মজলুমের মন থেকে মোছা যায়নি যেই মাওলানার নাম!

১১৮ পঠিত ... ১৮:৩০, নভেম্বর ১৭, ২০২৫

একবার তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘হুজুর, আপনার বাড়িতে কেউ গেলেই সঙ্গে সঙ্গে আপনি তাকে কিছু খেতে দেন। কারণ কী?’

মওলানা বললেন, ‘মানুষের খিদা কী জিনিস, তা আমি ছোটকালেই দেইখেছি। কচু, ঘেঁচু, জোয়ার, বাজরা খাইয়া মানুষকে বাঁচতে দেইখেছি। যে কৃষক জমিদার-জোতদারের ফসল ফলায় সেই কৃষকেরে আমি ভাত না খাইয়া মরতে দেইখেছি। দূরদারাজ থিকা মানুষজন আমার কাছে আসে, কোন সময় কী খাইয়া রওনা দিছে।’

বিদেশীরা তাকে বলে ‘প্রফেট অব ভায়োলেন্স’ না হলে ‘মাও অব ইস্ট ইনডিজগাইজ অব এ প্রিস্ট’। প্রথম বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে অংশ গ্রহণ করে বিশ্ববাসীকে বলে এসেছেন, আমার ধর্ম শান্তির ধর্ম, আমার রাজনীতি শান্তির, আমি শান্তির মাঝেই বাস করি এবং শান্তিই আমার অভিবাদন।

মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর কথা বলছি। বাংলার মাওলানা, লাল মাওলানা। মানুষ তাকে মজলুম জননেতা বলতে কুণ্ঠা বোধ করে না, কিন্তু পেছন দিক থেকে কমিউনিস্ট তাকমা দিয়ে দু'ঘা মেরে দিতেও ছাড়ে না। আমাদের মাওলানা; লাল মাওলানা।

জামায়াত সম্পর্কে সেই তখনকার দিনেই বলেছিলেন, 'নীল নদের পানি যেমন নীল নয়, জামায়াতের ইসলামও ইসলাম নয়’। আসলেই এটা কোন ইসলাম নয় বরং এটা হল মওদূদীবাদ । কিন্তু সমস্যা হলো আমাদের দেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ তারা ইসলামকে ভালবাসে তাই ইসলাম শুনলেই যাচাই বাছাইয়ের মানসিকতা থাকে না।

পাকিস্তানের মুলতানে প্রখ্যাত সাংবাদিক এরশাদ মজুমদারকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবের মধ্যে পার্থক্য কোথায়। প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, মাওলানা সাহেবের সংসদ বা পার্লামেন্ট হচ্ছে ধানক্ষেত আর কল-কারখানা। এই সংসদের সদস্যরা হচ্ছেন কৃষক শ্রমিক মেহনতি জনতা। আর শেখ সাহেবের লক্ষ্য হচ্ছে ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নেতা হওয়া। যে গণতন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করবে ধনী পরিবার।

মাওলানা সাহেব ছিলেন একজন দূরদর্শী নেতা এবং পঞ্চাশের দশকেই নিশ্চিত হয়েছিলেন যে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ একটি অচল রাষ্ট্রকাঠামো। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের কাগমারী সম্মেলনে তিনি পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসকদের 'ওয়ালাকুমুসসালাম' বলে সর্বপ্রথম পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার ঐতিহাসিক ঘণ্টা বাজিয়েছিলেন।

এরপর ৭০-এর ২৩ নভেম্বর তিনি পল্টনের জনসভায় স্লোগান দেন, ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। শামসুর রাহমান তখন কবিতা লিখলেন—‘হায়, একি মন্ত্র জপলেন মওলানা ভাসানী’।

সফেদ পাঞ্জাবী
শামসুর রহমান

শিল্পী,কবি, দেশি কি বিদেশি সাংবাদিক,

খদ্দের, শ্রমিক, ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, সমাজসেবিকা,

নিপুণ ক্যামেরাম্যান, অধ্যাপক, গোয়েন্দা, কেরানী,

সবাই এলেন ছুটে পল্টনের মাঠে, শুনবেন

দুর্গত এলাকা প্রত্যাগত বৃদ্ধ মৌলানা ভাসানী

কি বলেন। রৌদ্রালোকে দাঁড়ালেন তিনি, দৃঢ়, ঋজু,

যেন মহাপ্লাবনের পর নূহের গভীর মুখ।

সহযাত্রীদের মাঝে ভেসে ওঠে, কাশফুল-দাঁড়ি

উত্তুরে হাওয়ায় ওড়ে। বুক তার বিচূর্ণিত দক্ষিণ বাংলার   

শবাকীর্ণ হুহু উপকূল, চক্ষুদ্বয় সংহারের

দৃশ্যাবলীময়, শোনালেন কিছু কথা, যেন নেতা

নন, অলৌকিক স্টাফ রিপোর্টার। জনসমাবেশে

সখেদে দিলেন ছুড়ে সারা খাঁ খাঁ দক্ষিণ বাংলাকে।

সবাই দেখল চেনা পল্টন নিমিষে অতিশয়

কর্দমাক্ত হয়ে যায়; ঝুলছে সবার কাঁধে লাশ

আমরা সবাই লাশ, বুঝি-বা অত্যন্ত রাগী কোনো

ভৌতিক কৃষক নিজে সাধের আপনকার ক্ষেত

চকিতে করেছে ধ্বংস, পড়ে আছে নষ্ট শস্যকণা। 

ঝাঁকা মুটে, ভিখারী, শ্রমিক, ছাত্র, সমাজসেবিকা,

শিল্পী, কবি, বুদ্ধিজীবী, দেশী কি বিদেশী সাংবাদিক,

নিপুণ ক্যামেরাম্যান, ফিরিঅলা, গোয়েন্দা, কেরানী

সমস্ত দোকানপাট, প্রেক্ষাগৃহ, ট্রাফিক পুলিশ

ধাবমান রিক্সা, ট্যাক্সি, অতিকায় ডবল ডেকার

কোমল ভ্যানিটি ব্যাগ আর ঐতিহাসিক কামান

প্যান্ডেল, টেলিভিশন, ল্যাম্পপোস্ট, রেস্তোরা, দপ্তর

যাচ্ছে ভেসে; যাচ্ছে ভেসে ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ বঙ্গোপসাগরে

হায়! আজ একি মন্ত্র জপলেন মৌলানা ভাসানী।

বল্লমের মতো ঝলসে ওঠে তার হাত বারবার

অতিদ্রুত স্ফীত হয়; স্ফীত হয় মৌলানার সফেদ পাঞ্জাবী 

যেন তিনি ধবধবে একটি পাঞ্জাবী দিয়ে সব    

বিক্ষিপ্ত বেআব্রু লাশ কী ব্যাকুল ঢেকে দিতে চান।

১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল মাওলানা ভাসানী সোভিয়েত রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের কাছে পাকিস্তান বাংলাদেশের জনগণের ওপর যে বর্বরোচিত অত্যাচার চালাচ্ছে তার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেন। ৩১ মে মাওলানা ভাসানী এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ দখলদার বাহিনীর সঙ্গে জীবনমরণ সংগ্রামে লিপ্ত। তারা মাতৃভূমি রক্ষার জন্য বদ্ধপরিকর। তারা এই সংগ্রামে জয়লাভ করবেই। ৭ জুন মওলানা ভাসানী এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের সব অঞ্চল আজ দশ লাখ বাঙালির রক্তে স্নাত এবং এই রক্তস্নানের মধ্য দিয়েই বাংলার স্বাধীনতা আসবে।

মওলানার দাড়ি-টুপি ও লেবাসের কারণে তার প্রতিপক্ষের জন্য প্রচার করা সহজ যে তিনি একজন গ্রাম্য মুসলমান নেতা ছিলেন। সেকালের বাংলার জমিদারদের ৮০ শতাংশ ছিলেন হিন্দুধর্মাবলম্বী এবং তাঁদের প্রজাদের ৭০ শতাংশ ছিলেন মুসলমান। তিনি যখন জমিদার-জোতদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন, তা যাদের গিয়ে আঘাত করে, তাদের বারো আনাই হিন্দুধর্মাবলম্বী। সুতরাং বলা সহজ, ভাসানী একজন মুসলমান নেতা ও সাম্প্রদায়িক। যদিও তার অনুসারীদের একটি বিরাট অংশ ছিল হিন্দু। বাংলা ও আসামের বহু হিন্দু তাকে অবতার জ্ঞান করতেন।

তিনি বলতেন, হিন্দুর ক্ষুধা, মুসলমানের ক্ষুধা, বৌদ্ধের ক্ষুধা, খ্রিষ্টানের ক্ষুধা একই রকম। শোষক ও জালেমের কোনো ধর্ম নেই। মজলুমের কোনো ধর্ম নেই। জালেম হিন্দু হোক আর মুসলমান হোক, দেশি হোক আর বিদেশি হোক, কালো চামড়ার হোক আর সাদা চামড়ার হোক–সব সমান।

আওয়ামী লীগ পাঠ্যবই থেকে ভাসানী সম্পর্কিত সবকিছু উঠিয়ে দিয়েছে।

কিন্তু ইতিহাসে কোনো জালিম কি কখনও মজলুমের মন থেকে তার নেতার নাম মুছে দিতে পেরেছে? 

১১৮ পঠিত ... ১৮:৩০, নভেম্বর ১৭, ২০২৫

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top