হাসিনা বাঘের পিঠে চড়ে বসেছিলেন। তিনি জানতেন, যতক্ষণে পিঠে আছেন, নিরাপদ। নামলেই বাঘ খেয়ে ফেলবে। তার নামতে না চাওয়ার মরিয়া চেষ্টাই ২০১৪, ২০১৮ আর ২০২৪-এর নির্বাচন। সামহাউ তিনি বাঘের পিঠ থেকে নিরাপদে নামতে পেরেছেন। এই নেমে পড়া বা নামতে বাধ্য হওয়া অনিবার্য ছিল।
হাসিনার আমলে উন্নয়ন হয়েছে সত্যি। কিন্তু উন্নয়ন নাকি গণতন্ত্র–এটা কোনো অপশন না। উন্নয়ন লাগবে, তার চেয়ে বেশি লাগবে গণতন্ত্র। হাসিনা জনতার ভোটের পরীক্ষায় যেতেই চাইলেন না। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ভরসা করলেন পুলিশ-আমলাদের ওপর।
হাসিনা ভাবলেন, তিনিই আমলা-পুলিশ চালাচ্ছেন। আমলারা মুখ টিপে হাসল। সুবিধাবাদী আমলাতন্ত্র হচ্ছে সেই লেজ, যারা কুকুরকেই নাচায়। হাসিনার ১৬ বছর ধরে সাজিয়ে রাখা সরকারি প্রশাসনই তো ছিল। কই, কে তাকে বাঁচাল?
গণতন্ত্রহীনতা অলিগার্কি তৈরি করে। বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থা পুরো ফাঁপা হয়ে গিয়েছিল। রিজার্ভ তলানিতে গিয়ে পৌঁছে গিয়েছিল। হাসিনা নিজেই কয়েক হাজার কোটি টাকা ছাপিয়েছে ব্যাংকগুলোকে বাঁচাতে। ইউনুস সরকারও ছাপিয়েছে। কিন্তু টাকা তো শেষ পর্যন্ত ছাপা কাগজই। এই কোরামিন দিয়ে কি বাঁচানো যায় দেশের অর্থনীতি?
ভাগ্য ভালো, রেমিটেন্স প্রবাহ দেশকে দেউলিয়া হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছে। না হলে পরিণতি হতো ভয়াবহ।
আওয়ামী লীগের অবশ্যই বিশাল জনসমর্থন আছে। আওয়ামী লীগ ৭৫ বছর বয়সী একটা সংগঠন। কিন্তু এই যে কাল হাসিনার ফাঁসির রায় হলো, আপনি আপনার চেনা গণ্ডি থেকে বেরিয়ে এসে দেখেন তো, সাধারণ মানুষ কী বলছে? বিচার সুষ্ঠু হয়নি দাবি আপনারা করতে পারেন। কিন্তু এর প্রতিবাদে কজন মানুষ রাস্তা নেমে আসল? হাসিনার জনপ্রিয়তার এসিড টেস্টও কি কাল হয়নি? জনতার মধ্যে তিনি প্রবল জনপ্রিয় হলে কালই তো রাস্তায় লাখ লাখ মানুষের ঢল নামত।
এখন বলতে পারেন, তাহলে ইলেকশনে আওয়ামী লীগকে সুযোগ দেন। সুষ্ঠু ইলেকশনে হাসিনাকে সুযোগ দেন। এই যে আপনাদের ফেয়ার নির্বাচন চাওয়া, এই চাওয়াটা এখনকার মতো তখনও প্রবল থাকলে দেশে ৫ আগস্ট আসতই না। আপনারা ৫ আগস্টের অন্যতম অনুঘটক, যারা দিনের পর দিন ভোটবিহীন গণতন্ত্রের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন।
আমি নিজে আওয়ামী সমর্থক পরিবারে বড় হয়েছি। আমার বাবার আওয়ামী সমর্থনের পাগলামীর গল্প রেডিওতে বলেছি। এখানে না-ই বলি। শুধু এতটুকু বলি, আমার বড় বোন তার ছোট্ট ছেলেকে ‘যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই' গানটা শিখিয়েছি মুখে বুলি ফোটার সময়ই। আমার সেই বোনই তার সন্তানকে জুলাই আন্দোলনে পাঠিয়ে দিয়েছিল।
আমাদের লুটেরা রাজনৈতিক সংস্কৃতি না বদলালে দেশ কখনও বদলাবে না। কিন্তু এই সংস্কৃতি বদলাবে কী করে? আপনি-আমিই তো বদলাচ্ছি না। আমার ফ্রেন্ডলিস্টে আওয়ামী সমর্থকই বেশি। কিন্তু এদের অনেকে মনে করে না, হাসিনার কোনো ভুলই ছিল। এমনকি ক্ষমতা আঁকড়ে ধরতে মরিয়া হয়ে এতগুলো মানুষের প্রাণ নেওয়ার পরও। যাদের মধ্যে ১৩৩ জনই ছিল শিশু!
আমার কেবলই মনে হয়, এই যে অন্ধ আনুগত্য, এটা আপনাদের বাঘের পিঠে তুলে দিচ্ছে। সজীব ওয়াজেদ জয় রয়টার্সকে দেওয়া ইন্টারভিউয়ে স্পষ্ট হুমকি দিয়েছেন, বাংলাদেশে সামনের দিনগুলোতে ‘ভায়ো*লেন্স' হবে। 'কনফ্রন*টেশন' হবে। আর তাকে এই হুমকি দেওয়ার সাহস আপনারাই জুগিয়ে যাচ্ছেন।
আপনারা আরেকটা প্রশ্ন করেন, হাসিনার পতনের পর দেশে ভালো কিছু হয়েছে কি? আমি আমার বোনকে দিয়েই এর উত্তর বুঝি। আবারও যদি দেশে এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়, আবার আমার বোন তার ছেলেকে পথে নামিয়ে দেবে। এবং এবার সেও নামবে।
এই বাংলার মানুষ কৈবর্ত বিদ্রোহ করেছিল ১ হাজার বছর আগে। এই বাংলার মানুষের বিদ্রোহী সত্তা সবচেয়ে বেশি তো আওয়ামী লীগেরই চেনার কথা।



পাঠকের মন্তব্য