এক যে ছিল দীপাবলি, তার ছিল এক কালকূট

২৮৩ পঠিত ... ১৬:২২, মে ৩১, ২০২৫

লেখা: মাশরিন জাহান মনি 

এ জীবনে আমি প্রেমে পড়েছিলাম দুইবার।

একবার বইয়ের, দ্বিতীয়বার এক নাম না জানা মানুষের।

২০১১ সালের কথা। আমার তখন সবে এসএসসি শেষ হয়েছিল। তিন মাসের বিশাল ছুটি পেয়েছিলাম। এই তিন মাস ভালোভাবে কাটানোর জন্য অনেকগুলো লেখকের লিস্ট করে রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম এক এক করে পড়ব সব। কিন্তু বাধ সাধল ছোটোমামার পাঠানো পার্সেল। মামা তখন লন্ডনে থাকতেন। বছরে দুইবার বিশাল পার্সেল পাঠাতেন। সেখানে সবার জন্যই কিছু না কিছু থাকত।

সেবার আমার জন্য এল একটা ল্যাপটপ। আসল একটা ল্যাপটপ। ল্যাপটপ তখন খুব রেয়ার ছিল। কাজেই ল্যাপটপ হাতে পেয়ে আমি যেন আকাশের চাঁদ পেলাম। একদিকে তিন মাসের ছুটি, আরেকদিকে নতুন ল্যাপটপ—একদম সোনায় সোহাগা, যাকে বলে।

২০১১-তেই ফেসবুক আইডি খুললাম, একদম কৌতূহলের বশে। বাসার কেউই জানে না। সেসময় ফেসবুক চালানোটা মনে হতো বিশাল অপরাধের কিছু। তার ওপর আমি মেয়ে। তখনকার দৃষ্টিভঙ্গি এমন ছিল যে ভালো মেয়েরা ফেসবুক চালায়? এ কারণে ফেক একাউন্ট খুললাম। নাম দিলাম ‘দীপাবলির সাতকাহন’। তখন উপন্যাসটা সবে শেষ করেছিলাম। আমার চোখ-মুখে তখন দীপাবলির ঘোর। স্বপ্নে জলপাইগুড়ি ঘুরে বেড়াই, কলকাতা চষে বেড়াই, আর বাস্তবে ঘাঁটি ফেসবুক। নতুন নেশা হয়ে গেল এই ফেসবুক।

সাতকাহন মানে কী, সেটা এখনও ভালো করে জানতাম না। ভেবেছিলাম সাতকাহন মানে সাতটা কাহিনি। কিন্তু আসল অর্থটা জানাল সেই মানুষটা, যার নাম আমি জানি না, দেখতে কেমন তিনি, কোথায় থাকেন তাও জানি না। কিন্তু ওই কাঁচা বয়সে এমনভাবে তার প্রেমে পড়েছিলাম যে এ জীবনে আর কাউকে ভালো লাগল না!

মানুষটার ফেসবুক অ্যাকাউন্টের নাম ছিল ‘কালকূট’। শুধু এতটুকুই। অদ্ভুত লেগেছিল। গ্রহণ করেই তিনি নিজে থেকেই মেসেজ দিলেন। শুরুর দিকের কথাগুলো এখন আর স্পষ্ট মনে আসে না। কিন্তু যতটুকু মনে পড়ে, আমার আইডির নাম নাকি ইউনিক লেগেছিল তার কাছে। এমনটা সচরাচর দেখা যায় না ফেসবুকে। সেই মানুষটার কাছ থেকেই জানলাম, ‘সাতকাহন’ অর্থ সাতটা কাহিনি নয়—‘কাহন’ একটি পরিমাপের একক। কিভাবে গুণ ভাগ করে বুঝিয়েছিলেন, পুরোপুরি মনে নেই। কিন্তু সাতকাহনের শাব্দিক অর্থ তিনি করে দিলেন—‘অপরিমাপযোগ্য’।

এই মানুষটা দুইদিনের মাথায় আমার ঘুম হরণ করে নিলেন। সারাটা রাত মেসেজে কথা বলতাম আমরা। আমার বয়স তখন ১৬, ফেসবুকে দেওয়া ছিল ১৮। মানুষটার বয়স ফেসবুকে দেওয়া ছিল ২১, বাস্তবে কত জানি না। আমি সদ্য এসএসসি পাশ করা কিশোরী। উনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া তরুণ। উনার সম্পর্কে শুধু এতটুকুই জানতাম—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা বিভাগ, তৃতীয় বর্ষ। আর কিছুই না। আমি তার চেহারা দেখিনি, নাম জানি না।

শুধু জানি একটা শব্দ—‘কালকূট’। পরে উনি বলেছিলেন, ‘কালকূট’ শব্দের অর্থ বিষ। সেই কালকূট আমি পান করেছিলাম ২০১১ সালে। আজও আমার পুরো শরীর কালকূটে নীল হয়ে আছে।

আমাদের প্রেম হওয়ার কথা ছিল না। যদিও আমরা রাত জেগে অনেক গল্প করতাম, কিন্তু আমাদের নিজস্ব কোনো অনুভূতি ছিল না সেসব গল্পে। আমরা নিজেদের গল্প বলতাম না। সদ্য এসএসসি পাশ করা একটা মেয়েকে উনি পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন চার্লস বুকোস্কির সাথে, বুদ্ধদেব বসুর সাথে, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সাথে, কাফকার সাথে, নেরুদার সাথে, লিওনার্ড কোহেনের সাথে, বব ডিলানের সাথে, রবার্ট ফ্রস্টের সাথে—মনখারাপের সব কবিতার সাথে।

আমি ভেবেছিলাম উপন্যাস আমার সবচেয়ে প্রিয়, কিন্তু উনি আমাকে অদৃশ্য আঙুল ছুঁয়ে নিয়ে গেলেন কবিতার রাজ্যে। কী কী মনখারাপ করা কবিতা পড়াতেন! আমাকে প্রায়ই বলতেন, ‘জানো, দীপা, কবিতার সবচেয়ে সুন্দর নাম ‘কবিতা’।’

আমি ভালো করে বুঝতাম না। উনি বোঝাতেন, ‘ইংরেজিতে ‘কবিতা’বললে পোয়েট্রি, উর্দুতে শায়েরি, আরবিতে আশশির, জার্মানে গেদিখট, রাশিয়ানে স্তিখাতাভরেনিয়ে, চায়নিজে শি। কী অদ্ভুত নাম, তাই না? তোমার বুকের ভেতর ঝড়, তোমার বুকের ভেতরে ধূ ধূ শূন্যতা, তোমার বুক যুদ্ধাহত রক্তাক্ত ময়দান—তুমি এসবের প্রতিফলন ঘটাবে যেখানে, সেটার নাম যদি পোয়েট্রি হয়, গেদিখট হয়, স্তিখাতাভরেনিয়ে হয়, তাহলে ভালো লাগবে? কিন্তু বাংলা ভাষায় আমরা একে বলি ‘কবিতা’—কি সুন্দর, তাই না?’

তার সাথে আমার কথোপকথন এগোতো, আর আমার মধ্যরাত ভরে উঠত একশো একানব্বই নক্ষত্রে। উনি আমাকে বলতেন, ‘দীপা, জানো, নক্ষত্রেরও মৃত্যু হয়?’

আমি হেসে বলতাম, ‘জানিতাম। জীবনানন্দ দাশ তো বলেই গেছেন, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়।’

উনি সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করতেন, ‘উউহু, কবিতায় নয়, দীপা—সত্যি সত্যি নক্ষত্র মরে যায়। সুপারনোভা মরে গেলে প্রচণ্ড বিকিরণ ছড়ায়, পৃথিবী থেকেও দেখা যায় সেটা। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো সেই আলো পৃথিবীতে আসতে লক্ষ লক্ষ বছর লেগে যায়। কখনো যদি দেখো রাতের আকাশ দিনের মতো উজ্জ্বল হয়ে গেছে, তাহলে বুঝবে লক্ষ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে কোনও একটা নক্ষত্রের মৃত্যু ঘটেছে। সেদিন আকাশের দিকে তাকিয়ে আমাকে দেখবে?’

প্রতিরাতে আমাদের গল্প হতো—রাশিয়ান কোনো কবি, কোনো লেখক, কোনো বই, ইতিহাস, দর্শন, রাজনীতি—সবকিছু নিয়ে কথা বলতাম আমরা।

আমার প্রথম প্রেম ছিল বই। উনার সাথে পরিচয়ের পরে বইয়ের প্রতি আমার সেই প্রেম আরও শক্ত হলো, কিন্তু এবারে নিখাদ টান থেকে নয়; বরং প্রতিটি কথাই আমাকে বইয়ের দিকে ফিরতে বাধ্য করতো। এত সুন্দর করে গল্প করতে পারতেন উনি!

এই গল্পের মায়া আমাকে তার প্রেমে ফেললো। আমার বয়স তখন কাঁচা, কিন্তু আমি জানি, যে কোনও বয়সের কেউই একবার তার সাথে কথা বললেই তার প্রেমে পড়ে যেতে বাধ্য।

আমার দ্বিতীয় প্রেম হল সেই মানুষটা। কিন্তু এই মানুষটাও যে আমার প্রেমে পড়বেন, এমনটা কখনো ভাবিনি। কিন্তু সেটাই হলো—আমরা দুজন তীব্রভাবে একে অপরের প্রেমে পড়ে গেলাম।

আমি তার চেহারা দেখিনি, নাম জানি না। মানুষটা আমাকে ডাকতেন ‘দীপা’ বলে। তাকে বলতে ইচ্ছে হতো, ‘আমার নাম দীপা না, আমার নাম খুব সেকেলে—চামেলী। পাছে আমার নাম চামেলী জেনে উনি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন!’ তবু একদিন দ্বিধা নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আপনার প্রিয় ফুল কোনটা?’

তিনি চালাকি করে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমার প্রিয় ফুল—দীপা।’

কেঁপে উঠেছিলাম, অজানা এক অনুভূতিতে! জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘চামেলী ফুল কেমন লাগে আপনাকে?’

উনি বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখী ফুল হলো চামেলী—বর্ণহীন, হালকা সুগন্ধ, টুপ করে মাটির বুকে মুখ গুঁজে পড়ে থাকে। কবিতার যদি কোনো চেহারা থাকতো, তাহলে তা দেখতে হতো চামেলী ফুলের মতো।’

শুনে আমার হৃদয় ভরে ওঠলো ভালোবাসায়। বলতে ইচ্ছে করতো, ‘আমিই সেই কবিতা, আমিই সেই চামেলী, আপনি মাটি হয়ে আমার জন্য বুক পেতে থাকবেন?’ বলা হয়ে ওঠেনি—বলতে ভয় পেতাম যে আমার বয়স আঠারো না, আমি সবে ষোলো-এর কিশোরী। অন্য কেউ তো বুঝত না! সময় গড়ালো, দুটো মানুষ কেউ কাউকে না দেখে ভালোবেসে যেতে লাগলো, স্বপ্ন দেখতে লাগলো—একটা বিকেলের, একটা নদীর।

‘তুমি ময়ুরাক্ষী নদীর নাম শুনেছ?’

আমি হ্যাঁ বলি। উনি বলেন, ‘হিমুর ছিলো ময়ুরাক্ষী নদী, আমার আছে চিত্রা নদী। চিত্রা নদীর পাশে বসে তোমাকে আমি আমার লেখা গান শোনাবো।’

আমি কল্পনায় চিত্রা নদীর ছবি আঁকি।

২০১১ পেরিয়ে ২০১২ এল। দিনটা এখনো মনে আছে—ফেব্রুয়ারি ২৯। উনি আমাকে বলেছিলেন, পরের ২৯ ফেব্রুয়ারিতে আমাকে নিয়ে চিত্রার পাড়ে যাবেন, উনি পরবেন নীল পাঞ্জাবি, আর আমি সাদা খোলের শাড়ি। আমার হাত ধরে বসে থাকবেন পুরো বিকেল, সন্ধ্যা। তারপর আমরা ফিরব একই বাড়িতে—ছোট্ট একটা রুম হবে আমাদের, একটা বুকশেলফ, একটা রকিং চেয়ার, একটা ওক কাঠের টেবিল, দুটো মাটির চায়ের কাপ, আর একটা বিছানা—আমাদের। তারপর তিনি বলেছিলেন, এবং আমি লজ্জায় কান গরম হয়ে গিয়েছিলাম, ‘তোমাকে তখন ধরে বসে থাকতে হলে এই রুমে, এ সব নিয়ে।’

আমাদের কাল্পনিক সংসার চলছিলো। ততদিনে আমি পূর্ণেন্দু পত্রী পড়তাম। আমি তাকে ডাকতাম শুভঙ্কর, আর তিনি আমাকে নন্দিনী। আমি কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে টাইপ করতাম, ‘তুমি আজকাল অনেক সিগারেট খাচ্ছো, শুভঙ্কর।’

ওপাশ থেকে রিপ্লাই আসতো, ‘এক্ষুনি ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছি, কিন্তু তার বদলে?’ আমি লজ্জায় ল্যাপটপ বন্ধ করে রাখতাম।

আমাদের দেখা করার কথা হচ্ছিলো—আমাদের বাসা পুরানা পল্টনে, আর শুভঙ্কর থাকতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে। দেখা করার দিনক্ষণ ঠিক করা হচ্ছিলো—আমাদের প্রথম দেখা, স্মরণীয় হতে হবে, আকাশ মেঘলা থাকতে হবে যেন দেখেই ঝুম বৃষ্টি নামে। বৃষ্টিতে ভিজে আমরা হাঁটবো—বেইলি রোড, রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ফুলার রোড। দুজনের চুল থেকে টপটপ করে পানি পড়বে, তারপর শুভঙ্কর আমার চুলের পানি ঝেড়ে চোখের দিকে তাকিয়ে আবৃত্তি করবে, ‘এমনও দিনে তাকে বলা যায়… এমনও ঘন ঘোর বৃষ্টি…।’

কিন্তু কিছুই হল না। এক রাতে বাবা আমার ল্যাপটপ আছাড় মেরে ভেঙে ফেললেন। ভাঙবে না-ই বা কেন! ওই বয়সী একটা মেয়ে পড়াশোনা বাদ দিয়ে দিনরাত ল্যাপটপের সামনে বসে থাকে, খটাখট করে টাইপ করে, রহস্যময় ভঙ্গিতে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে হাসে, রাতে ঘুমায় না—এগুলি বাবা-মা বুঝবেনই না!

কয়েকদিন পর মোড়ের কম্পিউটার দোকানে গিয়ে আমি চেষ্টা করলাম আমার ফেসবুকে লগইন করার। কিন্তু অবাক হয়ে দেখি আমার একাউন্টের পাসওয়ার্ড কী ছিল, আমি ভুলে গেছি। মনে করার যত চেষ্টা করলাম, মনে হলো না! এবং বুঝে ফেললাম—শুভঙ্করকে হারিয়ে ফেলেছি আমি।

এরপর শুভঙ্করের সঙ্গে আমার সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেলো। দেড় বছরের পরিচয়, ছয় মাসের প্রেম—কেউ কারো হৃদয় ভাঙেনি, ঝগড়া করে মানভাগানও করেনি। তারপরও আমাদের প্রেম থেমে গেলো—যেন একটা রেলগাড়ি ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে মাঝপথে থেমে আছে।

কোনোভাবেই পারিনি শুভঙ্করের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। শুধু বারবার মনে হতো শুভঙ্কর জানে না কেন তার নন্দিনী যোগাযোগ বন্ধ করে দিলো; সে জানে না কেন তার দীপাবলির সাতকাহন থেমে আছে। এটা ভেবে কষ্ট আরও বেড়েছিল। কলেজ ফাঁকি দিয়ে ছুটে যেতাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে। কেউ বুঝতো না কেন কলেজ ড্রেস পরা একটা মেয়ে ভার্সিটির বারান্দায় ঘুরে বেড়ায়, ক্লাসরুমে উঁকি দেয়। প্রবল বৃষ্টিতে ভিজে হাঁটতাম ফুলার রোডে, ভিসি চত্বরে বসে থাকতাম ঘন্টার পর ঘন্টা। কেউ একটু কৌতূহলী চোখে তাকালেই দৌঁড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করতাম, ‘আপনি কি জানেন জার্মান ভাষায় কবিতাকে কী বলে?’

ভার্সিটিতে এসে প্রায় অর্ধেক ছাত্রছাত্রী জানে ফেলল—নীল সাদা ইউনিফর্ম পরা একটা মেয়ে সবাইকে কবিতার কথা জিজ্ঞেস করছে। তবুও শুভঙ্করকে খুঁজে পাইনি।

এরপর জেদ ধরলাম পড়াশোনায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তি হলাম। ভার্সিটিতে এসে প্রথম একটা নিজের ফোন হলো, আসল ফেসবুক একাউন্টেও ঢোকবার মতো তথ্য থাকলো। হাজারবার ‘কালকূট’ লিখে সার্চ করেছি, কিন্তু পাইনি—একটা পাহাড়সম অভিমান বুকে নিয়ে সে নিরুদ্দেশ হয়েই গেছে।

ভার্সিটিতে এসে কালকূটকে খোঁজার চেষ্টা আবার শুরু করেছিলাম। ওর কথা শুনে মনে হতো ও হয়তো থিয়েটার করে, আমি ঢাবির নাট্য সংসদে যোগ দিলাম। ওর যুক্তি-তর্কের উপস্থাপনা দেখে মনে হতো ও হয়তো বিতর্ক করে, আমি বিতর্ক সংসদে যোগ দিলাম। ও হাতড়াতো একটু বাম ধাঁধায়, তাই আমি ধীরে ধীরে বাম রাজনীতির সাথেও জড়িয়ে পড়লাম—একই উদ্দেশ্যে, কোনোভাবে যেন ওর কোনো খোঁজ পাই!

বাংলা বিভাগে নিয়মিত যাতায়াত করতাম। যদিও তখন কালকূটের অনার্স-মাস্টার্স শেষ হওয়ার কথা! তবুও মনে ক্ষীণ আশা ছিল—যদি কোনো খোঁজ পাই! পাইনি খুঁজেই। সাত বছর অপেক্ষা করেছি। সাত বছরে আমার কলেজ শেষ, অনার্স শেষ, মাস্টার্সও শেষ। বেসরকারি একটা কলেজে ঢুকেছি লেকচারার হিসেবে। বাড়ি থেকে বিয়ের তোড়জোড় করছে, কিন্তু পাত্র ভালো লাগছে না আমার—হবে কী করে? শুভঙ্কর যে স্ট্যান্ডার্ড সেট করে দিয়েছিল, ওর ধারেকাছেও তো কাউকে পাইনি। অথবা হয়তো খুঁজিনি, এ কারণেই একের পর এক পাত্র রিজেক্ট করতে থাকলাম। কারণ একটাই—ওদের কেউই জানতো না কবিতার রাশিয়ান প্রতিশব্দ কী, কেউই জানতো না কোন ফুল কবিতার মতো বিষণ্ণ, কেউই জানতো না নক্ষত্রের মৃত্যু হলে কী হয়।

আত্মীয়-স্বজন, আমার কলিগরা—অনেকে ভাবা শুরু করেছে, বই পড়তে পড়তে আমি পাগল হয়ে গেছি। এর মধ্যে একদিন এক কলিগের বাসায় দাওয়াত পেলাম—তার মেয়ের জন্মদিন। যেতেই হবে। যেতে চাইনি; এসব ভিড়, হৈ-চৈ আমার ভালো লাগে না। কিন্তু শেষ মুহূর্তে কী যেন মনে করে যেন গেলাম—ভাগ্যিস গেলাম!

জন্মদিনের উৎসব—চারপাশে উজ্জ্বল আলো, অসংখ্য বেলুন, আমরাও কয়েকজন কলিগসহ তাদের কিছু কাছের আত্মীয়, আর অনেক বাচ্চা-কাচ্চার হৈ-হুল্লোড়। কেক কাটা হবে। হ্যালোর আলো নিভে গেল, জ্বলল অনেকগুলো মোমবাতি। সেই মোমের আলোয় আমি দেখলাম চোখদুটো, আগুনের প্রতিফলন ধূসর চোখের মণিতে। কী ছিল ওই চোখে, কে জানে! আমি চোখ ফেরাতে পারিনি। চোখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সেই চোখদুটো আমার দিকে তাকিয়ে রইল। বুকটা ধক করে উঠল—অনেক দিন পর। আর অজান্তেই মুখ দিয়ে বের হলো একটা শব্দ—’কালকূট!’

না, কালকূটের চেহারা আমি দেখিনি কখনো; ওর চোখ কেমন, জানি না। যে মানুষটির চোখের দিকে আমি সেই সন্ধ্যায় তাকিয়েছিলাম, সেই মানুষটার নাম মুনিম।

মাথাভর্তি কোঁকড়া চুল, বুদ্ধিদীপ্ত দুটো চোখ, মুখভর্তি দাঁড়ি-গোঁফ, আর ঠোঁটের কোণায় একটা হাসি। মানুষটার সঙ্গে আমার কথা হয়নি সেদিন, কিন্তু আমার বিশ্বাস হতে যাচ্ছিল এই মুনিমই আমার কালকূট।

তারও অনেক পরে একদিন আবার বিয়ের প্রস্তাব এলো—পাত্র আর কেউই নয়, মুনিম নামের মানুষটা।

আমাদের কথা বলতে দেওয়া হলো আলাদা করে। আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই উনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘চামেলী, বলো তো, পৃথিবীর সবচেয়ে বিষণ্ন ফুল কোনটা?’

আমি চমকে তাকালাম তার দিকে, পূর্ণদৃষ্টিতে। মানুষটা হাসছিল—মনে হলো সেই হাসিটাই আমার চিরচেনা। হঠাৎ হৃদস্পন্দন থেমে গেলো কিছুক্ষণের জন্য। চোখ ভর্তি হয়ে গেলো জলে। আমি যন্ত্রের মতো বললাম, 'পৃথিবীর সবচেয়ে মনখারাপ করা ফুল হলো চামেলী, বিষণ্ন কবিতার মতো, একরাশ দুঃখ বুকে নিয়ে মাটির বুকে ঝরে পড়ে।’

এরপর ও আমাকে বলল, ‘কবিতার রাশিয়ান প্রতিশব্দ কী বলো তো?’

হঠাৎ দেখলাম আমি কেঁদে যাচ্ছি, কথা বলতে পারছি না। মুনিম একটু হেসে আমার মাথায় হাত রাখল। আমি তখন পাগলের মতো বলে যাচ্ছি, ‘আমি আপনাকে অনেক খুঁজেছি, কালকূট—কোথাও খুঁজে পাইনি। আমার ল্যাপটপটা ভেঙে ফেলেছিল বাবা, আমি পাসওয়ার্ডই মনে রাখতে পারিনি, যোগাযোগ করতে পারিনি।’

কতক্ষণ একনাগাড়ে বলে গেলাম সব—কিভাবে খুঁজেছি, কতদিন কোথায় বসে ছিলাম—সর্বস্ব রূপে মুনিম আমার কথা চুপচাপ শুনে গেলো। আমার কথা শেষ হলেও ও চুপ করে রইল। তারপর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি এসে গেছি তো, এখন সব ঠিক হয়ে যাবে।’

২০২০-এর শ্রাবণ মাসের এক সন্ধ্যায় বিয়ে হলো আমাদের। বাইরে প্রবল বৃষ্টি, কারেন্ট চলে গেছে, মোম জ্বালানো হয়েছে দুইটা। সেই মোমের আলোয় আমি কবুল,’ বলে রেজিস্ট্রি খাতায় সই করে চিরদিনের জন্য মুনিমের হয়ে গেলাম। কী রূপকথার মতো সবকিছু!

বাসররাতে সারারাত গল্প করেছি আমরা। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম যে মানুষটা মেসেজে এত বকবক করতো, সে বাস্তব জীবনে খুব চুপচাপ—আমিই বলে যাচ্ছি সব। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিভাবে খুঁজে পেলেন আমাকে?’

মুনিম আমার চুলে মুখ ডুবিয়ে উত্তর দিলো, ‘যেদিন আকাশ ভরা তারা থাকবে, যে রাতে আমাদের কারো কোনো দীর্ঘশ্বাস থাকবে না, সেদিন তোমাকে সব বলবো।’

এরপর পার হয়ে গেছে অনেক দিন। মুনিম কিছুই বলেনি। আমার মাঝেমাঝেই মনে হয়, মুনিমকে আমি যতটা হৃদয়ে ধারণ করেছিলাম, ততটা হয়তো ও করতে পারেনি। ওর কাছে ছোটোনাকিছুর স্মৃতি এখনও আমার কাছে জীবন্ত। অথচ ও ভুলে গেছে অনেক কিছুই। হঠাৎ করে মাঝরাতে জিজ্ঞেস করে বসে—

‘বলো না, চামেলী, আমরা কোথায় দেখা করার কথা বলেছিলাম?’

‘তোমাকে কী রঙের শাড়ি পরতে বলেছিলাম?’

‘তোমাকে কী আমার ছোটবেলার গল্প বলেছিলাম?’

‘বিয়ের পর আমাদের কোথায় যাওয়ার কথা ছিল?’

আমার অভিমান হয়—কেন ও এসব মনে রাখেনি! কিন্তু সাত-আট বছর তো কম সময় নয়, ভুলে যাওয়া স্বাভাবিক। এই ভুলে যাওয়ার স্বভাবটা বাদে মুনিমের কোনও দিকই কোনো কমতি নেই! এত ভালোবাসায় ভরিয়ে রেখেছে আমাকে, যত যত্ন আমাকে কেউ কখনো করেনি। সাত-আট বছর আগের সেই মধ্যরাতে যেমন ‘কালকূটের’ সঙ্গে কথা বলে আমার রাত ভরে উঠতো একশো একানব্বই নক্ষত্রে, এখন সবগুলো নক্ষত্র যেন আমার ছোট্ট ঘরটায়—দুই রুমের ছোট্ট ফ্ল্যাট, একটা বড় বেলকনি, বেলকনিতে একটা রকিং চেয়ার।

দুজনই অফিস থেকে শেষে ফিরি একই বাড়িতে, একই রুমে। রুমে একটা বুকশেলফ, বুকশেলফ ভর্তি বই, একটা ওক কাঠের টেবিল, দুটো মাটির চায়ের কাপ, আর একটা বিছানা—আমাদের। ঠিক যেমনটা স্বপ্ন দেখেছিলাম, প্রত্যেকটাই ও পূরণ করেছে। আমার শূন্য হৃদয় ভালোবাসার জন্য তৃষ্ণার্ত ছিল, মুনিম শ্রাবণের বৃষ্টি হয়ে এসেছে সেই তৃষ্ণা মেটাতে।

সবকিছু সুন্দর চলছিল। মাঝে মাঝে আমি জোর করতাম, ‘বলবে না আমাকে কিভাবে খুঁজে পেরেছিলে?’

মুনিম এড়িয়ে যেত। আমি বুঝতাম, দিনক্ষণ ঠিক করে পরে বলবে।

এরপর এলো সেই সময়টা—এক রাতে প্রবল আদর শেষে আমাকে বুকে নিয়ে বললো, ‘চামেলী, একটা মিথ্যা কথা বলেছি তোমাকে। আমি তোমার কালকূট নই, আমি শুভঙ্কর নই; কখনোই ছিলাম না। আমি শুধু মুনিম।’

আমি হেসে উড়িয়ে দিই, ‘কী কথা বলছ?’ কিন্তু ও আমাকে বিশ্বাস করিয়ে দেয়, সবটাই শোনায়—কীভাবে খুঁজে পেয়েছিল আমাকে। সেই সেদিনের চোখের নীরব আদলে ভালো লেগেছিল ওর দিকে—তাই বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলো।

আমি তড়িতাহতের মতো স্থির হয়ে যাই। চোখ ভরে জল নিয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘তাহলে কালকূট সাজার নাটক কেন করেছিলে?’

মুনিম উত্তর দেয়, ‘নাটক করিনি, চামেলী। আমি শুধু খোঁজ নিয়েছিলাম তোমার ব্যাপারে—তোমার বাবা-মা, ভাইদের সঙ্গে কথা বলেছি আগে। তারা আমাকে জানিয়েছে, তুমি আগে সব পাত্রকে ফিরিয়ে দিয়েছো কারণ ওরা তোমার বিষয়গুলো জানতে পারেনি। সবাইকে একই ধরনের প্রশ্ন করতে তুমি। তোমার বাবা-মা আমাকে পছন্দ করেছিলেন। তারা চেয়েছিলেন, এবারে অন্তত তুমি আর এমন প্রশ্ন করতে না পারো। তাই আমাকে সবটুকু আগে থেকেই বলে রেখেছিলেন। আমি তো জানতাম না তোমার এই কাহিনি! যখন গিয়েছিলে কলিগের বাড়িতে, আমি তো তোমাকে ডেকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি যেতে চাওনি। তোমার কাছে যেতে পারি না বুঝে, তোমার বাবাকে বলেছিলাম—তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলে তো আমি যাচ্ছি না! মিষ্টি করে জল দিতে হবে? তুমি হাসলে, হাসি আমাকে ভালো লাগবে। তখন বুঝতে পারলাম তুমি হয়তো ওভাবে ‘কালকূট’ভেবে আমাকে বারবার প্রশ্ন করছো। আমি ভেবেছিলাম, আগে আমি তোমাকে এইসব প্রশ্ন করে হতাশ করে দেবো, তারপর নিজেই সব খুলে বলবো। কিন্তু তুমি আমাকে আগে কালকূট ভেবে ফেললে, আমায় কোনো কথা বলতে দাওনি। আমি শুধু মনে মনে দগদগে প্যাশনে অপেক্ষা করেছি—তোমার ফেরার, তোমার খোঁজ পাওয়ার।

আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবেসেছি। আমি চাইনি তোমাকে হারাতে, তাই তুমি যেভাবে খুশি থাকতে চেয়েছো, সেটাই করেছি। কাঁদবে না, চামেলী—আমার দিকে তাকাও। দেখো, আমি কালকূট নই, কিন্তু তোমার মনে কালকূটের যে স্কেচটা ছিল, তার বাস্তব প্রতিচ্ছবি আমি।

কালকূট কোনো মানুষ নয়—কালকূট একটা চরিত্র, যা হারিয়ে গেছে। তবুও আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, যদি সত্যিই ও থেকে থাকে, পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক না কেন, আমি ওকে খুঁজে বের করব।

এই চামেলী, তুমিও তো ভালোবাসো আমাকে—পারবে না এবারে সত্যিটা জেনে ভালোবাসতে?

আমি পারিনি মুনিমকে সহজভাবে গ্রহণ করতে। অনেক দিন পার হয়ে গেছে, তবুও মুনিমের তুলনা হয় না—যেভাবে মানুষ সব চায় জীবনে, মুনিম তার থেকেও ভালো। খুব সুন্দর করে আবৃত্তি করে, চোখের দিকে তাকিয়ে কবিতা লিখে ফেলে, সহজ জিনিসকেও ওর শৈল্পিকতায় আবিষ্ট করে তোলেন। কিন্তু আমি সবেতেই বাধা অনুভব করি—হৃদয়ে একটা প্রতারণার ক্ষত তৈরি হয়ে গেছে। মুনিমের ভালোবাসায়, আমাদের ছোট্ট ফ্ল্যাটে দুই রুমে, যেখানে একশো একানব্বই নক্ষত্র জ্বলে উঠেছিল, সব ধীরে ধীরে খসে পড়ছিলো। আমি একেবারেই চুপচাপ হয়ে গেলাম। ততদিনে বুঝতে পেরেছি—কি দোষ মুনিমের? যদি আমি সত্যিই জানতাম ও কালকূট নয়, তাহলে তো আমাদের বিয়েটা হতোই না! যদি না হতো, আমি জানতামই না সত্যিকারের ভালোবাসা কেমন, সত্যি সত্যি বেলকনিতে দাঁড়িয়ে মাটির কাপে চা খেতে কেমন লাগে। মুনিমের অকৃত্রিম ভালোবাসা আমাকে একে একে ভুলিয়ে দিল সব ক্ষত।

আমি আবার প্রেমে পড়ি—সাতাশ বছর বয়সী এই জীবনে প্রেমে পড়েছিলাম দুইবার, এখন তৃতীয়বারের মতো পড়লাম এক জ্বলজ্বলে মানুষের প্রতি। শ্রাবণ মাসের এক ঝুম বৃষ্টির সন্ধ্যায় তার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। তার নাম মুনিম—মাথাভর্তি কোঁকড়া চুল, চোখে ভারী পাওয়ারের চশমা, মুখভর্তি দাঁড়ি-গোঁফ, কবি-কবি চেহারা। মন খারাপ হলে এই লোকটা গলায় বাচ্চাদের মতো করে আমাকে সুকুমার রায়ের ছড়া শোনায়। আমি হেসে ফেলি, ভালোবেসে ফেলি আরেকবার।

মুনিমের হঠাৎ আবদার—’যখন তখন শাড়ি পরো,’

সেদিন সকালে হাতে একটা ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘এই শাড়িটা পরে আসো, তোমাকে নিয়ে যাবো এক জায়গায়।’ ব্যাগ থেকে বের করে দেখি একটি সাদা খোলের শাড়ি, পাড়ে সুন্দর নকশা করা।

আমার হাত থেমে গেল—সাদা খোলের শাড়ি! কালকূট বলেছিল পরতে। হঠাৎ স্মরণ করলাম, আজ তো ২৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪ সাল। আমি বুঝতে পারি, মুনিম আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে। ২০১২ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি কালকূট বলেছিল সে আমাকে পরের ২৯ ফেব্রুয়ারিতে চিত্রার পাড়ে নিয়ে যাবে—উনি পরবেন নীল পাঞ্জাবি, আর আমি পরব সাদা খোলের শাড়ি। আমার হাত ধরে বসে থাকবে পুরো বিকেল, সন্ধ্যা। তারপর ফিরব একই বাড়িতে। আমার রাগ হয় মুনিমের ওপর—আমি চাই না এসব স্মৃতি মনে করতে। তবুও ও বারবার মনে করিয়ে দেয় আমাকে। আমি শাড়ি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করার মতো রাগে, জেদে ওর দিকে চেয়ে থাকি।

কিন্তু মুনিম আসে হাসিমুখে, নীল পাঞ্জাবি পরেনি—পরেছে সাদা পাঞ্জাবি। আমাকে জোর করে শাড়ি পরায়, হাত ধরে গাড়িতে তুলে বসায়। চিত্রা নদী নড়াইল হয়ে গাড়ি রওনা দেয় দুপুর এগারোটার দিকে। পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকাল নেমে আসে। গাড়ি থেকে নেমে মুনিম আমাকে নিয়ে যায় চিত্রার পাড়ে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি চিত্রার দিকে—কালকূট বলেছিল, ‘হিমুর ছিল ময়ুরাক্ষী, আমার আছে চিত্রা।’ আমি কালকূটকে পাইনি, কিন্তু কালকূটের নদীর সামনে দাঁড়িয়ে থাকি। চুপচাপ। মুনিম আমাকে সেখানেই দাঁড় করিয়ে জায়গা দেয়।

আমি কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম, তা জানি না। হঠাৎ শুনি কেউ ডাকছে, ‘দীপা!’ আমার হৃদস্পন্দন থেমে যেতে চায়। চমকে ফিরে তাকাই। আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে যে মানুষটা, তার বয়স চল্লিশের আশেপাশে। আমি তাকে জানি না, তবে তার ডাকটা আমার চিরচেনা। আমি কয়েক শব্দ উচ্চারণ করি, ‘কালকূট!’

মানুষটা হেসে ওঠে। আমি তাকিয়ে দেখছি—মাথায় কাঁচা পাকা চুল, গায়ের রঙ মাখামাখি, তীক্ষ্ণ নাক, বড় একটা গোঁফ, আর নিচে দুটো ঠোঁট—অসম্ভব কালো। আমি বিড়বিড় করে উঠি, ‘তুমি আজকাল অনেক সিগারেট খাচ্ছ, শুভঙ্কর!’

মানুষটা শুনে ফেলে, সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয়, ‘এক্ষুনি ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছি, কিন্তু তার বদলে?’ আমার লজ্জা আর নাই, কান্না আসে—আমার কালকূট আমার সামনে! বারো বছর পর আমাদের দেখা হলো, চিত্রা নদীর পাড়ে।

কতক্ষণ ছিলাম? দুই ঘণ্টা, তিন ঘণ্টা, নাকি আরও বেশি—আমি জানি না। মুনিম আশপাশে কোথাও ছিল না, শুধু একটা বিকেল, চিত্রার ঢেউ, আর কালকূট। কালকূটের আসল নাম অর্ধেন্দু—অর্ধেন্দু রায়। অর্ধেন্দু রাইই তো হওয়ার কথা, নাহলে কালকূট আর শুভঙ্কর এই নামগুলো কেমন করে আসতো! নাম দুটি যেন আরও অর্থবোধক হয়ে উঠলো আমার কাছে—কালকূট অর্ধেন্দু রায়, আর কানিজ ফাতিমা চামেলী। কী এক অসম জুটি!

কালকূটের বয়স ৩৮; বারো বছর আগে ওর বয়স ছিল ২৬। সদ্য মাস্টার্স শেষ করেই সে, অথচ বয়স লুকিয়ে আমাকে বলেছিল ২১, কারণ ২৬ বছর বয়সে ১৮ বছর বয়সী মেয়েকে ভালো লেগেছিল, বয়সের তফাত ছিল আট বছর—কিন্তু সংকোচে বলতে পারেনি। আমি তো সংকোচে বলতে পারিনি আমার বয়স ১৮ না, ছিল ১৬! সব কিছু পরিষ্কার হয়ে গেলো—আমি রাস্তায় খুঁজে ফিরছিলাম ২১ বছর বয়সী প্রেমিককে, আর কালকূট খুঁজছিল ১৮/১৯ বছর বয়সী তার প্রেমিকাকে। হাজারবার দুজন দুজনকে হয়তো পার হয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু চোখে পড়েনি—এই কারণেই।

বেলা গড়িয়ে গেল। সূর্য ডুবে যেতে যেতে ভাব, আমি ৩৮ বছর বয়সী অর্ধেন্দু রায়ের চোখে সূর্যের লাল আভা দেখলাম। ওর চোখের গভীরে একটা সুক্ষ্ম বিষাদ, আমার চোখ এড়িয়ে গেল না। অর্ধেন্দু সিগারেট ধরাল, ধোঁয়া ছেড়ে দিয়ে আবৃত্তি করল, ‘এ পৃথিবী একবার পায় তেমন, পায় না আর…’

সূর্য ডুবে গেলো। আমরা ফিরলাম—অর্ধেন্দু গেলো ওর বাড়িতে, যেখানে ওর অপেক্ষায় বসে আছে মাধুরী নামের এক সৌভাগ্যবতী আর সাত বছরের ছেলে শতদল। আমি ফিরলাম মেইন রোডে। শেষবারের মতো দুজন দুজনের দিকে তাকালাম।

কালকূট অর্থ—’তীব্র বিষ’। আমাদের দুজনের চোখই নিরবে বলে দিলো, আমাদের হৃদয়ের গভীরে একটা ছোট্ট কৌটায় আমরা কালকূট জমিয়ে রেখেছি। আমরা ফিরলাম—দুজন দুদিকে।

আমি চলে এলাম গাড়ির কাছে। গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে সাদা পাঞ্জাবি পরা একজন মানুষ—মুনিম, যার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য আমার সব ছোটোখাটো ইচ্ছা পূরণ করা। আমি গিয়ে তার হাত ধরলাম, মানুষটা আমার দিকে তাকিয়ে চুল সরিয়ে দিয়ে চুমু দিলো। আমার হাত শক্ত করে ধরে মানুষটা ফিসফিস করলো গালিবের কবিতা, ‘যখনই দেখেছি তাকে আমি অন্য কারো সাথে, বুঝেছি খোদা কেন শিরক পছন্দ করেন না…’

আমার সমস্ত ভার তার ওপরে দিয়ে গেলো, তারপর তার কাঁধে মাথা রেখে আমি নিঃশ্বাস ফেললাম। এরপর সন্ধ্যায় আধো আলো, আবছায়ায় আমরা ফিরলাম—একসঙ্গে, এক বাড়িতে, ছোট্ট দুটো রুম, একটা বুকশেলফ, একটা রকিং চেয়ার, একটা ওক কাঠের টেবিল, দুটো মাটির চায়ের কাপ, আর একটা বিছানা—আমাদের।

২৮৩ পঠিত ... ১৬:২২, মে ৩১, ২০২৫

আরও

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

রম্য

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top