যে পরিবার সন্তান হারায়, সে-ই কেবল পোড়ে

১০৫১ পঠিত ... ১৭:০৫, মে ২৮, ২০২৫

21

শহীদ জননী জাহানারা ইমাম যখন একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চেয়ে নাগরিক আন্দোলন শুরু করলেন; তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন ছাত্র হিসেবে আমরা সেই দাবি সম্বলিত লিফলেট বিতরণ করতাম। একুশে বইমেলায় আমাদের স্টলে বসতেন উনি। সেখানে দীর্ঘ কথোপকথন হতো উনার সঙ্গে। ফলে একাত্তরের ন্যায়বিচারের দাবিতে লেখালেখি চালিয়ে গেছি ২০১৪-র নির্বাচনের আগে পর্যন্ত। কী জার্মানির প্রবাস জীবন, কী পাকিস্তানের প্রবাস জীবন, রেডিও জার্নালিজমের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে ছিল এই বিচারের দাবি। এমনকি এই বিচারের পক্ষে ক্যাম্পেইনে পাকিস্তানের নাগরিক সমাজকে যুক্ত করতে সাধ্যমত কাজ করেছি।

আমার সবসময়েই মনে হতো ১৯৭২-৭৪-এ এই বিচার করে ফেলা গেলে বাংলাদেশ সমাজে ন্যায়বিচারের দৃষ্টান্ত স্থাপিত হতে পারত। ১৯৯৬-২০০১-এ আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় ছিল; ৭৫-এর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার তখন শুরু হয়েছিল; সেসময় একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু করা যেত। ২০০৯-এ ক্ষমতায় এসে আওয়ামীলীগ যখন এই বিচারের উদ্যোগ নিলো; মনে হলো এবার নিশ্চয়ই ন্যায় বিচার পাওয়া যাবে। দীর্ঘ পনেরো বছর আওয়ামীলীগ জোর করে রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকেছে; অথচ এই বিচার শেষ হয়নি; জামায়াত নেতা আজহারের বিচারটাকে অলৌকিক চুইংগাম হিসেবে রেখে গেছে।

শাহবাগের তরুণদের ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষাকে এক্সপ্লয়েট করে আওয়ামীলীগ ২০১৪ সালের একপেশে নির্বাচনে এমন অনুভূতি ছড়িয়েছে, এই বিচার শেষ করতে হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে হবে। ছোটবেলায় পড়া কুমিরের বাচ্চার গল্পের মতো যুদ্ধাপরাধীর বিচারের কুমীরের বাচ্চা দেখিয়ে আওয়ামীলীগ তার একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেছিল। যুদ্ধাপরাধীর বিচার যে আওয়ামীলীগের নেহাত কুমীরের বাচ্চা দেখানোর গল্প ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার চুইংগাম চেবানোর উপকথা; এখানে অঙ্গীকারের দৃঢ়তা নেই, পেশাদারিত্ব নেই, এই বিচার শেষ করার তাগিদ নেই; তা প্রমাণ হয়ে গেছে নানাভাবে।

জামায়াত-এ-ইসলামি মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরে জন্ম নেওয়া তরুণ-তরুণীদের মধ্যে একাত্তরে জামায়াতের অপরাধ সম্পর্কে অস্বীকার প্রবণতা তৈরি করেছে। বাংলাদেশ সমাজের ক্ষতির জায়গাটা এখানে প্রকট। ডিনাইয়ালের চেয়ে ক্ষতিকর মনোরোগ আর কিছুই হতে পারে না।

আমরা একাত্তরের আলোকচিত্র ও ভিডিওতে দেখেছি, গোলাম আজম ছাড়া আর কোনো কোলাবরেটরের দাড়ি টুপি নেই। ইসলামি ছাত্র সংঘের নেতাদের ক্লিন শেভড মুখমণ্ডল ও সানগ্লাস দেখেছি। কিন্তু একাত্তরের কংস মামা ভারত, যে স্বাধীনতাযুদ্ধে সাহায্যের মাধ্যমে বাংলাদেশকে করোদ রাজ্য হিসেবে চেয়েছিল; তারা বাংলাদেশের কালচারাল উইংটিকে ব্যাপ্টিজম করে হিন্দুত্ববাদী মানসিক গড়নে তৈরি করে, যদি তুমি পূজা করো তবে তুমি বেশ, যদি তুমি নামাজ পড়ো, তবে তুমি শেষ। ফলে মুক্তিযুদ্ধের পর নির্মিত সব চলচ্চিত্রে রাজাকার কিংবা খল চরিত্রের মেকআপ, কলকাতার ছবির মুসলমান চরিত্রের মতো মেকআপ; দাড়ি টুপি, গলায় তাবিজ, গালে আঁচিল, চোখে সুরমা। এইভাবে ইসলামকে রাজাকার শব্দের প্রতিশব্দ করে তোলা হয়। তাতে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের কোরআন ছুঁয়ে শপথ, নামাজ পড়ে যুদ্ধের অপারেশনে যাওয়া, স্বাধীনতার আকাঙক্ষায় মা-বোনের নামাজ-রোজা প্রার্থনার সত্যগুলো হারিয়ে যায়।

হিন্দু ভারতের মুক্তিযুদ্ধের শত্রুদের ইসলামিকরণের মাঝ দিয়ে জামায়াত ও আওয়ামীলীগ উপয়েই পলিটিক্যালি বেনিফিশিয়ারি হয়। যুদ্ধাপরাধের অভিযুক্ত আজহার মুক্তি পেলে ইসলামপন্থী মানুষের বড় একটি অংশ খুশি হয়। আর ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে আওয়ামীলীগের মানবতাবাদী অপরাধের সমর্থক ও হিন্দুত্ববাদীরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার চুইংগাম চিবিয়ে নৈতিকতার উচ্চস্থানে বসে চুক চুক করে বলতে থাকে, দেখলেন তো জুলাইয়ে কী ভুল আপনারা করলেন, এই জামায়াতিদের সাহায্য করে। ভারতীয় মিডিয়ার হাসিনা ক্ষমতায় না থাকলে জামায়াত ক্ষমতায়; ঐ হিন্দুত্ববাদী ভারতের বয়ান ফেরি করতে তৈরি হওয়া নক্সী-পাঞ্জাবি, শাড়ি পরে ঘাড় কাত করে তোলা প্রোপিকগুলো ডানা ঝাপটাতে থাকে সোশ্যাল মিডিয়ায়। আওয়ামীলীগ এদের নিজেদের অপরাধ অস্বীকার করে একাত্তরের অপরাধ নিয়ে চৈ চৈ করে ডিনাইয়ালের রোগী করে তুলেছে।

এইভাবে মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরে জন্ম নেওয়া একটি প্রজন্মকে আওয়ামীলীগের কালচারাল উইং-এর ব্যাপ্টিজমের মাধ্যমে একচক্ষু করে তুলেছে; যেভাবে জামায়াত তরুণ প্রজন্মের একটি অংশকে ব্যাপ্টিজমের মাধ্যমে একচক্ষু করে তুলেছে। বাংলাদেশ সমাজের জন্য সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ এই দুটি গোষ্ঠী। অপরাধ অস্বীকার প্রবণতা মানেই সমাজ কখনোই অপরাধমুক্ত না হওয়া।

মানবতাবিরোধী অপরাধীর বিচার কীভাবে করতে হয়, ন্যুরেমবার্গ ট্র্যায়ালে তার উদাহরণ রয়েছে। এক্ষেত্রে অপরাধ সংঘটিত হবার কালে যারা জার্মানির নাতসি পার্টির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন; তাদের বিচার হয়েছে। কোনো নাতসি নেতা ব্যক্তিগতভাবে কোথায় খুন করেছেন; সেই খুনের প্রমাণ করা দরকার পড়েনি তাকে শাস্তি দিতে। তার কমান্ডের অধীনে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে; সেটাই তাকে শাস্তি দিতে যথেষ্ট। সেই পদ্ধতি অনুসরণ করলে, অভিযুক্ত আজহার যেহেতু রংপুরের ইসলামি ছাত্র সংঘের প্রধান ছিলেন, আর তার কমান্ডের অধীনে অসংখ্য হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে, সুতরাং তিনি শাস্তিযোগ্য হতেন। আওয়ামীলীগের স্বজনপ্রীতিতে তৈরি মিডিওকার ট্রাইবুনাল ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল অনুসরণ করলে খুব সহজেই অপরাধীদের শাস্তি দিতে পারত।

কিন্তু উদ্দেশ্য তো বিচার করা ছিল না। উদ্দেশ্য ছিল নতুন প্রজন্মকে শাহবাগে মাথায় পতাকা বেঁধে উগ্র জাতীয়তাবাদী হিসেবে গড়ে তোলা; যাতে তারা একেকটি ফাঁসির আদেশের পর বিরিয়ানি খেয়ে ক্যানিবাল হয়ে ওঠে। এরপর আওয়ামীলীগকে ক্ষমতায় রাখতে ভিন্নমতের মানুষ খেতে বেরিয়ে পড়ে। হিন্দুভারত যাতে তার সেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে পাওয়া জমিদারী ফেরত নিতে আবার স্যাফরন পরে প্রতিশোধের হোলি খেলতে পারে।

এই যে জামায়াতের একাত্তরের অপরাধ অস্বীকার করে চব্বিশের অপরাধের বিচার চাওয়া আর আওয়ামীলীগ ও কালচারাল উইং-এর চব্বিশের অপরাধ অস্বীকার করে একাত্তরের বিচার চাওয়া; এইখানে আমরা দেখতে পাই বাংলাদেশ সমাজের দুটি সাবহিউম্যান উপগোষ্ঠীকে।

পনেরো বছর সময় পেয়েও আজহারের বিচার সম্পন্ন না করে চুইংগাম হিসেবে ফেলে যাওয়ায় গত ২৪ ঘণ্টায় সহমত ভাই, শিবব্রত দাদা, ললিতাদি, আনারকলি কেমন শোকের উৎসব করেছে; চোখের সামনে চব্বিশের শিশু কিশোর হত্যা হতে দেখে রোদ ঝড় বৃষ্টিতে হাসিনার সঙ্গে থেকে এই জুলাই বিপ্লব দমনের পণ করেছিল যারা। তারা ৫৪ বছর আগের শোকে কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছে। আওয়ামীলীগের প্লেবুক থেকে রাজাকার শব্দটি নিয়ে টাকলা রেনেসাঁ, সিনথিয়া, সুজানা, ফাতিমা কতনা রঙ্গে লিবেরেল সেজেছে গত রাতে।

আর আজহারের মুক্তির চুইংগাম মুখে নিয়ে ঘোড়ার ডিমের ‘সত্যের জয়’ হয়েছে বলে শরিয়ত ভাই, নেয়ামত ভাই, রাবেয়া আপা যুদ্ধাপরাধীর মুক্তিতে মিষ্টিমুখ করে ক্যানিবাল আনন্দ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদরত বাম ছাত্রসংগঠনগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

একাত্তরের অপরাধ ও চব্বিশের অপরাধ; এই দুই হীন অপরাধের বিচার চেয়েছেন যারা; তারাই বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বশীল। সভ্যতার উঠোনে এমন মানুষেরাই প্রাসঙ্গিক। ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃত কাঁদতে দেখে’ যারা দলান্ধ প্রতিক্রিয়ায় বুনো মোষের মতো দৌড়াদৌড়ি করে; সভ্যজগতে তারা অপ্রাসঙ্গিক।

আজহারের মুক্তি পেয়ে যাওয়া দেখে মনে হয়; বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতায় ও আন্তরিকতার অভাবে একদিন ইনু-মেনন-সালমান এফ রহমান-আনিসুল গলায় ফুলের মালা পরে জেল থেকে বেরিয়ে আসবে। এই দেশে যে পরিবার তার সন্তান হারায়, সেই কেবল পোড়ে; বাকিদের জন্য এ নেহাত মাংসের কারবার; ক্ষমতা ক্ষমতা খেলার গ্লাডিয়েটর।

 

১০৫১ পঠিত ... ১৭:০৫, মে ২৮, ২০২৫

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top