কালচারের জীবন।
ভারতের যে নীতি, যেহেতু মুক্তিযুদ্ধে তোমাদের সাহায্য করেছি, তাই সারাজীবন ভারতের দাস হয়ে থেকো। আওয়ামী লীগের একই নীতি, যেহেতু লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে; তাই লীগ হচ্ছে বাংলাদেশের মালিক; বাকি সবাই প্রজা।
বৃটিশের কোলাবরেটর হিসেবে স্বদেশের মানুষের বিরুদ্ধে ভূমিকা পালন করায় যারা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদার হয়েছিলো; তাদের নতুন শিক্ষিত ছেলেরা; বঙ্গভঙ্গে রাজধানী ঢাকায় এলে, প্রতিবাদী বাম রাজনীতিক হিসেবে আবির্ভূত হয়। এসব বাম বেশিরভাগই হিন্দুভারত উদয়ে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে প্রতিষ্ঠিত করতে মরিয়া। বাংলাদেশের বাম রাজনীতির রোল মডেল ঐ কলকাতার জমিদার বাবুর ছেলেরা বলে; তাদের মতো পোশাক পরে, গোল গোল করে জ্ঞানের কথা বলা আর প্রগতিশীলতার তুলাদণ্ড হাতে লোকজনকে সনদ দিয়ে বেড়াতে ব্যস্ত। জামায়াত যেমন তাদের অভিমতের সঙ্গে ইঞ্চি ইঞ্চি না মিললেই লোকজনকে নাস্তিক ও কাফের তকমা দেয়; বাম তেমনি তার মতের সঙ্গে ইঞ্চি ইঞ্চি না মিললে লোকজনকে খেলিয়ে মৌলবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল তকমা দিয়ে বেড়ায়।
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও বামঘন সাংস্কৃতিক উইংটি পাবলিক পারসেপশন তৈরি করে, তারাই অসাম্প্রদায়িকতা ও সেকুলাজিমের পিতা-মাতা। সে অসাম্প্রদায়িকতা হচ্ছে, পুজো করা, হোলির রঙ মাখলে তা সেকুলারিজম। আর নামাজ পড়লে ও কুরবানি দিলে তা প্রচণ্ড সাম্প্রদায়িক ব্যাপার। এদের কলকাতার বাতিঘরের সংজ্ঞা অনুযায়ী এরা কথিত লিবেরেল হয়েছে বলে; হিন্দুত্ববাদ এতে সিদ্ধ আর ইসলামপন্থা অসিদ্ধ।
বাংলাদেশে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত টিকিয়ে রাখতে ভারত-আওয়ামী লীগ-বাম ত্রয়ী গড়ে তোলে নিজেদের জন্য সম্মতি উৎপাদন ও অপরের জন্য অসম্মতি উৎপাদন কারখানা। ঐ কারখানা খালেদা জিয়ার মতো সিফন পরা ফ্যাশন সচেতন নেত্রীকে মৌলবাদী বলে তকমা দেয় আর ৯৬ সালে হজ্জ্ব করে মাথায় কালোপট্টি পরে ঘোরা ও পরে কওমি জননী হয়ে ওঠা শেখ হাসিনাকে অসাম্প্রদায়িকতার মা হিসেবে প্রশস্তি গায়। বিএনপির ক্লিন শেভড জীবন চর্যায় লিবেরেল নেতাদের মৌলবাদী তকমা দিয়ে আওয়ামী লীগের ওমরাহ-হজ্জ্ব করে বেড়ানো; আর ওয়াজ মেহফিলে প্রধান অতিথি হওয়া নেতাদের সেকুলারিজমের পাহারাদার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
আওয়ামী লীগ জামায়াতের স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার হয়ে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে কেয়ার টেকার সরকার ব্যবস্থা নিয়ে এলে কোন অসুবিধা নেই; বিএনপি জামায়াতকে স্ট্র্যাটেজিক পার্টনার হিসেবে নিয়ে সরকার গঠন করলে, অসম্মতি উৎপাদন কারখানা কুরব তোলে।
৫ অগাস্টের পর থেকে বিএনপি বড় বাঁচা বেঁচে গেছে; অসম্মতি উৎপাদন কারখানা তখন লেগেছে ড ইউনুস ও জুলাই বিপ্লবী তরুণ তরুণীর পেছনে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারানোর ফলে অত্যন্ত অসুখী জীবন যাপন করছে কালচারাল উইং। ফলে সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে তার হাপিত্যেস। সে তখন বিএনপিকে গিয়ে বলে, ইউনুস ক্ষমতায় থাইক্কা যাইবো; কারে বিশ্বাস করতেছেন আপনারা। ১৭ বছর ধরে ক্ষমতা বিরহে লীন বিএনপির তখন মনে হয়, ঠিকই তো; যদি আর কোনদিন খমতার সঙ্গে বিয়ে না হয়; অবিয়াত্তা থাইকা যাইতে হবে বাকি জীবন।
সাংস্কৃতিক উইং তখন ভরপুর অসম্মতি উৎপাদন করতে চোখে কাজল দিয়ে ইউটিউবে এসে পড়ে; হোয়াইট টেলিফোন সেজে হানি ট্র্যাপ করে ইউনুস সমর্থক ইউটিউবারকে। হানি ট্র্যাপ করে পনেরো বছরের ফ্যাসিজম টিকিয়ে রাখার আত্মবিশ্বাস এতোই বেড়েছে যে, ভেবেছে ঐ বহু ব্যবহারে জীর্ণ কায়দায় গান্ধা কইরা দেয়া যাবে।
সাংস্কৃতিক উইং প্রচণ্ড সাংস্কৃতিক হলেও আগ্রহ তাদের বেড রুমের খবর প্রচারে; যেহেতু তাদের গুরুরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাস লেখার পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেডরুমের গুজব এনেছিলো, সত্যজিত রায়ের ‘দেবী’ চলচ্চিত্র নির্মাণের পর তার স্ক্যান্ডাল নিয়ে হাজির হয়েছিলো। ফলে শিষ্যরাও ঐ ধন্বন্তরী পদ্ধতি নিয়ে বসে থাকে গান্ধা করে দিতে।
আমাদের সমাজের লোকেরও এক বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য, হাতের কংকন তারা আর্শী দিয়ে দেখে। ফলে যে লোকটাকে দীর্ঘদিন ধরে চেনে জানে, অসম্মতি উতপাদন কারখানা তাকে নিয়ে দুর্নাম গেয়ে দিলে, সমাজের লোকেরা সমস্বরে বলে, আপনার প্রতি চদ্ধা হারাইলাম, ছি ছি আপনি এত খারাপ।
ভারত-আওয়ামী লীগ-বামেরা সারাজীবন ভিন্নমতের মানুষকে এর ওর এজেন্ট তকমা দিয়েছে। কিন্তু প্রণব মুখার্জির আত্মজীবনী, সুজাতা সিং-এর বাংলাদেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ, ভারতের মিডিয়া ও সেমিনারে তাদের কর্মচারী হাসিনাকে বাংলাদেশে ক্ষমতায় রেখে ছায়াউপনিবেশ গড়ার ঘটনাগুলো যখন লোকচক্ষুর সামনে ঘটেছে; তখন সাধারণ মানুষ "ভারতের দালাল" তকমা নিয়ে হাজির হলে; দুর্বল সেন্স হিউমারের লোকেরা সেটাকে হেসে উড়িয়ে দিতে গিয়ে সেটা ভীষণ কাষ্ঠ হাসি হয়ে যায়।
আওয়ামী লীগ ও বামের এই আজব বৈশিষ্ট্য; ৫৪ বছর ধরে একটু অমত হলেই তাকে অমুকের দালাল, রাজাকার, মুমিন, ছাগু আরো সব অশ্রাব্য তকমায় জর্জরিত করেছে। আর নিজেরা তকমা খাওয়ার মাত্র দশমাস না যেতেই হিতোপদেশ সমগ্র নিয়ে বসেছে ‘তকমা দিতে নেই গো।’ নিউটনের তৃতীয় সূত্র, প্রত্যেক ক্রিয়ার একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে যেন মিথ্যা হয়ে যাবে খল বাণী চিরন্তণী শুনে।
আওয়ামী লীগের ১৫ বছরে দাড়ি টুপিওয়ালা মানুষকে হননযোগ্য আখ্যা দিয়ে কালচারাল উইং প্রকাশ্যে মোদির ইসলামোফোবিয়ার সারিন্দা বাজিয়েছে। লীগের রুপবান মার্কা বুদ্ধিজীবিরা দেশে এতো হিজাব পরা মেয়ে কেন প্রশ্ন রেখেছে; তারা মানুষের মধ্যে ভাগ করে "আমরা বনাম ওরা" করেছে। ফলে ৫ অগাস্টে মুক্তি পেয়ে ইসলামপন্থীদের একটি অংশ বেপরোয়া আচরণ করেছে। আরেকটি অংশ দায়িত্বশীল আচরণ করেছে। অমনি অসম্মতি উৎপাদন কারখানা, হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় অপপ্রচার, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলেই বাংলাদেশ জামায়াতের খপ্পরে, তা প্রমাণে লেগে পড়েছে।
ইসলামপন্থীদের যারা মাজার ভেঙ্গেছে, নারীর পোশাক পুলিশি করেছে; নিগ্রহ করেছে; তাদের এক এক করে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কিন্তু ইস্যুটাকে টেনে চুইংগামের মতো লম্বা করতে থাকে অসম্মতি উৎপাদন কারখানা। ইসলামপন্থীদের একটি অংশ নারীদের অশ্লীল গালি দিয়ে ক্ষমা চেয়েছে। আর নারীকে গালি দিয়ে কক্ষণো ক্ষমা না চাওয়া সিপি গ্যাং এসে এখন নারীদের ফেসবুক পোস্টে গিয়ে লেখে, দেখছেন জুলাইএর লাল বিপ্লবীদের সমর্থন করে কি ভুলটা করেছেন।
বাংলাদেশ সমাজে কে কোন কাননের ফুল আমরা জানি। কিন্তু একটু ফর্সা কাপড় পরে ভদ্দরলোক হলে, বিরাট এনটাইটেলমেন্ট এসে পড়ে। তখন নিজের ছেলে বা মেয়ের গায়ে ফুলের টোকাটি পড়লে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ চেয়ে ফেলে। অথচ অধিকার বঞ্চিতের ছেলেমেয়ে ভীষণ বিপদে পড়লেও তা আর চোখে পড়ে না নতুন ভদ্রলোকদের। জুলাই বিপ্লবের একটি মেয়ে তার বোনের সঙ্গে ইভটিজিং প্রতিহত করতে গিয়ে মারধোরের স্বীকার হয়েছে। তা দেখে যে আন্টি অনুশীলিত নির্লিপ্ততায় মেয়ের এমেরিকান স্কুলের এডমিশন ফর্ম ভরতে সাহায্য করেন, তিনি হঠাত নিজের মেয়ে সামান্য সাইবার বুলির ঘটনা সোশ্যালাইটস আন্টিদের জনে জনে বলে হোয়াইট টেলিফোন ফেমিনিজম সূচিত করেন। এরকম ফাঁপা খেলনা সমাজ পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এরকম আত্মকেন্দ্রিক ও কাস্ট সিস্টেম নির্ভর সমাজে অসম্মতি উৎপাদনের অপকৌশল কাজ করে দ্রুততায়।
ভাবখানা এমন বাংলাদেশে তারা বেড়াতে এসেছেন; ফাইভ স্টার ফ্যাসিলিটিজ কেন পাচ্ছেন না; তা নিয়ে দিনমান আক্ষেপ। বাংলাদেশ যাদের কাছে টার্মিনাল; পশ্চিমের কাল্পনিক বেহেশতে যাবার স্বপ্নে যারা আকুল; তাদের এনটাইটেলমেন্টের বিলাপ দেখে আর আলোড়িত হইনা।
বরং অধিকার বঞ্চিত কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী যারা জুলাই বিপ্লবে রক্ত দিয়েছে; একজনকে গুলি করলে সে মাটিতে পড়ে গেলে বাকি নয়জন দাঁড়িয়ে থেকে; সেই বীর সন্তানদের জন্য একটি কল্যাণরাষ্ট্র বিনির্মাণই আমাদের স্বপ্ন।
পাঠকের মন্তব্য