নতুন কুঁড়ি থেকে কোথায় হারিয়ে গেল মুসলমান ঘরের সন্তানরা!

২৫ পঠিত ... ১১ ঘন্টা ২২ মিনিট আগে

লেখা: মোজাফফর হোসাইন

এবার নতুন কুঁড়িতে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ শিল্পী, পারফর্মার নাকি হিন্দুপরিবার থেকে আসা। হাহুতাশ করে ফেসবুকে প্রচুর পোস্ট দেখছি। পোস্টদাতারা শঙ্কিত দেশের বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্ঠী সংস্কৃতি চর্চা না করলে বাঙালি সংস্কৃতি মরে যাবে ভেবে!

কিন্তু এর জন্যে দায়ী কারা, কনজারভেটিভ মুসলমান নাকি প্রগতিশীল মুসলমান?

অবশ্যই প্রগতিশীল মুসলমানরা!

সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে দেশের মুসলিম পরিবারগুলো মোটাদাগে দুইভাগে বিভক্ত। একটা অংশ চায় না মুসলিম পরিবারে নাচ-গান-অভিনয়-চিত্রকলা চর্চা হোক। এসব ঘরের সন্তানদেরকে গান বা আঁকার স্কুলে ভর্তি করানো হয় না। বাড়িতে হয়তো আরবি শেখানো হয়। ‘বাঙালি সংস্কৃতি হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি', এমন শিক্ষা সন্তানদের দেওয়া হয়।

আরেকটা অংশ প্রগতিশীল। তারা ধর্মাচার পালনের পাশাপাশি বাঙালি সংস্কৃতি উদযাপন করে, সংগীত, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র এগুলো অ্যাপ্রিশিয়েট করে। সংস্কৃতিকে ধর্মের মুখোমুখি দাড় করায় না। এসব পরিবার থেকে নৃত্যশিল্পী, চিত্রশিল্পী, অভিনয়শিল্পী, সংগীতশিল্পী তৈরি হয়। এতদিন সেটাই হয়ে এসেছে। কিন্তু এখন এসব পরিবারের সন্তানদেরও আর নৃত্য, সংগীত, চিত্রকলা শেখানো হয় না। ব্যতিক্রম নিশ্চয় আছে। আমি গড়প্রবণতা নিয়ে কথা বলছি। একটা সময় রাজধানী থেকে শুরু করে মফস্বল শহরগুলোতে অধিকাংশ মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলিম পরিবারগুলো সন্তানদের এগুলো শেখাতো। তখন ছোটোবড় সব শহরেই প্রতিটি মহল্লায় গানবাজনা, আবৃতি, অঙ্কন, অভিনয় শিক্ষার স্কুল বা একাডেমি থাকত। স্কুলগুলোতে আলাদা করে আবৃত্তি, অঙ্কন, অভিনয়, সংগীত প্রতিযোগিতা হতো। বাবা মায়েরা সন্তানদের সৃজনকলা একাডেমিতে ভর্তি করাতেন। সামর্থ্য থাকলে বাড়িতে শিক্ষক রাখতেন। এখন আর আপনার মহল্লায় সেই স্কুল বা একাডেমিগুলো পাবেন না। থাকলেও সংখ্যায় খুবই কম, ধুকপুক করছে। মরলো বলে।

এখন প্রশ্ন হতে পারে, অধিকাংশ প্রগতিশীল মুসলিম পরিবারগুলোর সন্তানরা কেন সৃজনকলা শিখছে না? পারিবারিকভাবে চর্চা করছে না?

অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে। একটা কারণ, গত দেড় দশকে ‘গানবাজনা-চিত্রকলা মুসলমানদের জন্য হারাম' এরকম প্রচারণা এই পরিবারগুলোর একটা অংশকে আক্রান্ত করেছে। এমনকি শিল্পীরা নিজেরাও আক্রান্ত হয়েছে। নানা কারণে গানবাজনা, অভিনয় ছাড়ার পর ধর্মকে সামনে তুলে ধরেছেন।

আরেকটা কারণ: গানবাজনা, চিত্রকলা, আবৃত্তি এগুলোর দক্ষতা সামাজিক অর্থনৈতিক মূল্য আরও কমে গেছে।

একটা সময়, কোন শিক্ষার্থী স্কুলে গান বা আবৃত্তি পারলে শিক্ষকদের বিশেষ নজরে পড়ত, স্কুলে এক ধরনের তারকাখ্যাতি পেত, এখন উল্টো তিরস্কার জোটার সম্ভাবনা থাকে। শুধু স্কুলে না, অফিসেও যে লোকটা গান গায়, তাকে দাড়ি-টুপি মাথায় দেওয়া ঘুষখোর বসও শুনিয়ে দেন, 'মুসলমান যখন হয়েছ, এসব গানবাজনা ছাড়ো মিঙা’! ফলে এদের গুরুত্ব কর্মক্ষেত্রেও কমে যাচ্ছে।

আরেকটা বড় কারণ, কথিত প্রগতিশীল মুসলিম পরিবারগুলো অতিমাত্রায় বস্তুবাদি হয়ে উঠেছে। সন্তানদের ইংলিশ মিডিয়ামে পড়িয়ে বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে, বা দেওয়ার কথা চিন্তা করছে।

বস্তুবাদী তো কনজার্ভেটিভ পরিবারগুলোও। কিন্তু তারা সন্তানদের আরবি শিক্ষা দেওয়া, ইসলামি শিক্ষা দেওয়া, বাঙালি সংস্কৃতিবিরোধী মনোভাবী করে তোলা নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করে। এটাই তাদের ধর্ম। কিন্তু সংস্কৃতিবান প্রগতিশীল মুসলিম পরিবারগুলো সংস্কৃতিচর্চাকে তাদের দায়িত্ব, অবশ্য পালনীয় বলে গণ্য করে না। কনজার্ভেটিভ মুসলিম পরিবারের কাছে ধর্মচর্চা অপশন না, অপরিহার্য; কিন্তু প্রগতিশীল মুসলিম পরিবারের কাছে সংস্কৃতিচর্চা একটা অপশন মাত্র। ফলে সংস্কৃতিচর্চায় একটা বড় রকমের ধস নেমেছে বাঙালি মুসলিম পরিবারগুলোর মধ্যে। গান শুনছে ঠিকই কিন্তু সন্তানকে আর গান শেখাচ্ছে না। গানের শিক্ষকের মুখেই শোনা। ফলে মফস্বলে আর বাদ্যযন্ত্রের দোকান পাবেন না।

সংস্কৃতিচর্চার পারিবারিক ঐতিহ্য তৈরি করতে না পারার আরও একটা কারণ সংস্কৃতিবান পরিবারগুলোর সন্তানদের বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া। লক্ষ্য করে দেখবেন, দেশের প্রখ্যাত লেখক বুদ্ধিজীবী শিল্পীদের সন্তানরা অনেকে দেশের বাইরে প্রতিষ্ঠিত। এমনকি শিল্পীরাও একটা বয়সের পর নিজেরাই বিদেশ চলে যাচ্ছেন। গত দুই দশকে সংগীত ও চলচ্চিত্র অঙ্গনের শতাধিক সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি দেশের বাইরে চলে গেছেন। তৌকির, বিপাশা হায়াতের মতো তারকাদম্পত্তিও (ব্যক্তি বিষয় নয়, বিষয়টি বোঝাতে) দেশের বাইরে চলে গেছেন। তাদের কি অভাব ছিল দেশে? এই প্রশ্নের উত্তর আমার মতো গরীব সংস্কৃতিপ্রেমী খুঁজে পাবে না কোনোদিনই। (বিদেশে যাওয়া সমস্যা না, বরঞ্চ অনেক ক্ষেত্রে দেশের জন্য ভালো। কিন্তু দেশের প্রধান শিল্পীরা যখন দেশ ছাড়ে বুঝতে হবে শিল্পচর্চা সে দেশের নতুন প্রজন্মের জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্র না।) হিসাব করে দেখলাম, আমাদের শৈশবের তারকা অভিনেতা শিল্পীদের অর্ধেকের বেশি এখন দেশের বাইরে আছেন। আর যারা দেশে আছেন, তাদের আশিভাগ সন্তান দেশের বাইরে আছেন। কথিত কনজার্ভেটিভ লোকগুলো কিন্তু দেশ ছেড়ে যাচ্ছে না, বা সন্তানদের দেশের বাইরে পাঠানোর জন্য তৈরি করছেন না। তারা উল্টো দেশটাকে তাদের মতো করে তৈরি করে নিচ্ছেন। তাদের চেতনাবিরুদ্ধ কোনো রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত হলে তারা যূথবদ্ধ হচ্ছে, পথে নামছে। যেমন স্কুলে গানের শিক্ষক রাখার বিপক্ষে তারা আন্দোলন করছে, কিন্তু রাখার পক্ষের শক্তিরা আন্দোলনে নামছে না।

যারা বিদেশে যেতে চান বা নিজের সন্তানদের বিদেশে পাঠাতে চান, তাদের প্রশ্ন করে দেখবেন, বলবেন দেশ নিজের মতো না থাকা, দেশে নিরাপত্তাহীনতা, নানা রকম আশঙ্কা। অর্থাৎ দেশটাকে ছেড়ে দেওয়া। শুধু মৌলবাদীদের হাতে না, ঘুষখোরদের হাতে ছেড়ে দেওয়া, নষ্ট ভ্রষ্ট অপরাজনীতির হাতে ছেড়ে দেওয়া।

লক্ষ্য করে দেখবেন, বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য চড়া গলায় কথা বলেন লেখক-শিল্পীরা। আরবি ভাষা শিক্ষার বিপক্ষেও তারা সরব। কিন্তু দেখবেন, প্রত্যকে তাদের সন্তানদের ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াচ্ছেন। রাজধানীর নব্বইভাগ সামর্থবান লেখক-শিল্পী তাদের সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়াচ্ছেন। কারণ? বিদেশে পাঠানো, উন্নত ক্যারিয়ার। কেন? বাংলা মাধ্যমে পড়ে কি সন্তানরা ইংরেজি শিখতে পারেন না? বিদেশে যেতে পারে না? উন্নত ক্যারিয়ার গড়তে পারে না? যদি বাংলা এত অচলই হবে তাহলে এই ভাষার বিজ্ঞাপন আপনি কার জন্য করেন? অন্যের সন্তানদের জন্য? বলবে বাংলা মাধ্যমে পাঠ্যপুস্তকে সমস্যা, সিলেবাস দুর্বল!! এটা মিথ্যা না। কিন্তু কেন?? বড়লোক, প্রভাবশালী লোকজন, রাজনীতিবিদ, অধ্যাপক, আমলাদের সন্তানরা বাংলা মাধ্যমে পড়ছে না বলেই বাংলা পাঠ্যপুস্তক নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলছে। সবাই একাত্ম হলে শিক্ষাব্যবস্থা ধসের জন্য সরকারের পতন পর্যন্ত ঘটে যেতে পারে, একাত্ম হয়ে দেখেন। কিন্তু একাত্ম হওয়ার তাগিদ তখনই বোধ করবেন যখন নিজের সন্তান পড়বে।

এখন, যদি ক্যারিয়ারের কথা চিন্তা করে আপনি সন্তানকে বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতিবিমুখ করতেও দ্বিধাবোধ না করেন, তাহলে ধর্মীয় চেতনার জায়গা থেকে কেউ তার সন্তানকে অনুরূপ বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিবিমুখ করলে আপনার চেয়ে সে কি ভুল বা অন্যায় কিছু করছে?

প্রশ্নটার উত্তর আপনাকে দিতে হবে না। আমি শুধু বলতে চাই, বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার পক্ষে এই যে আপনি লড়াই করছেন, লক্ষ্য করে দেখেছেন, আপনার পরবর্তী প্রজন্মে এটা উদযাপন করার লোকজনই থাকবে না। কারণ আপনি নিজের ঘর থেকে কোনো উত্তরসূরী তৈরিই করছেন না।

দেশ ধর্মীয় কনজার্ভেটিভদের দখলে চলে যাওয়ার প্রধান কারণ দেশে ওদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া না, আপনার দেশে (থেকেও) না থাকা। মৌলবাদীদের কারণে না, আপনার কারণে, ইয়েস আই রিপিট, আপনার কারণেই আমি আমার সন্তানকে বাংলা মাধ্যমে পড়িয়ে এবং কনজার্ভেটিভ ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত না করে বিপন্ন বোধ করছি। তাকে গান শিখিয়ে বিপন্ন বোধ করছি। আমার সন্তানকে আপনিই একা করে দিচ্ছেন। সংখ্যালঘু করে দিচ্ছেন। ধর্মীয় সংখ্যালঘুর চেয়ে সাংস্কৃতিক সংখ্যালঘুরা এখন আরও বেশি বিপন্ন। শুধু আপনার কারণেই।

২৫ পঠিত ... ১১ ঘন্টা ২২ মিনিট আগে

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top