নিউইয়র্কের মেয়র ইলেকশনে মুসলিম সোশ্যালিস্ট প্রার্থী জোহরান মামদানির নির্বাচনী প্রচারণার প্রাণ বাংলাদেশের নারীসমাজ। একজন নারীর ইন্টারভিউ দেখলাম যিনি, ২০০৮ সালে নিউইয়র্কে গিয়ে দোকানে বিপণনের কাজ করতেন; মাথায় স্কার্ফ বাঁধার কারণে নিউইয়র্ক শহরে ইসলামোফোবিয়ার সম্মুখীন হয়েছেন; দক্ষিণ এশিয়ার নানা কম্যুনিটির নারীদের নিয়ে একটি সংগঠন গড়ে তোলার সময় গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারিতে পড়েছেন; তিনি সব কিছুকে অতিক্রম করে নিউইয়র্কে তার নাগরিক অধিকার বুঝে নিয়েছেন। বাংলাদেশী নারীদের এই সিভিল রাইটস মুভমেন্টের মাঝ দিয়ে গড়ে ওঠা তাদের কন্যাশিশুরা মামদানির অনুপ্রেরণায় নিজের কমিউনিটিকে নেতৃত্ব দেবার অনুপ্রেরণা লাভ করেছে। স্কুলের ছেলে-মেয়েরা যারা এখনও ভোটার হয়নি; তারা মামদানির নির্বাচনি প্রচারণায় অংশ নিয়েছে। সংগীত, আর্ট-ওয়ার্ক কি নেই তাদের প্রচারণায়।
বাংলাদেশের দুর্ভাগ্যপীড়িত মানচিত্র থেকে শেকড় উপড়ে দেশান্তরী হওয়া নারীসমাজ নিউইয়র্কে দেখিয়ে দিয়েছেন; ন্যুনতম গণতান্ত্রিক পরিবেশ থাকলে তারা কীভাবে সিভিল রাইটস মুভমেন্ট করতে পারেন; নিজের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচনে জেতাতে দিনরাত পরিশ্রম করতে পারেন।
নিউইয়র্কের ঐ বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত নারী সমাজ আর তাদের কন্যা শিশুদের প্রত্যয় দেখে; চব্বিশের জুলাই বিপ্লবের জননী সাহসিকা ও তাদের বীর কন্যাদের স্মৃতি মনে পড়ে গেল। বাংলাদেশের এই নারীসমাজ জুলাই বিপ্লবে পথে নেমে না এলে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন ছিল অসম্ভব।
কিন্তু জুলাই বিপ্লবের পর পরাজিত শক্তি জুলাই তরুণীদের টার্গেট করে সাইবার বুলি শুরু করে। পুরো ফ্যাসিস্ট আমলে তারা ভিন্নমতের নারীদের যেভাবে অশালীন সাইবার বুলি করে স্তব্ধ করে দেবার চেষ্টা করেছে; জুলাই বিপ্লবের পর পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে আরও হিংস্র হয়ে উঠেছে এই উপমানবেরা। ফলে অনেক জুলাইকন্যাই ধীরে ধীরে নিজেদের সোশ্যাল মিডিয়া সক্রিয়তা থেকে সরিয়ে নিয়েছে।
আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে পরাজিত শক্তির নারীদের অনেকে পুরুষের ব্যবহৃত অশালীন ভাষায় জুলাই কন্যাদের সাইবার বুলি করে চলেছে। নিউইয়র্কে বসেই মামদানির জন্য প্রচারণা না চালিয়ে আণ্ডালীগের ক্যাডার হিসেবে সাইবার বুলি চালাচ্ছে।
জোহরান মামদানি ভারতের গুজরাটি বংশোদ্ভুত। গুজরাটে মুসলিম গণহত্যা চালানোর কারণে নরেন্দ্র মোদীর তীব্র সমালোচক মামদানি। সে কারণেই হিন্দুত্ববাদী ও আণ্ডালীগ তাকে অপছন্দ করে। মানে নিউইয়র্কে গিয়েও সভ্যতার সঙ্গে থাকতে পারবে না তারা। ফলে ঘুরে ফিরে বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির ধনুক ভাঙ্গা পণ তাদের।
যে বাংলাদেশী নারীরা মামদানির পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন; তারা সহজ-সরল বাংলা মায়ের প্রতিভু। হিন্দু-মুসলমান-শিখ সবাই মিলে বন্ধুত্বের এক নির্মল বাতাবরণ তৈরি করেছেন তারা। তাদের ছেলে-মেয়েরা সহজ সরল মন নিয়ে সভ্যতার জগতে ভবিষ্যত নেতৃত্বের জন্য তৈরি হচ্ছে। ইংরেজিতে এত প্রত্যয়ী বক্তব্য তাদের যা জুলাই তরুণ-তরুণীদের বক্তব্যের সঙ্গে মিলে যায়।
বাংলাদেশে বস্তাপচা হিন্দুত্ববাদ আর ইসলামপন্থার বিপ্রতীপ বচসা ও বিদ্বেষের কারবারে জুলাইয়ের সেই বন্ধুত্বের বাতাবরণে মালিন্য এসেছে। আর এই ক্ল্যাশ অফ প্রিমিটিভিজমের সবচেয়ে বড় ভিক্টিম জুলাইয়ের নারীরা। প্রিমিটিভেরা তাদের অন্ধত্বের প্রিজমে সাইবার বুলির লক্ষ্য খুঁজে নিলে; শেষ পর্যন্ত এর ভিক্টিম নারী।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সালোয়ার কামিজ পরা ছাত্রীকে অশ্লীল বুলি করেছে, চারুকলার চিত্রকর ঘিনঘিনে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে ডাকসুর হিজাব পরা প্রার্থীর শিং এঁকে দিয়েছে; শিল্প-সাহিত্য করা লোক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষিকাকে নিয়ে অশালীন ফেসবুক পোস্ট লিখেছে। শিক্ষিত সমাজের এই যেখানে গড় রুচি; সেখানে প্রায় অর্ধশিক্ষিত হিন্দুত্ববাদী সিপি গ্যাং ও ইসলামপন্থী বিকে গ্যাং-এর রুচি একই অনুপাতে নিম্নগামী।
জুলাই বিপ্লবী নারীদের বুলিতে আওয়ামী লীগ, জামায়াত নারীর বুলিতে বামপন্থী ও আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী নারীর বুলিতে জামায়াত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকার বুলিতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ; এনসিপির নারীর বুলিতে লীগ-বিএনপি ও বামপন্থী, এইভাবে সবগুলো রাজনৈতিক বলয় ধরা পড়ে নারীর প্রতি সাইবার সহিংসতায়। রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের স্ব স্ব সাইবার সৈনিকের অপকর্মের দায়িত্ব নিতে হবে। জবাবদিহি করতে হবে। সেটাই গণতান্ত্রিক অনুশীলন।
বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৫১ শতাংশ নারী। শিক্ষার হার ও ফলাফলে নারী এগিয়ে। পেশাগত জীবনে সফল নারীরা। নারী শ্রমিক দেশের জিডিপির উল্লেখযোগ্য অংশ জোগান দেয়। প্রতিটি ক্ষেত্রে গুনগত মানে পিছিয়ে পড়েছে পুরুষ সমাজ। তাই তো রাজনীতিতে নারীকে অলংকার হিসেবে সাজিয়ে রাখার ষড়যন্ত্রটি এই একবিংশ শতকেও ক্রিয়াশীল। নীতিনির্ধারণে নারীর অভিমতকে দমিয়ে রাখতে কমিউনিস্ট ও ইসলামপন্থী কিংবা জাতীয়তাবাদী; একইরকম পুরুষতান্ত্রিক। নারী যে বাধা ঠেলে দৌড়ে প্রতিদিন এগিয়ে যাচ্ছে; এই হিংসা থেকে পুরুষেরা নানা রাজনৈতিক দলের বলয়ের মুখোশে নারীকে সাইবার বুলি করে তাকে স্তব্ধ করে দিতে চেষ্টা করছে।
নারীকে তার পোশাক, লাইফ স্টাইল ইত্যাদি বিতর্কে আটকে রেখে; আর পুরুষতন্ত্রের প্ল্যাকার্ড ও এজেন্ডা নিয়ে দৌড়ানো কিছু ফ্যাশনেবল নারীকে মিডিয়াজেনিক করে তুলে; নারীর মূল অধিকারের লড়াই থেকে তাদেরকে দূরে রাখা হচ্ছে। স্বর্ণময়ীর আত্মহত্যায় কারা প্রতিবাদের ঝড় তুলবে; আর মনামীর অশ্লীল এ আই ভিডিও দেখে কারা নির্লিপ্ত থাকবে, হিজাব না পরার জন্য শিক্ষকের বুলিতে কারা সক্রিয় থাকবে আর হিজাব পরার কারণে বুলির ভিক্টিম নিয়ে কারা নির্লিপ্ত থাকবে; এইরকম স্টেরিওটাইপিং-এর রোগীরা দলীয় স্বার্থে কাজ করে নারীর সামগ্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে দ্বিধাবিভক্ত করে রেখেছে।
সেই যে জুলাই-এ হিজাব পরা মেয়ে আর টপস ও জিনস পরা মেয়ে হাত ধরে লড়াইয়ে নেমেছিল; তাদেরকে ঘোড়েল জামায়াতি নারী আর ঘোড়েল বামপন্থী আন্টি আলাদা করে কোলে নিয়ে আবার শুরু করল আমরা বনাম ওরার খেলা। অল্পবিস্তর শিক্ষিত হবার কারণে এরা ঘোড়েল। আর নিউইয়র্কের নারী সমাজ অতো ইসলামি শিক্ষিত বা সংস্কৃতি শিক্ষিত না হওয়ায়; তারা ঐক্যবদ্ধ থাকতে পেরেছেন। ফলে তারা তাদের সিভিল রাইটস মুভমেন্টে হিজাব পরা আর টপস ও জিনস পরা তরুণী-কিশোরীরা ঐক্যবদ্ধ থাকতে পেরেছে।
হিজাব পরা মেয়েকে অপদস্থ হতে দেখলে কথিত প্রগতিশীল নারী মুখ টিপে হাসে; টপস ও জিনস পরা মেয়েকে অপদস্থ হতে দেখলে ইসলামশীল নারী মুখ টিপে হাসে; এই সস্তা পুলক, ক্ষুদ্র গোত্রবদ্ধতা আর ভ্রান্ত শ্রেষ্ঠত্বের বোধ, কুঁচকুঁচানি পরচর্চার বিজন স্বভাব থেকে বের হতে না পারলে প্রয়োজনীয় নারী ঐক্য হবে না।
অনলাইনে কিংবা ভূমি বাস্তবতায় যে কোনো নারী লাঞ্ছনার ঘটনায় ঐক্যবদ্ধ নারী প্রয়াস ছাড়া গুরুতর এই সংকটের কোনো সমাধান নেই। সাইবার বুলি নারীর মনোস্তত্বের মারাত্মক ক্ষতি করে। তার কর্মস্পৃহা নষ্ট হয়ে যায়। নারীকে এইভাবে অগ্রগতির দৌড়ে পিছিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র এই পুরুষ সমাজ ও পুরুষতান্ত্রিক নারী সমাজের অন্তহীন সাইবার বুলি।
সাইবার বুলি যারা করে, তারা আসলে ব্যর্থ মানুষ। হয় সে পেশাগত জীবনে ব্যর্থ; অথবা সে ব্যক্তিগত জীবনে ব্যর্থ। ব্যক্তিগত হতাশা থেকেই এরা সাইবার বুলি করে। এটা আসলে মেন্টাল ডিজ অর্ডার।
যে কোনো পোস্টে নারীকে সাইবার হ্যারাসমেন্ট করতে দেখা মাত্র আমি প্রতিবাদ জানাই; তারপর ঐ বুলিয়াড় পুরুষ অথবা নারীকে ব্লক করে দিই। আমার পৃথিবীতে এসব হিংস্র উপমানবকে দ্বিতীয়বার দেখতে চাই না।



পাঠকের মন্তব্য