রাজনীতি কালো টাকা ও পেশীশক্তির বৃত্তে বন্দী। স্বাধীনতার ৫৪ বছর অতিক্রান্ত। হাতে গোনা কিছু মানুষ বাদ দিলে এখানে জনসেবার লক্ষ্য নিয়ে কেউ রাজনীতিতে আসেনি। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ আর ইসলামি চেতনার লিপসার্ভিস দিয়ে বড় লোক হওয়া ছাড়া এই রাজনীতির আর কোনো উদ্দেশ্য নেই।
জুলাই বিপ্লবী তারুণ্য যে বৈষম্যবিরোধী বাংলাদেশের দাবি নিয়ে ক্রমে ক্রমে কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন হয়ে জুলাই-অভ্যুত্থান সংঘটিত করেছিল; তা ছিল ঐ রাজনীতির নামে বড়লোক হবার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অবসানের লক্ষ্যে।
ফলে জুলাই বিপ্লবীদের রাজনৈতিক দল এনসিপির পক্ষে এই ডাকাত সংকুল রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে টিকে থাকা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের তারুণ্য ও নব্বই-এর গণ-অভ্যুত্থানের তারুণ্যকে বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্র তৈরির অঙ্গীকার থেকে সরিয়ে কালো টাকা ও পেশীশক্তির রাজনীতির গলিতে নিয়ে আসা হয়েছিল। এই নির্মম মাংসের কারবারে মিসফিট দেশপ্রেমিক তারুণ্যকে বলি দিয়ে ক্রমে ক্রমে গড়ে উঠেছে এই মাফিয়া রাষ্ট্র।
রাজনীতির মাফিয়াদের সোজা হিসাব, যদি অসততার সুরে সুর মেলাতে পার; তুমি হবে রুলিং এলিট; আর যদি সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচারের রাষ্ট্র তৈরির ঘোড়া রোগ থাকে; তবে তোমাকে সরিয়ে দেওয়া হবে। সেই আবদুল্লাহ উপন্যাসে পীর সাহেব, প্রোডিজি কিশোরকে যেভাবে বলেছিলেন, এক ঘরমে দো পীর, যাও বাছা শো রাহো।
এনসিপির তরুণ নেতাদের প্রতি পুরোনো বন্দোবস্তের ঘোড়েল পীর নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক ঐ রকম।
পুরোনো বন্দোবস্তটি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে বিভাজিত থাকলেও তাদের নিজস্ব একটি অবিভাজিত সমাজ রয়েছে। যেখানে একজন দেশ থেকে পালালে আরেকজন তার সম্পদ দেখাশোনা করে; এক বেয়াই বিপদে পড়লে আরেক বেয়াই তাকে আশ্রয় দেয়। ফলে আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের ফ্যাসিজমকালে তার প্রতিপক্ষের এমন কুসুম কুসুম প্রতিবাদ ছিল যে; ফ্যাসিস্ট হাসিনা রুপকল্প ২০৪১ রচনা করে চিরস্থায়ী একদলীয় শাসনের স্বপ্ন দেখেছিলেন।
আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষের রাজনীতিকরা রাজনীতির ফুটবল মাঠে বল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতেন। গোলপোস্টের অনেক ওপর দিয়ে বল চলে যায় এমন শট নিতেন। দলগুলোর সাধারণ নেতাকর্মীরা ক্রসফায়ার, গুম, কারাগারে নির্যাতনে জীবন হারিয়েছে। কিন্তু তাতে রাজকীয় সাতরাঞ্জ কি খিলাড়িদের কিছু এসে যায়নি।
জুলাই বিপ্লবী তারুণ্য দেশের জনমানুষকে নিয়ে ৩৬ দিনের লড়াইয়ে দেশকে ফ্যাসিস্টমুক্ত করলে; হাসিনার দল ভারতে পালিয়ে গেলে; এরপর রাজনীতির ঘোড়েল ওস্তাদরা বেরিয়ে আসেন জুলাই অভ্যুত্থানের সুফল কুড়িয়ে ক্ষমতার দখল নিতে। কি একাত্তরে, কি নব্বই-এ তারুণ্যের রক্তমাখা মৃতদেহের সিঁড়িতে পা ফেলে এই ওস্তাদেরা ক্ষমতার সুফল কুড়াতে অভ্যস্ত। এবারই বা তার অন্যথা হবে কেন!
মুশকিলটা হচ্ছে এরা জেন জি, এমন একটি প্রজন্ম যারা বিশ্বজুড়ে ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত উপড়ে ফেলতে অভ্যস্ত। এরা জেনেক্স বা সিনিয়র মিলেনিয়ালদের মতো আত্মকেন্দ্রিক ও ফাঁপা প্রজন্ম নয়; যারা হাওয়া ভবনের পেস্ট্রি আর গণভবনের পিঠাপুলি খেয়ে টক শো জাস্টিফিকেশন ও প্রতারণামূলক বক্তব্য দিয়ে বেড়াবে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৪ বছরের ইতিহাসে প্রতিবেশী রাষ্ট্রটি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সতত নাক গলিয়ে চলেছে। তার এই দাদাগিরি ও আগ্রাসনের বিপরীতে বাংলাদেশের বুমারস, জেনেক্স, সিনিয়র মিলেনিয়াল কখনও স্পষ্ট কোন প্রতিবাদ করেনি (অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া)। কারণ তাদের মাথায় রয়েছে ক্ষমতায় যাবার অংক; আর ডিএনএ-তে রয়েছে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদার বাবুর সামনে অদৃশ্য সাবানে হাত কচলানোর হীনমন্যতা।
বাংলাদেশের জেন জিই প্রথম প্রতিবেশির অনধিকার চর্চা ও দাদাগিরিকে চ্যালেঞ্জ করেছে। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, যারা ভারত সমর্থিত হাসিনার অন্ধকার যুগে সার্বভৌমত্বহীনতায় দুর্দশার মুখে পড়েছে; সীমান্তে ঝুলেছে তার সন্তানের লাশ, গুম হয়ে যাওয়া সন্তানকে ভারতের কারাগারে আটক থাকতে দেখেছে, দেশের ইন্টেরোগেশন সেলে তাদের হিন্দিতে করা প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে, হিন্দুত্ববাদের ইসলামোফোবিয়ায় পাখির মতো করে মাদ্রাসার তরুণ হত্যা হতে দেখেছে; তারা জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছে, ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়!
যে স্বাধীনতা নিয়ে আমাদের হাজার হাজার পৃষ্ঠার কবিতা, গল্প, গান; তা ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট বাস্তব হয়ে ধরা দেয়। এনসিপি যখন দেশজুড়ে পদযাত্রা করে; ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের ধুলোমলিন মানুষ তখন সেই স্বাধীনতাকে স্পর্শ করে।
কিন্তু এত হতভাগ্য এই জনপদের মানুষ যে, সেই ১৭৫৬ সালে পলাশীর যুদ্ধ থেকে ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে মীরজাফর, জগৎশেঠেরা নিজের ভূখণ্ডের রাজদণ্ড সমর্পণ করেছে বৃটিশ দখলদারের হাতে। ১৯৪৭ সালের আংশিক স্বাধীনতা হয়েছে পাকিস্তানের দখলদারের হাতে রাজদণ্ড অর্পণ। ১৯৭১-এর চূড়ান্ত স্বাধীনতা হয়েছে ভারতের ছায়াউপনিবেশ হিসেবে আত্মসমর্পণের আরেক ট্র্যাজেডি। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে এতো রক্ত এতো ত্যাগ; কিন্তু দেশীয় কোলাবরেটরদের ষড়যন্ত্রে বারবার পরাধীনতার ছায়া নেমে আসে এই জনপদে।
জুলাইত-বিপ্লবী তরুণেরা ছাড়া এদেশের মানুষের আর কেউ নেই; যে তাকে প্যালেস্টাইন ল্যাবরেটরি হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে পারে। পরাজিত আওয়ামী লীগ কিংবা আগামিতে একই পুরোনো রাজনীতির দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা কেবল ক্ষমতা পেলেই খুশি। কী আছে একটা পতাকাওয়ালা গাড়িতে; একটা বাঘ আঁকা চেয়ারে তা কে জানে! যে সার্বভৌমত্ব কেতাবে থাকে কিন্তু গোয়ালে থাকে না; তা নিয়ে তাদের কীসের গর্ব তা কে জানে!
১৯৭২ থেকে ২০২৪ পুরোনো বন্দোবস্তের রাজনৈতিক দলেরা ক্ষমতায় গিয়ে প্রমাণ করেছে; কল্যাণরাষ্ট্র, সুশাসন, সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা তাদের লক্ষ্য নয়। তাদের লক্ষ্য যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, সেদলের নেতা-হাতা-প্রশাসক-পুলিশ-গোয়েন্দা-বুদ্ধিজীবী-সংস্কৃতিমামা-সাংবাদিক খালু, সমর্থক ফুপারা হৃষ্টপুষ্ট হওয়া। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদারের মতো নতুন চর্বি জমিয়ে দেশের সাধারণ মানুষকে ছোট লোক, টোকাই, বাঙ্গি-বুঙ্গা ইত্যাদি বলে তুচ্ছ করা। যে মেহনতী মানুষের সম্পদ লুণ্ঠন করে ক্ষমতার ষাড়েরা বলশালী হয়; সেই বল তারা দুর্বলের ওপর প্রয়োগ করে।
জুলাই বিপ্লবের ম্যান্ডেটের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অনেককাল পরে অভিমত প্রকাশের স্বাধীনতা উদযাপনের সুযোগ দিয়েছে। ভারতের মিডিয়ায় তাদেরকে অশ্রাব্য গালাগাল দেখে ধারণা করা যায়; তারা সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। দেশের অভ্যন্তরের কালো টাকা, পেশীশক্তি আর কলতলার গালির রাজনৈতিক মাস্তানি ও মাফিয়া কাঠামোতে সমস্ত চাপ ও কুকথা সহ্য করে তারা দায়িত্ব পালন করেছেন।
এই সরকারের সদস্যরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল পেশাদার; কিন্তু তারা বিপ্লবী নয়; সেটা হবার কথাও নয়। তবে তারা একের পর এক প্রতিবিপ্লব মোকাবেলা করেছেন। রাজনীতির মাস্তানদের সঙ্গে সমঝোতা করে একটা স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে চেষ্টা করেছেন। হাসিনা ও তার খুনের সহযোগীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। জুলাই বিপ্লবে কোন স্টেইক না থাকা বয়েসী রাজনীতিকদের জুলাই সনদে স্বাক্ষর করিয়েছে। যদিও তাদের মনের ভাষা হচ্ছে, আগে ক্ষমতায় যেতে দিন, তারপর এইসব সনদ নাত্থিং ফান!
পরাজিত আওয়ামী লীগ, বিজয়োন্মুখ বিএনপি স্বৈরাচারের সহায়ক সংবিধানটিকে আসমানি কিতাব হিসেবে ধরে রাখতে চায়; কারণ ওতে ক্ষমতাসীনের নিরংকুশ ক্ষমতার নিশ্চয়তা আছে। অন্যদিকে বাম দলগুলোর কাছে ৭২-এর সংবিধান অনুভূতি; জামায়াতের কুরআন ও সুন্নাহ অনুভূতির মতো কট্টর মতাদর্শিক রাজনীতির অনুসঙ্গ।
ফলে জেন জি কেন ঐ ফ্যাসিজমের রক্ষাকবচ পুরোনো সংবিধান ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নতুন সংবিধান রচনা করছে তা ঐসব পুরোনো মাথায় ঢুকবে না; কারণ পুরোনো মাথা মানেই দলীয় স্বার্থ। জনগণের স্বার্থ তো তারা ৫৪ বছর ধরেই অগ্রাহ্য করেছে।
এনসিপি নিশ্চয়ই জানে জাঢ্য জরদ্গব মানুষ-খেকো ফ্যাসিজমকে মাত্র ৩৬ দিনে শেকড়সহ উৎপাটন করা যায় না। বাংলাদেশ রাষ্ট্রব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ফ্যাসিজমের ঘুণপোকা। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদার হবার যে স্বপ্ন ওটাই ফ্যাসিজমের সূতিকাগার। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তপ্রবণ রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন ছাড়া বৈষম্যমুক্ত সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়া সম্ভব নয়।
পাঠকের মন্তব্য