টাকের কর্নেল
(পর্ব-৭)
কারাগারে অধ্যাপক কর্নেল অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে পড়ায় কারাবন্দীদের মাঝে মাথা ন্যাড়া করার প্রবণতা বাড়ছে। বিকেলে তারা যখন ফুটবল খেলতে নামে তখন দূর থেকে মনে হয়; ব্রাজিলিয়ান ফুটবল দল খেলতে নেমেছে।
অধ্যাপক কর্নেল মাঠের পাশে চেয়ারে বসে তাদের উৎসাহ দেন। ব্যারিস্টার সুমন রেফারি হিসেবে দৌড়াদৌড়ি করে আর বলে, ভালো কইরা খেলো মিয়ারা; দরকার হয় আমার খামারের আটটা গরু বেইচা তোমাগো ক্লাব চালামু।
অধ্যাপক আবুল বারাকাত এসে অধ্যাপক কর্নেলের পাশে বসেন। কিছুক্ষণ খেলা দেখে তারপর বলেন, ড. কলিম আমি জেলখানার নাপিতদের জীবন নিয়ে একটা গবেষণা করলাম। এরা তপশীলি হিন্দু ও বিহারি মুসলমান। নিজ নিজ বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ হয়ে ভাগ্যান্বেষণে ঢাকায় এসেছে। এদের প্রত্যেকের বাস্তুভিটায় ঘুঘু চরিয়েছে সর্বদলীয় ঐক্যজোট।
অধ্যাপক কর্নেল চোখ ছল ছল করে বলেন, এরা তো সাব-অল্টার্ন; এদের সম্পদ কেড়ে নেয়া অত্যন্ত সহজ। কিন্তু দেখবেন উচ্চ বর্ণের হিন্দু ও আশরাফ মুসলমানদের বাড়িঘর কেড়ে নিয়ে সেখানে দখল নিয়েছে রাজনীতির পাণ্ডারা। এখানে এক একটি রাজনৈতিক পরিবর্তন মানেই পাণ্ডাদের ঈদ। ভাগ্য পরিবর্তনের বসন্ত।
–সিলেটের সাদা পাথর ডাকাতিতে দেখবেন একই সর্বদলীয় ঐক্যজোট কাজ করেছে। রাজনীতি এখানে দেশ লুন্ঠনের লাইসেন্স যেন।
–জুলাই বিপ্লবী একটি ছেলের হাঁস খাওয়ার সমালোচনায় দেশখেকোরা কেমন হাঁসফাঁস করছিল; তা তো দেখলেন। মাত্র ৩৫ টাকা হাতে নিয়ে ঢাকায় এসে পার্টির দালালি করে যারা অভিজাত হয়ে উঠেছে; তারা আবার বলছে, জুলাই বিপ্লবীর নাকি ওয়েস্টিনে যাওয়ার স্ট্যাটাস নেই। অথচ গত সরকারের সময় যখন গাজীপুরের এক কাঠমিস্ত্রির ছেলে ওয়েস্টিনের সুইমিংপুলে ভেসে ছবি দিত; তখন এরা স্পিকটি নট ছিল। টাঙ্গাওয়ালার নাতি যখন পাপিয়ার আসরে বাবুবিলাস করত; তখন কোন রা ছিল না; যেহেতু এরা আমেরিকায় সাবেক যুবরাজের বাজারের ব্যাগ টেনে পদ-পদবী বাগিয়েছিলো।
–এখন দেখবেন নতুন যুবরাজের পেছনে লাইন দিয়েছে নানা পদের তরল বুদ্ধিজীবী ও পাঁচিল টপকানির বেটা। এরা আসলে যুবরাজ ও তার পরিষদে খুব আরাম পায়। কিন্তু সাধারণ মানুষের ছেলেমেয়েরা যে জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে এসেছে; এটা তাদের কাছে হারাম। এদের মেরুদণ্ডে রাজা-বাদশাহ-র সামনে ঝুঁকে থাকার যে বেঁকে যাওয়া; ওটা ঠিক হবার নয়।
–বৃটিশের দালাল হিন্দু জমিদারের সামনে ঝুঁকেছে; লালসালুর পীর সাহেবের সামনে ঝুঁকেছে; তাই ঝুঁকে ঝুঁকে অদৃশ্য সাবানে হাত কচলানো তাদের স্বভাব।
কারা প্রধান দাঁড়িয়ে তাদের কথা শুনছিলেন। তিনি বলেন, স্যার আপনাদের মতো আলোকিত মানুষেরাও তো শেখ হাসিনার সামনে ঝুঁকে থেকে বলেছেন, গণতন্ত্র নয় উন্নয়ন চাই।
অধ্যাপক কর্নেল বলেন, এই তো সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র এসে গেছেন। আপনি আপনার কথা বলুন। এসব কথা শুনলে যদি কিছুটা প্রায়শ্চিত্ত হয় আমাদের।
শাহরিয়ার কবির এগিয়ে এসে বলেন, জেলার সাহেব, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ বা বিএনপির ছাতার নীচে না গেলে বদরুদ্দীন উমরের মতো নিঃসঙ্গ শেরপা হয়ে থাকা লাগে। এ সমাজে কাজ করতে গেলে আপনাকে হয় রহমান অ্যান্ড রহমান মাজারের যে কোন একটির খাদেম হতেই হবে।
কারাপ্রধান বলেন, স্যার আপনাদের যে যোগ্যতা আছে; তাতে কোন ছাতার নীচে না গিয়ে ডায়োজিনিসের মতো জ্ঞান সাধনা করতে পারতেন। অধ্যাপক রাজ্জাক, আহমেদ ছফা দেখুন কোন ছাতার নীচে না গিয়ে জ্ঞান সাধনা করেছেন; ফলে নতুন প্রজন্ম তাদের ঠিকই পুনরাবিষ্কার করছেন। কারণ নির্মোহ থেকে উনারা অমরতার আয়োজন করেছিলেন।
আক্ষেপের সূর্যাস্তে দীর্ঘশ্বাসের মতো একটা বিষণ্ণ চড়ুই এসে ঘাস ঠোকরাতে থাকে। অধ্যাপক কর্নেল লুকিয়ে চোখ মুছেন। সুচরিতাসু পেছন থেকে একটা সুগন্ধী রুমাল এগিয়ে দিয়ে গেয়ে ওঠে,
পরদেশী মেঘ যাও রে ফিরে।
বলিও আমার পরদেশী রে।।
সে দেশে যবে বাদল ঝরে
কাঁদে নাকি প্রাণ একেলা ঘরে,
বিরহ-ব্যথা নাহি কি সেথা বাজে না বাঁশি নদীর তীরে।।
পুনশ্চ: অতীতে সফদার ডাক্তার মাথা ভরা টাক তার, ক্ষিদে পেলে পানি খায় চিবিয়ের যুগে; টাক ছিল খানিকটা হাসাহাসির পাত্র। কিন্তু সমকালে পশ্চিমে হেয়ার ডু হিসেবে হেড শেভিং খুব স্টাইলিশ ফ্যাশন হিসেবে সমাদৃত। হলিউডের সুদর্শন অভিনেতা কেভিন কস্টনার থেকে জেসন স্ট্যাথাম, ভিন ডিজেল এই ফ্যাশনে নতুন মাত্রা এনেছেন। অনেক আগে টিভি সিরিজ কোজাকেও আমরা দেখেছি এই ফ্যাশনের শুরুটা। পশ্চিমা এই ফ্যাশন বাংলাদেশে প্রচলন করেছেন যারা, তাদের মধ্যে অধ্যাপক কর্ণেল কলিমুল্লাহ অন্যতম। এটা তার অগ্রসর চিন্তার সূচক।
(চলবে)
পাঠকের মন্তব্য