প্রিজন ভ্যানে যেতে যেতে তন্দ্রাচ্ছন্নের মতো লাগে। মনে হয় এই তো সেইদিন প্রধানমন্ত্রী ডেকে বললেন, তোমাকে দেখলে বেশ সাহসী মনে হয়; তোমাকে খুঁজছে বাংলাদেশ। বিকেল বেলাতেই মফিজ স্যার ফোন করে বললেন, তোমাকে ‘বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং ইউ’ প্রকল্পে পোস্টিং দেওয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার ছবিটা দিয়ে স্ত্রী লুতফুন্নাহার ললিতা যখন ফেসবুকে লিখল, দোয়া করবেন, এখন ও আরও বড় দায়িত্বে।
শুভেচ্ছা আর শুভেচ্ছাতে ভেঙে পড়ল মন্তব্যঘর। কবিরা সেখানে দু'এক ছত্র স্তুতির পত্র লিখে গেল; হে চেতনার বীর, তুমি আছো বলেই আমরা নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারি।
স্ত্রী তার ফেসবুক আইডিতে প্রোমোশনের খবরটা দিলেও আনারকলি, আলপনা, কল্পনা ইত্যাদি আলো আসবেই-এর ফেসবুক ফেসেরা এসে ইনবক্স লাস্যে লিখতে শুরু করল, আপনার সাথে পরিচিত হতে চাই ভাইয়া।
সেদিন সাঁঝে সোনাইমুড়ি থেকে জব্বার চাচা ফোন করে বললেন, তুমি সোনাইমুড়ির নাম রৌশান করেছ বাবা। জানি ব্যস্ত মানুষ; রাজকাজ তোমার, তবু একবার সময় করে ঘুরে যেও।
আমি তো বেশি সময় দিতে পারি না; সারাক্ষণ পেগাসাস গলায় জড়িয়ে চোখে চোখে রাখতে হয় চেতনার শত্রুদের। তাই লুতফুন্নাহার ললিতাকে সামাজিকতাটা বেশি করতে হয়। আনারকলি, আলপনা, কল্পনা আরও-সব উপযাচক আলো আসবেই-এর তেলাঞ্জলির উৎপাত সামলাতে হয় তাকে।
জব্বার চাচার জোরাজুরিতে সোনাইমুড়ি বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের রিইউনিয়নে যেতে হলো প্রধান অতিথি হয়ে। একটু সংকোচ হচ্ছিল, ক্লাসমেটদের যারা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, গবেষক, সিনিয়র সচিব, প্রধান প্রকৌশলী, প্রথিতযশা ডাক্তার; সবাই বসে রয়েছে স্টেজের সামনে। আর আমাকে নিয়ে আদিখ্যেতা করছেন জব্বার চাচা। অনেক কষ্টে আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে স্টেজের সামনে গেলাম ক্লাসমেটদের সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আর সহ-সভাপতিরা এত ভীড় করলেন যে, বিব্রত হয়ে গিয়ে দাদার কবর জিয়ারত করলাম। জব্বার চাচা এসে বললেন, তোমার দাদার নামে এতিমখানা ও মাদ্রাসা করেছি; একটু দেখে যেও। মাদ্রাসায় ঢুকতেই কিশোরদের দেখে শাপলা অপারেশনের কথা মনে পড়ে গেল। মনটা কোমল হতেই মফিজ স্যারের শেখানো চাণক্যনীতি স্মরণ করি। কুদ্দুস স্যার যে মাঝে মাঝেই ফ্রিডেরিখ নিটশের উদ্ধৃতি দিতেন; সেটা স্মরণ করে; মনটা শক্ত করে গাড়িতে উঠে চলে আসি। সোনাইমুড়ি আমার সফট স্পট। বাসায় ফিরতেই লুতফুন্নাহার বলে, তোমাকে ঐ গ্রামে যেতে নিষেধ করেছি না। ঐখানে গেলেই তোমার শিভালরি হারিয়ে যায়।
এরপর প্রধানমন্ত্রী বীরত্বের জন্য পদক দেন। হেসে বলেন, তোমার জালে রুই কাতলা ধরা পড়ছে অনেক। পাশে দাঁড়িয়ে কুদ্দুস স্যার বলেন, আই এম প্রাউড অফ ইউ।
পরদিন অফিস করিডোরে রিনি রিনি হাসির শব্দ শুনে চমকে উঠি; হাসিটা এসে আমার অফিসে ঢোকে, আমার সামনের চেয়ারে পেখম মেলে বসে। সে রাশিয়ার একটা গল্প বলে। রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর এক কর্মকর্তাকে গোয়েন্দারা সন্দেহ করে যে, সে এমেরিকার হয়ে কাজ করছে। কিন্তু অনেক তদন্ত করে কিছুই খুঁজে পায় না। পরে ঐ রাশিয়ান কর্মকর্তা অবসর নিয়ে এমেরিকাতে স্থায়ী হয়। রাশিয়া থেকে তার এক সহকর্মী এমেরিকাতে বেড়াতে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে, এখন তো বলতে পার তোমার রহস্য। সে হেসে উত্তর দেয়, হ্যা কাজ করেছি। এমেরিকা আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিল যেভাবেই হোক রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর প্রমোশন দপ্তরে যেন কাজ করি। অপেক্ষাকৃত অযোগ্য কর্মকর্তাদের সুপারিশ করে প্রমোশন দিতে পারলে প্রতিপক্ষ কোন যুদ্ধ না করেই জিততে পারে। গল্পের রেশ কাটতে না কাটতেই রিনি রিনি হাসিটা তার পেখম তুলে চলে যায়।
মফিজ আর কুদ্দুস স্যার বিদেশে পালিয়ে গিয়ে একই বিল্ডিং-এর দুটো অ্যাপার্টমেন্টে আশ্রয় নেওয়ায় বোঝা যায় তারা পনেরো বছর অযোগ্যদের প্রমোশনের ব্যবস্থা করেছেন। নিজেকে অযোগ্য ভাবতেই ঝিমুনি ভাবটা কেটে যায়। পোস্টিংটা তাহলে ছিল অযোগ্যতার পুরস্কার।
প্রিজন ভ্যান থেকে নেমে আদালতের দিকে হেঁটে যাবার সময় চারিদিকে ঝাপসা লাগে। মনে হয় যেন অ্যানেসথেসিয়া টেবিলে শুয়ে আমি; অনেক দূর থেকে অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ ভেসে আসছে। হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে চোখে পড়ে একটি কিশোর আমার একটা ছবি উঁচিয়ে বলছে, এই দেখো এইভাবে তুমি আমার বড় ভাইকে গুলি করে মেরেছ। দ্রুত পায়ে হেঁটে আদালতে গিয়ে ঢুকে পড়ি।
পাঠকের মন্তব্য