লেখা: মাহবুব হোসেন
গ্রীষ্মকালেও সকাল সকাল বেশ আরামদায়ক ঠান্ডা ভাব পড়ে। সাজিদের বাবা-মা দুইজনেই সকাল-সকাল ওঠেন, গোসল করেন। আগে সাজিদের বাবা মসজিদে যেয়ে নামাজ পড়তেন, রিটায়ারমেন্টের পর থেকে প্রায় চার বছর হলো, ঘর থেকে বের হন খুব কম। তারপরে আবার কয়েক বছর আগে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, দেশের রাজনৈতিক অবস্থা কেমন না কেমন। সিঁড়ি ভাঙতে কষ্ট হয় দেখে বাসাতেই দুইজনে নামাজ পড়ে ফেলেন। ছেলে-ছেলের বৌ দুইজনেই চাকরি করে, এরা কখন ওঠে, কখন নাস্তা বানায়, কখন কাজে যাবে সেটার এমন তাড়াহুড়া থাকে যে ঠিক মত কথাই বলতে পারেন না।
আজ অবশ্য সাজেদা খাতুন ঠিক করে রেখেছেন যেভাবেই হোক ছেলের সাথে কথা বলতে হবে। তার বাবা, মইনুল সরকারের শরীর ভালো যাচ্ছে না। বেশ অনেকদিন হল খুকঃখুকঃ কাশি। এই বয়েসে অসুখের শুরুতেই ১-২ মাসের মধ্যেই ডাক্তারকে দেখতে হয়। অসুখ-বিসুখ বড় হয়ে গেলে সেটার চিকিৎসার টাকাও লাগবে অনেক। এমনিতেই তিনি সংসারের তেমন জৌলুশ দেখেন না, শুধু সুন্দর একটা অ্যাপার্টমেন্টেই থাকেন। এরকম অ্যাপার্টমেন্ট আশেপাশে অনেকেরই আছে, তেমন কিছু না। স্বামী-স্ত্রী দুইজনেই চাকরি করে, অথচ বাসায় কোন কাজের লোক নাই, এখনও বাচ্চা নিতে চাচ্ছে না। খরচ নিয়ে অবশ্য খোলা খুলি কোন আপত্তি করে না, প্রতি মাসেই বাবা-মাকে কিছু হাত খরচ দেয়।
নাস্তার টেবিলে তার ছেলে একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়ে একটা স্যান্ডউইচ খাচ্ছে। তাড়াহুড়া দেখে মনে হয় যেন কাজে গেলে আর খেতে পারবে না। ঠিক কি কাজ করে সেটাও সাজেদা খাতুনের কাছে রহস্যময়, এই মোবাইল ফোন-কম্পিউটারের যুগে কে যে কি করিতেছে বলা মুশকিল। বাংলাদেশের তো চেহারাই বদলায়ে গেছে। নাস্তার টেবিলে ছেলের বৌ একটু ধীর-স্থির, উনি তাকেই বললেন, বৌ, তোমার বাবাকে তো ডাক্তার দেখানো দরকার, কাশি অনেকদিন।
ছেলে বৌকে জবাব দেওয়ার সুযোগ দিলো না, কথা লুফে নিল, তা বাবা গেলেই তো পারে, হাসপাতাল তো দূরে না, হেটে গেলেও তো ১০ মিনিট লাগবে না। তার তো হাটা দরকার। হেটে যেতে না চাইলে ট্যাক্সি নিয়ে যাও।
'না, এখানকার হাসপাতাল কি আর ভালো? ভাবছিলাম ঢাকায় নিয়ে যাবো। তোদের সময় হবে না?' সাজেদা খাতুনের যথেষ্ট রাগ হল। ছেলে হয়ে বাবাকে হাসপাতালে নেওয়ার কথাটা মুখ দিয়ে বলবেও না?
এখানকার হাসপাতাল খারাপ হবে কেন? এখন কি আর আগের দিন আছে? ঢাকার হাসপাতালও যা এখানেও তাই। তুমি চাইলে বাবার-সাথে একবার ঘুরে আসো। পাশেই বাগান আছে, গেলে তোমারই ভালো লাগবে। তোমরা তো সারাদিন আছো বাসার ভিতরে।
ছেলের বৌ ও তার স্বামীর পক্ষে কথা বলার সুযোগ হাতছাড়া করল না, আরও এক কাঠি সরেস জবাব দিল, বাবার শরীর কি এতই খারাপ যে হাসপাতালে যেতে হবে? ডাক্তার কে ইমেইল করে জিজ্ঞেস করে নেওয়া উচিত ছিল না?
রাগে সাজেদা খাতুনের মুখে নাস্তার টক দই তিতা লাগলো। বলে কি এই মেয়ে। শ্বশুর-শ্বাশুড়ির ডাক্তার দেখানোটা একটা সেবার অংশ, সেটাও আজ-কাল-কার মেয়েরা জানবে না? তবে উনি আর কথা বাড়ালেন না। ছেলে কাজে যাচ্ছে, এখন ঝগড়ার সময় না।
মইনুল সাহেব কে বলতেই অবশ্য উনি ধমকে উঠলেন, তোমাকে আবার ঢাকায় যাওয়ার কথা বলতে কে বলেছে? ঢাকায় যাওয়ার খরচ আছে না? ছেলের বৌয়ের সামনে কেউ ছেলেকে এইসব খরচের কথা বললে ছেলেকে বেকায়দায় ফেলা হল না? বৌয়ের সামনে ছেলেকে ছোট করা হল না? সবার চিকিৎসাই কি ঢাকাতেই করতে হবে? আমার চিকিৎসার দরকার আছে আমার তো সেটাই মনে হয় না।
সাজেদা খাতুন দেখলেন তার ভুল ধরা পড়েছে, এখন অনেক ধমক শুনতে হবে। এর থেকে তার পুরানো অস্ত্রের আশ্রয় নেওয়া ভালো। যখন অন্য কোনো কথায় কাজ হয় না তখন চোখের পানিতে কাজ হয়। টপটপ করে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, আমার আব্বার জীবনটাও গেল বিনা চিকিৎসায়। মানুষে চিকিৎসা করতে ইন্ডিয়া যায়, ব্যাংকক যায়, আমি তো ঢাকায় যেতে বলছি।
মইনুল সাহেব এই চোখের পানির সাথে পরিচিত, কিন্তু বুঝলেন যে এইটা শুধু চিকিৎসা না, একটু ঘুরতে যেতেও ইচ্ছা হইছে। তার সাথে টাকা আছে। ছেলে যে টাকা দেয় সেটা তো খরচই হয় না। একান্তই মফস্বল এলাকায় থাকেন। আত্মীয় বন্ধুবান্ধব তেমন কেউই বেঁচে নাই যার পিছনে টাকা খরচ করতে হয়। টাকা জমা করেই রাখেন। তিনি কাশি চাপতে চাপতে বললেন, ঠিক আছে চল কাল ঢাকায় যাই। আমার কাছে কিন্তু টাকা বেশি নাই, তবে খরচ উঠে যাবে। দামি চিকিৎসা করতে চাইলে সেটা পারব না। সেটা পরে দেখা যাবে। যাওয়া আসার খরচ সাথেই আছে। চিন্তার কিছু নাই। কালকে সকালে চল।
সাজেদা খাতুনের মুখে হাসি ফুটলো। কিন্তু সেটা যথাসম্ভব গোপন করার চেষ্টা করে আরও কিছু অভিযোগ করতে চাচ্ছিলেন যে ছেলে থাকতেও একা একা যেতে হচ্ছে। কিন্তু মইনুল সাহেবের ধমকের ভয়ে পিছিয়ে গেলেন। ঢাকায় যাওয়ার কোথায় 'হ্যাঁ' বলাতে পেরেছেন, সেটার মুড নষ্ট করা উচিত হবে না।
ঢাকায় আসা পর্যন্ত কোন সমস্যাই হল না। মইনুল সাহেব এইটুকু ফোন ব্যবহার করতে জানেন। দুই-জন হেঁটে ট্রেন স্টেশন পর্যন্ত গেলেন। সেখানে কাউন্টারে জানালো যে ফোন থেকেও টিকেট কাটা যায়। সেই মতো টিকেট কেটে উঠে পড়লেন। তারপর সেখান থেকে ট্রেন ঢাকায় নামিয়ে দিল। আগে ট্রেন বদলাতে হত, এখন সরাসরি ট্রেন আছে। একটু দুশ্চিন্তায় ছিলেন যে ঢাকার স্টেশনে ঠিক মত নামতে পারবেন কিনা, কোথাও বেশিক্ষণের জন্য ট্রেন থামে না। কিন্তু সব ঠিকঠাক মতোই পারলেন।
ঢাকা শহরের চেহারা বদলে গেছে। স্টেশন থেকে হাসপাতাল পর্যন্তও হেটে যাবেন ঠিক করলেন। ১০ মিনিটের রাস্তা, ফোনের ম্যাপ ধরে হাঁটাই সুবিধা। ট্যাক্সি ভাড়া না জানি কত না কত হবে। তাছাড়া ভুল কোথাও নামিয়ে দিলে তো আরেক ভোগান্তি। তার স্ত্রী কে নিয়ে এর থেকেও অনেক বড় রাস্তা হেটে গেছেন। সারাজীবন কত হাঁটাহাটি করতে হল, সেই তুলনায় এখন তো রাস্তা চকচক করছে। কেমন যেন খসখসে পাথর বিছানো রাস্তা, কোন ধুলা নাই। সব লম্বা লম্বা বিল্ডিং, মনে হয় হাসপাতাল অনেক দামি এলাকায়।
সমস্যা শুরু হল দুইজন হাসপাতালে ঢোকার পর। ইমার্জেন্সি বিভাগের রিসেপশনে একটা সুন্দর মত মেয়ে হাসি মুখে বসে আছে, তাদের দেখে আরও হাসি দিয়ে বলল, আপনারা বসেন আমি এসে সমস্যা শুনে যাচ্ছি।
ওনারা বাহিরের সারিসারি রোগীদের যে সিট আছে সেখানে বসলেন। সেই যে বসলেন, তাপর থেকে বসেই আছেন। রিসেপশনে নার্সরা একেঅপরের সাথে হাসাহাসি করছে। সাজেদা খাতুনের রাগে মুখে রক্ত এসে গেল, মইনুল সাহেবও হিসাব মিলাতে পারলেন না। এইরকম হাসির মানে কি, উনি কি সার্কাসের টিকেট কাটতে আসছেন নাকি? বসতে বলে ২০ মিনিট কোন খবর নাই, এইটা কেমন কথা? ইমার্জেন্সি রুমে তেমন ভিড়ও নাই, ভিতরে কোনো ঘর থেকে অসুস্থ কারোর শব্দ আসতেছে। বড় জোর এক-দুইজন হবে এর বেশি না।
অবশেষে আরেকজন সুন্দরী নার্সের দেখা পাওয়া গেল, লম্বা এপ্রোন পরে, হাতে একটা চ্যাপ্টা কম্পিউটার নিয়ে দুইজনের পাশের খালি সিটটাতে বসল। এতক্ষন পরও ডাক্তার নাই, কপালে পড়ল এমন সাজগোজওয়ালা নার্স, মাথায় হিজাবের ওপর ক্লিপ দিয়ে নার্সের টুপি পরা। সাজেদা খাতুনের বিরক্তির সীমা থাকলো না।
আপনাদের মধ্যে রোগী কে? আপনাদের নাম ঠিকানা দয়া করে বলুন, আমি লিখে নেই। তারপর ডাক্তার আসবেন।
মইনুল সাহেব দেখলেন সারাদিনের জন্য হয়তো বসায়ে রাখবে। ওদিকে বেলা থাকতে থাকতে বাসায় ফেরা দরকার। ট্রেন মিস করে ফেললে তো মুশকিল। এখানে হয়তো বকশিস দেওয়া নিয়ম, কিন্তু সেটা দেওয়ার মত যথেষ্ট টাকা তারসাথে কি আছে?
দেখেন, আমরা অনেক দূর থেকে আসছি, আবার ফিরতে হবে। আমি রোগী। আমার অনেকদিন ধরেই কাশি। একটা ডাক্তার দেখানো দরকার। সেই সকালে রওনা দিছি। আমার বয়েস অনেক, এই বয়েসে বারবার আসতে পারবো না।
আপনারা কোথাথেকে আসছেন? কোন ডাক্তার পাঠিয়েছে? দেখি কাগজ।
আমাদের সাথে তো কোন কাগজ নাই, কোন ডাক্তার পাঠায়নি। আমাদের এলাকার হাসপাতাল কেমন না কেমন, তাই এখানে আসলাম।
নার্সের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। আপনাকে দেখে বুঝতে পারিনি যে আপনি এতো অসুস্থ। আপনাদের এলাকা কোনটা?
আমরা আসছি কাঞ্চন, রূপগঞ্জ থেকে। ঢাকা থেকে পূর্বদিকে, দূর আছে তোমরা হয়তো চিনবে না। মইনুল সাহেব আপনি-তুমি ঠিক রাখতে পারলেন না।
হ্যা আমি কাঞ্চন চিনি। আমাদের জরুরি বিভাগের স্যারর বাড়িও কাঞ্চন, খালের কাছে যে নতুন গার্ডেন সিটি সেখানে। প্রায়ই যান। সেখানে তো ভালো হাসপাতাল। যাইহোক আমি নাম ঠিকানা লিখে নেই, এখনই স্যার কে জানাচ্ছি।
মইনুল সাহেব মেয়েটার ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। বকশিশ ঘুষ কিছু চায়নি সেটাই তো বিরাট ভালো ব্যবহার, তাছাড়া এরকম সুন্দর করে কথা বলারও তো এদের দরকার নাই। আর ভুল তো কিছু বলেনি, তাকে দেখে তো আসলেই বোঝা যাচ্ছে না যে তার শরীর এতো খারাপ। হয়তো আরেকটু বেশি কাশির শব্দ করা দরকার ছিল। নার্স তার চ্যাপ্টা কম্পিউটারে নাম-ঠিকানা, কি অসুখ সব লিখে নিল। তবে এইবার আর বেশিক্ষন বসতে হল না, কোন একটা মাইকে তার নাম ধরে ডেকে পাঠাল।
সাজেদা খাতুন অনেক কষ্টে তার মুখ বন্ধ রাখছেন, অপরিচিত জায়গায় মুখ খোলা ঠিক হবে কিনা কে জানে। আগের সময়ের নিয়ম কানুন তো এখন আর নাই। দুইজন একসাথে রুম নাম্বার দেখতে দেখতে আগালেন, আশার সাথে দেখলেন যে সেই নার্স তাদের কে ঠিক রুমে নিয়ে যাওয়ার জন্য নিজেই এসেছে। একে তো মনে হচ্ছে বকশিশ দিতেই হবে।
ডাক্তার কালোমতোন খাটো গম্ভীর চেহারা কিন্তু বয়েস খুবই কম, বড়োজোর পঁয়ত্রিশ। দেখে যেন ভালো করে বোঝা যায় যে ডাক্তার সেই জন্য গলায় স্টেথোস্কোপ পরে আছেন। সাজেদা খাতুন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, এই ডাক্তার দেখাতে নাজানি কত খরচ হতে যাচ্ছে, টেস্টও তো দিবে কত হাজার টাকার, অথচ এই বাচ্চা ছেলে ডাক্তার, এই বাচ্চা মেয়ে হল নার্স।
ডাক্তার হাসার চেষ্টা করলেন কিন্তু হাসিটা তার গাম্ভীর্য কমাতে পারল না, আপনি মইনুল সরকার, কাঞ্চন থেকে আসছেন? শরীর কেমন বলেন দেখি?
মইনুল সাহেব তার কতদিনের কাশি, সকলে বুকে ব্যাথা ইত্যাদি বুঝায়ে বলতে চাইলেন, এক টানা কথা বলে গেলেন। কিন্তু যতই বলেন ততই ডাক্তারের ভ্রূ আরও কুঞ্চিত হয়। ডাক্তার তার স্টেথোস্কোপ দিয়ে বুক পিঠ ভালো করে দেখলেন। সব কথা শুনলেন। তারপর বললেন রুম নাম্বার ১২৬ এ নিয়ে যেতে। এমন ভাব করলেন যে কোনো কথার কোন জবাব দেওয়ার দরকার নাই।
নার্সের সাথে রুম নাম্বার ১২৬ এ যাওয়ার পথে সাজেদা খাতুন আর থাকতে পারলেন না, এই মেয়ে অনেক টাকা বিল উঠানোর আগেই তাকে থামানো দরকার। ঝকঝকে তকতকে হাসপাতাল, এতো মানুষ চারদিকে, এতো আধুনিক সব এ মেশিন যার কিছু তিনি চেনেন না কিন্তু যে আশায় সকালে চোখের পানি ফেলেছেন সে সবের কিছুই মিলছে না। নার্সকে থামিয়ে বললেন, আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছ একটু বল। আমরা তো শুধু ডাক্তার দেখতে আসছি। টেস্ট করতে হলে আলাদা করে প্রিপারেশন করে আসতে হবে। কত না টাকা লাগবে সেটা তো সাথে নাই।
নার্স এমন ভাবে হাসলো যেন ছোট বাচ্চা না বুঝে কথা বলতেছে, আর সে নিজে বিরাট বুঝমান। আপনারা কোন চিন্তা করবেন না, এখানে কোন বিল নিবে না, আপনারা রুম চিনবেন না দেখে আমি সাথে আসছি। ডাক্তার সাহেব আমাকে বলেছে যে আপনারা নতুন দেশে কখনো হাসপাতালে যাননি। আমার সাথে আসুন, আমি দেখাচ্ছি।
মইনুল সাহেব কিছুই বুঝলেন না, কিন্তু তর্কাতর্কি করাটা ভালো দেখায় না। রুম নামার ১২৬ এ দেখা গেলো কতগুলো মেশিন, কম্পিউটার আর যন্ত্রপাতি। ঘরে এসির কারণে কঠিন ঠান্ডা। সেখানে মইনুল সাহেব কে একটা কাচের ছোট ঘরের মধ্যে একটা চেয়ার এ বসায়ে নাকে ক্লিপ দিয়ে নাক বন্ধ করে দেওয়া হল, আর মুখে একটা নল দিল। আরেকটা নার্স একটা কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে মইনুল সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললো, মইনুল চাচা, আপনি নলে ফু দেন, যতক্ষণ না বলবো ফু দিতে থাকেন।
সাজেদা খাতুন হতভম্ব হয়ে দেখলেন এই মেয়েগুলো তার মুরব্বি স্বামীর সাথে ভিডিও গেম খেলা শুরু করছে, কি আশ্চর্য!! নলে ফু দিলে কম্পিউটার এর স্ক্রিন এর মধ্যে একটা রঙিন বেলুন ভেসে উঠে, নার্স মেয়েটা তখন তালি দিয়ে বলে যে আরও ফু দিতে থাকেন, আরও ফু দেন। একবার নিশ্বাস ছাড়তে বলে একবার নিতে বলে। সেই কম্পিউটারে রং পুরাপুরি উঠে না দেখে আবার ফু দিতে বলে। কিছুক্ষন পর কাচের ঘরের দরজা লাগায়ে দিয়ে ফু দিতে বলে, আবার দরজা খুলে ফু দিতে বলে। কোথায় রক্ত নিবে, বিছানায় শুতে দিবে, তানা এরকম একটা ছেলে মানুষি ধরণের কাজ যে হাসপাতালে হতে পারে সেটাই বিশ্বাস যোগ্য না। সাজেদা খাতুনের একবার মনে হল যে একটা ধমক দিয়ে এইসব থামান, কিন্তু এতো টাকার জিনিস, এতো লোকজন, এতো আয়োজন দেখে কি বলবেন কিছু বুঝে উঠতে পারলেন না।
বড়জোর ১০ মিনিটের মধ্যে এই নাটক শেষ হল, তারপর দুইজন নার্স বিশাল বড় করে হেসে বললো, আপনারা ওয়েটিং রুমে একটু বসেন। স্যার কিছুক্ষনের মধ্যেই ডাকবেন।
মোটামুটি হতভম্ব অবস্থায় দুইজন একটা ওয়েটিং রুমে বসলেন। বসে অবশ্য একটু অপরাধবোধ বোধ করতে লাগলেন। তাদের আসে-পাশে যে ৬ জন রোগী বসে আছে তাদের শারীরিক অবস্থা যে খারাপ সেটা বেশ প্রকট। সবার নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে, একজন একটা ছোট সিলিন্ডার ধরে আছে, সেটার সাথে যে নল সেটা দিয়ে একটু পর পর নিশ্বাস নিচ্ছে। সেই তুলনায় তার নিজের শরীর বেশ ভালো। তার অবস্থা বেশি ইমার্জেন্সি না দেখে আগে ডাকেনি সেটা এখন বোঝা যাচ্ছে।
প্রায় আধাঘণ্টা বসে থাকার পর মইনুল সাহেবের ডাক পড়ল। এইবার অন্য একজন ডাক্তার, এনার চেহারা গম্ভীর না, তবে বয়েসে আরও কম মনে হচ্ছে। ডাক্তার উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন, আমার নাম ডাক্তার আরিফ, আমাকে ইমার্জেন্সি বিভাগ থেকে বলা হল যে আপনার নাকি ফুসফুসে সমস্যা?
মানে, কাশির সমস্যা আরকি।
কিন্তু আমাদের টেস্টে কোনো সমস্যা ধরা পড়েনি। টেস্টের রেজাল্ট খুব ভালো। আমাদের নার্সদের পক্ষে যতটুকু সম্ভব সেই চেষ্টা করেছে, কোন সমস্যা মনে হচ্ছে না। আপনার সমস্যা একটু খুলে বলেন শুনি।
এই বাচ্চা একটা ছেলে যে এতো আত্মবিশ্বাসের সাথে বলবে যে কোন সমস্যা নাই, সেটা কি করে সম্ভব। হাসপাতালে গেলেই তো সমস্যা ধরা পরে। ডাক্তাররা বানিয়ে বানিয়ে রোগ বলতে না পারলে টাকা টাকা ইনকাম করবে কি করে! মইনুল সাহেব তার বিস্বয় গোপন করতে করতে তার গত তিন চার বছরের কাশির ঘটনা খুলে বললেন। চিকিৎসা করতে টাকা খরচ করতেও তার আপত্তি নাই সেটাও বলতে বাকি রাখলেন না। সব শুনে ডাক্তার আরিফ এমন হাসি দিলেন যেটা দেখে সাজেদা খাতুনের গা জ্বলে গেল।
ডাক্তার সাহেবের লেকচার দেওয়ার মতো করে বলা শুরু করলেন, আপনারা দীর্ঘিদিন রিটায়ারমেন্ট এ আছেন তো সে জন্য জানেন না যে আমাদের দেশে কিন্তু চিকিৎসা ব্যবস্থা বদলে গেছে। এখন বেশিরভাগ চিকিৎসা করতে রোগীর কাছ থেকে কোন টাকা নেওয়া হয় না। সব হাসপাতাল, ডাক্তার, নার্স সবাই সরকারের থেকে টাকা পায়। যেহেতু আপনাদের বয়েস অনেক হয়েছে, আপনারা প্রতি ছয় মাস পরপর একবার সব পরীক্ষা বিনা মূল্যে করতে পারবেন। আপনারা তো আর প্লাষ্টিক সার্জারি করতে আসেননি, আপনাদের কাছ থেকে টাকা নিবে কেন? আপনাদের এলাকার যে হাসপাতাল সেখানেও এই চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। আপনাদের প্রথম সেখানেই ডাক্তার দেখানো উচিত। আমি কাঞ্চনের হাসপাতালে ইমেইল করে দিচ্ছি, সেখানে একটা নেবুলাইজার আছে সেটা আপনাকে ধার দিবে। সেটা দিনে তিন-চার বার ৭ দিন ব্যবহার করবেন, তারপর হাসপাতালে আবার ফেরত দিয়ে দিবেন। যদি উপকার না হয় তাহলে কাঞ্চনেই আপনার পরবর্তী চিকিৎসার কথা বলবে।
কথা শুনে সাজেদা খাতুন হা হয়ে গেলেন। কষ্ট করে মনে করার চেষ্টা করলেন ভুল করে কোন দাতব্য হাসপাতালে ঢুকে পড়েছেন নাকি? কিন্তু এতো বিশাল বিল্ডিং, এমন আধুনিক যন্ত্রপাতি এইসব বিনা মূল্যে, এইটা কি করে সম্ভব?
ডাক্তার মনে হল তার মনের কথা বুঝতে পারলেন, বললেন, জনগণ তো ট্যাক্স দেয়, সেই ট্যাক্স এর টাকা থেকেই সব সরকারি হাসপাতাল চলে। সব বেসরকারি হাসপাতাল নতুন বাংলাদেশে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আগে বেসরকারি হাসপাতালের ব্যাবসার সুবিধার্তে সরকারি হাসপাতাল অনুন্নত করে রাখা হত। এখন সরকারি হাসপাতালই উন্নত। যে যত বড়োলোক-ই হোক না কেন সরকারি হাসপাতালেই আসতে হবে। বিপদে পরে যে রোগী আসে তার সাথে তো ব্যবসা করলে তো তাদের কে ইচ্ছা মতো ঠকাতে পারবে, তাই না? উন্নত বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে জীবনের প্রতি হুমকিস্বরূপ রোগের চিকিৎসার জন্য কোন বেসরকারি হাসপাতাল নাই। আমাদের ডাক্তাররা খুবই ভালো, আপনারা ভরসা রাখেন। আমি একটা সমাজ কর্মীর সাথেও যোগাযোগ করায়ে দিচ্ছি। এখন আপনার এমন কোন সমস্যা নাই যে জন্য ইমার্জেন্সি বিভাগে আসতে হবে। আমি একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি, সামনে রিসেপশন থেকে চিঠি নিয়ে যান, যদি কাঞ্চনে আপনার নেবুলাইজার দিতে দেরি করে তাহলে তাদের দিবেন। বলে ডাক্তার উঠে দাঁড়ালেন, পরিষ্কার যে এখন উনি চাচ্ছেন যে মইনুল সাহেব ঘর ছেড়ে যান।
ডাক্তারের সব কথা ঠিক মতো না বুঝলেও মইনুল সাহেব তার স্ত্রীকে নিয়ে বের হয়ে আসলেন, মনে মনে ভাবলেন যে আজকেই তার ছেলের সাথে বিস্তারিত কথা বলবেন। দেশের খবর বলতে শোনেন রাজনীতির খবর, সেখানেও মারামারি হরতাল আন্দোলন অনেকদিন শোনেননি। খবর এতই বোরিং যে কেউ এতো নিয়মিত দেখে না। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার কি হইছে সেটা ছেলের কাছে জিজ্ঞেস করতে হবে। বের হয়ে রিসেপশনে এসেই দেখেন সেই নার্স, দেখে মনে হচ্ছে এর মধ্যেই আবারো রূপ চর্চা করেছে। মইনুল সাহেব কে দেখেই খুকিদের মতো উচ্ছসিত হয়ে বলল, চাচা আপনাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম, আমার সাথে আসুন। আর এই যে ডাক্তার সাহেব কাঞ্চনের হাসপাতালের জন্য চিঠি দিয়েছেন, আমি প্রিন্ট করে এনেছি। স্যার আমাকে বললেন যে আপনারা হাসপাতালে অনেকদিন পর আসছেন। আমার সাথে আসুন কি করতে হবে দেখিয়ে দিচ্ছি। বলতে বলতে একটা সাদা খাম হাতে দিল।
সাজেদা খাতুন দেখলেন যে বকশিশ না নিয়ে এই মেয়ে ছাড়বে না। তবে সেটা নিয়ে চিন্তার কিছু নাই, যদি হাসপাতালে টাকা দিতে না হয় তাহলে বকশিশ দেওয়ার মতো টাকা তাদের সাথে আছে। কিন্তু আতঙ্কের সাথে ওনারা খেয়াল করলেন যে মেয়েটা তাদের কে সাথে নিয়ে একটা জায়গায় আসল সেখানে উপরে লেখা আছে ক্যাশ, কি মুশকিল, টাকা না নেবে না বলল! আর সামলাতে না পেরে বললেন, কিন্তু ডাক্তার সাহেব যে বললেন যে কোন বিল দিতে হবে না, তুমি আমাদের এখানে আবার বিল দেওয়ার জন্য নিয়ে আসলে কেন?
নার্স আবারও সেই গা জ্বলুনি হাসি দিয়ে, এমন ভাবে কথা বলা শুরু করলো যেন ২ বছরের বাচ্চাকে বুঝ দিচ্ছে, আপনাদের কাছ থেকে কোন বিল নেওয়ার জন্য আনিনি। এইটা হচ্ছে ক্যাশ। আপনারা মুরব্বি মানুষ ঢাকার বাহিরে থেকে আসছেন, আসতে নিশ্চই খরচ হয়েছে। সেই আসার খরচটা আপনাদের দিয়ে দিবে। আপনারা কীসে এসেছেন, ট্রেনে? ট্রেনের টিকেটের রিসিট সাথে আছে?
অবিশ্বাস্য চোখে ওনারা দেখলেন যে নার্স তাদের জন্য টিকেটের টাকা ফেরত নিয়ে দিল। ক্যাশ বিভাগের জানলা দিয়ে তাদের হাতে টাকা দিয়ে দিলো, কিন্তু চিকিৎসা বা অন্য কোন বাবদ কোন টাকা নিল না। নার্স বুঝায়ে বলার চেষ্টা করল, আপনাদের কাছে একজন সমাজ কর্মী আসবে। আপনাদের দুইজনেরই যেন ৬ মাসে একবার ডাক্তার দিয়ে চেকাপ হয় সেটা দেখবে। এইরকম নিয়ম কানুন নতুন কিছু না, বেসরকারি হাসপাতাল হওয়ার আগেও বাংলাদেশে এইভাবেই চিকিৎসা হত। উন্নত বিশ্বের সব দেশেই এইভাবেই চিকিৎসা হয়, অথবা ইন্সুরেন্স থাকে। আপনারা কোন চিন্তা করবেন না। তারপর মইনুল সাহেবদের কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মেয়েটা চলে গেল, কোন বকশিশ ও নিল না।
ট্রেনের ভাড়ার টাকাটা খুব বেশি না, তারপরও টাকাটা হাতে নিয়ে মইনুল সাহেবের চোখে পানি চলে আসলো। তার বাবার আমলে একসময় ছিল যখন গ্রাম থেকে রোগী ঢাকায় আনতে গরুর গাড়িতে করে ঠেলা ঠেলি করতে করতে রোগী গরুর গাড়িতে মারা যেত। এখন ঢাকায় আসতে সময় লাগলো কতক্ষন মনে করতে পারলেন না, সেই আসা-যাওয়ার খরচও দিয়ে দিল। খুব সিরিয়াস রোগী না হয়েও হাসপাতালের এরকম সময় নষ্ট, টাকা নষ্ট করার জন্য মইনুল সাহেব মনে মনে অপরাধবোধ অনুভব করতে লাগলেন।
স্ত্রীকে নিয়ে বাহিরে এসে দেখলেন মোটে সাড়ে দশটা বাজে। চারদিকে ঝকঝকে রোদ। স্ত্রীর দিকে তাকালেন, এখন কি করতে চাও?
তার স্ত্রীর মুখে ততক্ষণে হাসি ফেরত এসে গেছে, সাহসও বেড়ে গেছে, চলো কোথাও খেতে যাই।
এখন তো মোটে সাড়ে দশটা, এখনও তো দুপুরের খাবারের সময় হয়নি। এখন আবার কীসের রেস্টুরেন্ট। কোথায় বা যাব, অচেনা জায়গা।
এতো তাড়াহুড়া করছো কেন। আসো একটু ঘুরে দেখি, দেশ তো অনেক বদলায়ে গেছে। আসো ঐ যে একটা পার্ক, সেখানে বেঞ্চে বসি। পার্কে বসি না কত বছর।
সামনেই একটা ছোটদের খেলার পার্ক। পাশেই উঁচু বিল্ডিং কিন্তু খেলার পার্কটা ছিমছাম, সব বিল্ডিং এর ছায়ায় একজোড়া রঙিন দোলনা , একটা স্লাইড, অনেক বালু একসাথে জড়ো করা। পার্কটা চার দিক দিয়ে সবুজ লোহার বেড়া দিয়ে ঘেরা। মইনুল সাহেবের মনে হল আসলেই দেশ অচেনা লাগছে। ওনারা একটা বেঞ্চে বসলেন। কিছুক্ষন পরই দেখলেন ১০ জনের ছোট বাচ্চাদের দল আর তাদের সাথে দুইজন মহিলা, সম্ভবত তাদের টিচার তাদের নিয়ে পার্কে চলে আসলো। বাচ্চারা আসলো নাচতে নাচতে কিন্তু এক সারিতে, আর সেই সারির সামনে পিছনে দুইজন টিচার। সব বাচ্চাদের গায়ে হলুদ রঙের আলাদা ভেস্ট, যেন রাস্তা থেকে উজ্জ্বল করে দেখা যায়। নিশ্চই কোন স্কুল থেকে আসছে। মইনুল সাহেব ঠিক করলেন দুপুরের খাবারের সময় হওয়ার আগে পর্যন্ত এখানেই বসবেন। দেখতে দেখতে ঘন্টা খানেক পার হয়ে গেল। বাচ্চারা খেলছে দেখতে দেখতে এরকম একটা আরাম দায়ক বাতাসে বসে থাকতে তাদের ভালোই লাগছিলো, কিন্তু এর মধ্যেই বিপদ দেখা দিলো।
একটা স্যুট-প্যান্ট পড়া ভদ্র চেহারার একটা মাঝ বয়েসী লোক উদয় হল। তার ঢেউ খেলানো চুল, বিদেশিদের মত চামড়া। এসেই ধমকে চিৎকার করে বলল, এই - আপনারা কি করছেন এখানে? আপনারা কারা? অনেক্ষন থেকে আমি দেখছি যে আপনারা বাচ্চাদের দিকে তাকায়ে আছেন। এইটা তো খুবই সন্দেহজনক। আপনাদের তো আগে দেখিনি। কথার জবাব দিচ্ছেন না কেন? এখানে বসে আছেন কেন বলতে না পারলে কিন্তু আজকে খবর আছে।
সাজেদা খাতুন হতবম্ভ হয়ে গেলেন। বেঞ্চে বসে আছেন, পার্কে বাচ্চারা খেলছে, তো বাচ্চাদের দিকে তাকাবেন না! এর মানে কি! ধমক দিয়ে বললেন আপনি কে? আপনি আমাদের জিজ্ঞেস করার কে?
কিন্তু লোকটা বাঁধা দিল, হ্যা, আপনি জানেন আমি কে? এইযে এতো বড় ২৬ তলা বিল্ডিং দেখছেন আমি তার মালিক, আমি এখনই পুলিশে ফোন দিচ্ছি।
মইনুল সাহেব দেখলেন না জানি কি হতে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি স্ত্রীকে থামিয়ে পার্ক থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করলেন, আচ্ছা আপনার পার্ক নাকি? আমরা তো জানতাম না। ঠিক আছে আমরা চলে যাচ্ছি।
এতো তাড়াতাড়ি তো আপনাদের যেতে দিবো না। বলেই হাত নেড়ে কাউকে ডাকলেন, বললেন যেন পার্ক এর গেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। সত্যি সত্যি ফোন বের করে পুলিশে ফোন দিলেন। দেখতে দেখতে বেশ কয়েকজন এসে পার্ক এর গেট বন্ধ করে দিল, মইনুল সাহেবের কোন কথাই শুনলো না।
মইনুল সাহেবের সব চুল পাকা, কিন্তু তার এমন পরিস্থিতির মধ্যে পরতে হয়নি। তার জীবনে এরকম কোটিপতির সাথে দেখাই হয়নি। এই কোটিপতি তো নিশ্চই জেলে পাঠায়ে ছাড়বে, পা ধরলেও নিশ্চই ছাড়বে না। সাজেদা খাতুন এবার সত্যি সত্যি চোখের পানি ফেলতে শুরু করলেন। পার্ক থেকে বাচ্চারা উঁকি দিয়ে দেখলো যে সত্যি সত্যি পুলিশ চলে এসেছে।
একটা গাড়িতে চার জন পুলিশ এসে নামল, এদের মধ্যে দুইজন মহিলা পুলিশ। এসেই সেই কোটিপতি উদ্ধত লোকটার সাথে কথা বলা শুরু করল। লোকটাকে কোটিপতি বলাটা হয়তো ঠিক হচ্ছে না, এরা হলো হাজার কোটিপতি, বিলিয়নেয়ার। পুলিশকে সে শুরুতেই সেটা বলে নিল, আমি ড. কামাল, এই মাল্টি কমপ্লেক্সের মালিক। আমার দুলাভাই হচ্ছেন দেশের সবচেয়ে বড় গামছার ফ্যাক্টরির মালিক। আমি আগে ইউকেতে ছিলাম, গত সপ্তাহে এসেছি। এখন ঐযে অফিস দেখা যাচ্ছে ওখানে বসি।
পুলিশের তেমন কোন ভাবান্তর হল না, শুধু জিজ্ঞেস করল, ঘটনা কী? মইনুল সাহেব ঘটনা বলতে চাইলেন, কিন্তু অপমানে গলার কাছে কিছু বেঁধে আছে, কোন কথা বলতে পারলেন না।
কোটিপতি ড. কামাল হড়বড় করে অনেক কথা বলে পুলিশ কে বুঝানো শুরু করল, পুলিশ ও মন দিয়ে কথা শুনতে থাকল। একজন পুলিশ পার্কে যে বাচ্চাদের টিচার তার সাথেও কথা বলে আসলো। একসময় বলল, অনেক শুনেছি, আপনি থামেন। আমি প্রশ্ন করছি আপনি উত্তর দেন। তারপরে মইনুল সাহেবের দিকে দেখায়ে জিজ্ঞেস করলেন, ওনারা কি আপনার সাথে কথা বলতে গেছে? পার্কে কারোর সাথে কথা বলতে গেছে? কি সন্দেহজনক কাজ করেছেন ওনারা? ড্রাগস্ নিয়েছেন? এই বয়েসের মানুষ কি ড্রাগস নেয়?
কামাল বলল, না, তবে সন্দেহজনকভাবে বসে ছিল। আমার কাছে সন্দেহজনক মনে হয়েছে। বাচ্চাদের পার্কে এরকম লোকজন বসবে কেন? আপনারা কি করেন? ওদের আগে অ্যারেস্ট করবেন জেলে ঢুকাবেন, তা না করে আমাকে প্রশ্ন করছেন। জানেন আমি কে?
পুলিশ তার বুকে লাগানো ক্যামেরা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বললো, আপনি কী কী বলছেন সেটা আমার শরীরে লাগানো ক্যামেরাতে রেকর্ড হয়েছে। দেশের প্রতিটা পুলিশের শরীরে ক্যামেরা-মাইক্রোফোন লাগানো। সব রেকর্ড থাকে। আপনি কে সেটাই এতক্ষন শুনতেছি। এখানকার পরিস্থিতি কি সেটা ক্যামেরা-মাইক্রোফোন দিয়ে রেকর্ড করেই আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। তাছাড়া পার্কের ক্যামেরাতেও দেখা যাবে। চাইলে সেটা আদালতে চ্যালেঞ্জ করবেন। আপনি যদি প্রধান মন্ত্রীও হন আমরা আপনাকে আর্রেস্ট করতে পারি, আপনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারি। আপনি আমাদের সাথে আসেন, থানায় আসেন। আপনি কি কারণে নিরীহ সাধারণ জনগণ কে হুমকি ধামকি দিবেন সেটা পরিষ্কার করা দরকার। আপনার উকিল আছে না? তাকে খবর দেন যে আপনার বিরুদ্ধে ভীতি প্রদর্শন আর জনশৃঙ্খলার ব্যাঘাত সৃষ্টির অভিযোগে থানায় নেওয়া হয়েছে। পুলিশের কথা শেষ হতে হতেই একজন এসে সাবধানে ড. কামালের হাতে হাতকড়া পরাতে শুরু করল। কামালের চোখ তখন যাকে বলে চরক গাছ।
পুলিশের কথা শুনে ততক্ষণ স্বামী-স্ত্রীর চোয়াল ঝুলে পড়েছে। পুলিশ তাদের পক্ষ নিবে এটা তারা ঘুনাক্ষরেও চিন্তা করেননি। সাজেদা খাতুন হাতজোর করে পুলিশ কে ধন্যবাদ দিতে গেলেন, তার চোখ দিয়ে পানি পরছে, অনেক ধন্যবাদ স্যার, কেমন করে যে এই বিপদে পড়লাম সেটাই বুঝতে পারছি না। আপনাদেরকে দেখে যা ভয় পেয়েছিলাম। মইনুল সাহেব আর তার স্ত্রী দুইজনেই হাতজোড় করে ছিলেন।
কোনো ধন্যবাদ দিতে হবে না। আমরা পুলিশের চাকরি নিয়েছি কি কারোর চামচামি করার জন্য? আইনের বলে এমন কোন ক্ষমতা আমাদের দেওয়া হয়নি যে আমরা সেটা নিরপরাধ মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করব। আপনারা কোন অপরাধ করেননি তো ভয় পাবেন কেন? আপনারা যতক্ষণ ইচ্ছা পার্কে বসতে পারেন, এইটা সরকারি পার্ক, আপনাদের জন্যই করা। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে আমাদের ফোন দিবেন, পুলিশের নাম্বার সাথে আছে না?
সেই কোটিপতিকে গাড়িতে তুলে পুলিশ চলে যাওয়ার পর তাদের ঘোর কাটলেই পার্ক ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। মইনুল সাহেব কি বলবেন বুঝতে পারলেন না, কোন কিছু চিন্তা না করেই বললেন, চলতো একটা রেস্টুরেন্টে বসে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করা দরকার। তাছাড়া পানি পিপাসা পেয়েছে।
দুইজন মিলে মোবাইল ফোন ঘাটতে শুরু করলেন যে এলাকার মধ্যে সব চেয়ে সস্তা রেস্টুরেন্ট কোনটা হতে পারে। দেখা গেল অল্প হাঁটার দূরত্বেই নগর ভবনের পাশে একটা গলির ভিতর রেস্টুরেন্ট আছে যেখানে খুব সস্তায় খাবারের কথা লেখা আছে। সামনে যেয়ে অবশ্য স্বামী-স্ত্রীর মন ভালো হয়ে গেল, পরিষ্কার পরিছন্ন বিশাল একটা রেস্টুরেন্ট, সুন্দর কাঠের চেয়ার-টেবিল। অনেক মানুষের বসার ব্যবস্থা। আরাম করে কিছুক্ষন বসা যায়, তবে টেনশনও লাগে, না জানি দেশের রেস্টুরেন্ট গুলোতে কি পরিবর্তন এসেছে।
প্রথম পরিবর্তন দেখা গেল যে কোন ওয়েটার নাই, একটা কম্পিউটার এর স্ক্রিন এর মধ্যে টেপাটিপি করে খাবার এর অর্ডার দিতে হবে। খাবার দেওয়ারও কেউ নাই, একটা জানলার মতো জায়গা সেখান থেকে খাবার বের হয়ে আসবে। ভিতরে কোথাও নিশ্চই রান্নাঘর আছে। আজকের দিনের জন্য সেটাই ভালো। আজকে একের পর এক যা হচ্ছে, মানুষের সাথে কথা বলতেই ভয় লাগছে। এমনিতে রেস্তোরাতে অনেক মানুষ, সবাই খেতে ব্যাস্ত। এইটা ঠিক উৎসবের জায়গা মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে আসে পাশের সব অফিস থেকে সবাই দুপুরের খাবার খেতে এসেছে। দুইজনে টেপাটিপি করে সবচাইতে সস্তা দেখে খাবার নিলেন। পাবদা মাছ আর ভাত। ইদানিং পাবদা মাছ সস্তা যাচ্ছে, বাসাতেও কেনা হয় প্রায়ই। ১০ মিনিট এর মধ্যেই জানলা দিয়ে খাবার ট্রে তে করে বের হয়ে আসলো। দুইজন দুইটা ট্রে তে খাবার নিয়ে এক কোনায় বসলেন।
তখন একজন মাঝবয়েসী লোক রেস্টুরেন্টে ঢুকলো। মুখভর্তি হাসি, কেমন ফুর্তিবাজ। কালো মতো চেহারা ঘামে ঢেকে গেছে, পরনে খাটো পাঞ্জাবি, চোখে গোল্ডফ্রেমের সানগ্লাস। এসেই আশেপাশে সবার দিকে তাকিয়ে হাসি দিলো, তারপর সানগ্লাস চুলের ওপর তুলে রেখে খাবার অর্ডার করার কম্পিউটারের দিকে এগিয়ে গেল। দেখে মনে হচ্ছে বিশেষ কেউ, কিন্তু বিশেষ কেউ তো এই রেস্টুরেন্টে আসার কথা না। মইনুল সাহেব নিজের অজান্তেই লোকটার ব্যাপারে আগ্রহ বোধ করলেন।
লোকটা খাবার নিয়ে অন্য কোথাও জায়গা না পেয়ে ঠিক পাশের টেবিলেই বসলো। ইনিও পাবদা মাছ দিয়েই ভাত খাচ্ছেন। মইনুল সাহেব নিতান্তই ভদ্রতার খাতিরে তার দিকে তাকিয়ে হাসলেন, কথা বললেন। দেখা গেল ছেলেটাও ভদ্র এবং সদভাষী। কেমন গরম পড়েছে, খাবার খেতে কত ভালো হয়েছে ইত্যাদি নিয়ে দুয়েকটা কথা বলতে বলতেই তাদের খাওয়া শেষ হয়ে গেল। এক সাথেই হাত ধুয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হতে গেলেন।
ঠিক এই সময়েই তিনজন মানুষ রেস্তোরাতে ঢুকে পড়ল, তাদের হাতে বড় ক্যামেরা, মাইক্রোফোন। এসেই আসে পাশে কাউকে খুঁজতে শুরু করল। মুখে মেকআপ দেওয়া বোঝাই যাচ্ছে যে এরা সাংবাদিক, টিভির লোকজন।
মইনুল সাহেব আতংকিত হয়ে দেখলেন যে ক্যামেরা নিয়ে তারা ঠিক তার স্ত্রীর দিকেই এগিয়ে আসছে, কিন্তু না, তারা ঠিক পাশের টেবিলে ব্রেক করল। হটাৎ করে পাশের টেবিলে যে গোল্ড ফ্রেমের সানগ্লাস মাথায় নিয়ে যে খাবার খাচ্ছিলো তাকে তিন দিক থেকে ঘিরে ধরল। ক্ষুরের মত চেহারার একটা মহিলা সাংবাদিক মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে বললো, এইতো আমরা পেয়ে গেছি আমাদের ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র শরীফ ভাই কে। সকাল থেকে আমরা তাকে খুঁজছি কিন্তু পাইনি। আমরা খোঁজ নিয়েছি যে উনি দুপুরের খাবার খেতে এই রেস্তোরায় আসেন, এখানে পেয়ে গেছি, ওনাকে এখন আমরা প্রশ্ন করতে পারব।
সাংবাদিকদের ক্যামেরা মেয়র সাহেবের মুখের উপর ধরতে পাঁচ সেকেন্ড সময়েও লাগলো না। মুখের বিরক্তি চেপে একটা হাসি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলেন, আপনারা জানেন যে আমি ক্যামেরা খুবই পছন্দ করি, সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে কখনও এড়িয়ে যাই না। গত কয়েকদিন ধরে তো আপনাদের প্রশ্নের উত্তরই দিচ্ছি।
মহিলা সাংবাদিক আবারও তীব্র ভাবে বললেন, আসাদ গেটের পাশে যে কন্সট্রাকশনের কাজ চলতেছে সেটা আপনি বলেছিলেন যে গত পর্শুদিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু এখনও শেষ হয়নি। এই জন্য রাস্তার প্রায় অর্ধেক এলাকা বন্ধ। কাজ শেষ হলো না কেন? জনগণের সেটা জানার অধিকার আছে।
মেয়র যেকোন পরিস্থিতিতে হাসার এবং শান্ত থাকার প্রতিভা নিয়ে জন্মেছেন। তারপরও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে তার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কোন ইচ্ছা নাই। আচ্ছা, রাস্তার কাজের ব্যাপারটা নিয়ে আপনারা এতো অস্থির হচ্ছেন কেন? এই সামান্য রাস্তা বন্ধের কারণে কি কোন যানজট হয়েছে? বিকল্প রাস্তার ব্যবস্থা করেই সব আয়োজন করা হয়েছে, সারা শহরে কোথাও যানজট হবে না। আমি গতকালকেই ঐ এলাকায় আন্ডারগ্রাউন্ড রেল দিয়ে গিয়েছি, পুরাদমে কাজ চলছে। আমাদের সরকার আসার পর রাস্তা আগের তুলনায় ১১% বেশি টেকসই করার কাজ শুরু হয়েছে।
তাহলে আপনি বলছেন রাস্তার কাজ শেষ করার দরকার নাই, এইভাবেই চলতে থাকবে?
না, আমি কি তাই বললাম নাকি? কাজ শেষ হয়ে যাবে, আজকের মধ্যেই শেষ হবে। দেরির কারণ বের করার জন্য আমরা একটা কমিটি....
কমিটি কি করে সেটা আমাদের দেখা আছে। কমিটির হাতে তদন্ত দিচ্ছেন সময় নষ্ট করার জন্য, যাতে করে জনগণ ভুলে যায় কিসের তদন্ত ছিল, কিন্তু সেসব...
কী মুশকিল, আপনারা এত আক্রমণাত্মক কেন? কাজ করছে প্রাইভেট কোম্পানি, তার সাথে আমার বা সরকারের কোন সম্পর্ক নাই। তারা ইন্টারনেটের মাধ্যমে কম টাকায় কাজের বিড করছে কাজ পাইছে। আপনারা জানেন যে কম্পিউটারে সব কিছুর রেকর্ড থাকে, দুর্নীতি করার এখানে কোন সুযোগ নাই। রাস্তার নিচে বিদ্যুৎ লাইন নিয়ে নাকি কিছু সমস্যা। কেন বিদ্যুতের লাইন নিয়ে সমস্যা হল সেটা তদন্ত না করে তো দোষ দেওয়া যায় না। সময়ের মধ্যে কাজ শেষ না হলে কম্পিউটারে রাখা তথ্য থেকে তদন্ত হবে। দোষ বের হলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে, কেউ ঠেকাতে পারবে না।
তাহলে ঠিক সময়মতো কাজ হওয়ানোর দায়িত্ব কার?
যে কোম্পানি ঠিক সময় মতো কাজ শেষ করতে পারবে না তাদের আমরা কাজ দিব না। তারপরও আমরা তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করানোর চেষ্টা করতেছি যাতে জনগণের কোন দুর্ভোগ না হয়। আমাদের তো কাজ বুঝে নিতে হবে যে সঠিক ভাবে মজবুত কাজ ওরা করলো কিনা, তাই না? এই কোম্পানি না পারলে এদের টাকা না দিয়ে আমরা অন্য কোম্পানিকে কাজ দিবো। আপনারা কি করছেন দেখেন। যারা উচিত কাজ করে তাদের আপনারা কখনো দেখান না, শুধু খারাপটা দেখান। এতে করে খারাপ মানুষ বিখ্যাত হয়, বিখ্যাত হওয়ার জন্য আরও বেশি করে অনুচিত কাজ করে। আপনাদের ভালো কাজ দেখানো উচিত। এইযে এই বছর সরকার নদী পরিষ্কার করার বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে আর সে কারণে মাছের বাম্পার ফলন হয়েছে। সেটাও দেখান।
ঠিক আছে আমরা আবার আজ সন্ধ্যাতেই খোঁজ করবো যে রাস্তার কাজ শেষ হয়েছে কিনা।
সাংবাদিকরা চলে যেতেই মেয়র সানগ্লাস মাথা থেকে নামিয়ে চোখে পড়লেন। মইনুল সাহেব কোন বিশেষ কারণ ছাড়াই কিছুটা আতংকিত বোধ করছিলেন, তাড়াতাড়ি স্ত্রীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।
সাজেদা খাতুন আর কোন কথায় গেলেন না, দুইজনে ট্রেন স্টেশনে চলে আসলেন। একদিনে অনেক কিছু হইছে। এমন কি সারা জীবন যে পুলিশ এড়িয়ে চলেছেন সেই পুলিশের সাথেও দেখা হইছে। আর সময় নষ্ট করার মানে হয় না, বাসায় ফেরা দরকার।
চকচকে আধুনিক ট্রেন, কিন্তু অনেক যাত্রী। অনেক স্কুল কলেজের ছাত্র ছাত্রীরা ট্রেনে উঠছে। পড়ন্ত বেলায় হয়তো এখন স্কুল ছুটির সময়। সাজেদা খাতুনের পাশের সিটে যে দুইটা মেয়ে বসে আছে তাদের খেয়াল করলেন। এই ট্রেনের মধ্যেও একটা মেয়ের চোখে সানগ্লাস। অন্য মেয়েটার চেহারা কেমন ফর্সা, একটু বেশি ফর্সা, মনে হচ্ছে বিদেশী। সানগ্লাস পরা মেয়েটা একটা মুহূর্তের জন্যও অন্য মেয়েটার হাত ছেড়ে দিচ্ছে না। দুইজনের চেহারাতেই একটা চকচকে ভাব আছে। একসময় যখন দেশে মাছ-মাংস দামি মনে করা হত তখন মানুষ বলতো মাছ-মাংস খাওয়া ঘরের ছেলে মেয়ে। দাম বেড়ে গেলে বলতো দুধ-ডিম খাওয়া ঘর, পরে হয়তো বলতো ফল-ফ্রুটস খাওয়া ঘরের ছেলে-মেয়ে। এই স্কুলের বাচ্চাদের চেহারা এতো সুন্দর দেখে মনে হয় সবই একসাথে খেয়ে বড় হইছে। কিন্তু তারপরও মেয়েটার চেহারা একটু বেখাপ্পা। ঠিক কেন বেখাপ্পা সেটা বোঝা যাচ্ছে না কিন্তু বেখাপ্পা। মইনুল সাহেবকে সেদিকে ইঙ্গিত করে কানে কানে বললেন, আচ্ছা মেয়েটা কি বিদেশী?
কিন্তু কানে কানে বলাটা ঠিক ততটা নীরব হলো না। ট্রেনে তেমন শব্দ নাই, মেয়েটা কথা শুনে ফেললো। মইনুল সাহেব উত্তর দেওয়ার আগেই বললো, জি আমি বিদেশী।
শুনেই যখন ফেলছে আর-রাখ ঢাকের কোনো দরকার নাই, মইনুল সাহেবেরও কৌতূহল হল, জিজ্ঞেস করলেন, কোন দেশের তুমি?
আমার বাবা-মা ফিলিস্তিন থেকে এসেছেন। সেখানকার যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর এখানে দূতাবাসে কাজ করেন। আর আমি এখানে স্কুলে পড়ি।
কোন ক্লাসে পড়?
ক্লাস নাইনে পড়ি। আমরা দুইজনই একই ক্লাসে।
পাশে বসা মেয়েটা সম্পূর্ণ অন্য দিকে তাকিয়ে ভদ্রতার হাসি হেসে সালাম দিল।
তার কথা ট্রেনের পরের স্টেশন এর ঘোষণার মধ্যে চাপা পরে গেল। ঠিকমতো সালাম বিনিময় হলো না। স্টেশনের নাম শুনেই দুইজনেই উঠে দাঁড়াল। মেয়েটা সম্পূর্ণ অন্য দিকে তাকিয়ে বললো, এর পরের স্টেশনে আমরা নামবো।
এই পর্যায়ে সাজেদা খাতুন চমকে উঠলেন, উনি এই মাত্র খেয়াল করেছেন যে মেয়েটার হাতে একটা সাদা ছড়ি। মেয়েটা অন্ধ, সেজন্যই এক মুহূর্তের জন্যেও হাত ছাড়ছে না। সেজন্যই অন্য দিকে তাকিয়ে কথা বলছে, চোখে কালো চশমা পরে আছে। হাতে খোঁচা দিয়ে মইনুল সাহেবকে ইঙ্গিত করতেই উনিও চমকে উঠলেন, তুমি কি অন্ধ?
মেয়েটার মুখ নিভে গেল, দুইজনেই মাথা নেড়ে সম্মতি দিল যে মেয়েটা অন্ধ। সাজেদা খাতুন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, অন্ধ হলে স্কুলে যাও কী করে? পড়াশোনা কর কী করে?
মেয়েটা মুখ ভর্তি করে হেসে বললো, কেন পড়ব না? আমরা ব্রেইল ভাষায় লিখতে পড়তে পারি। কাগজে ফুটো করে লিখতে হয়, এরকম বই আছে। আপনারা জানেন না?
বলতে বলতে পরের স্টেশন চলে আসলো। ওরা আবার সালাম দিয়ে পরের স্টেশনে নেমে গেল। উত্তর দেওয়ার আর সুযোগ হল না। দুইজনেই আশ্চর্য হয়ে একে ওপরের দিকে তাকালেন। অন্ধ মানুষরাও পড়াশোনা করছে, আবার সেটাও তাদের নিজেদের দেশেই!
যখন তাদের নিজেদের স্টেশনও কাছে চলে এসেছে, তখন মোবাইলে একটা এসএমএস আসলো, যে একজন সমাজ কর্মী জানাচ্ছেন যে কাঞ্চন হাসপাতালে মইনুল সাহেবের জন্য যে নেবুলাইজার রাখা হয়েছে সেটা সে পরদিন সকালে বাসায় এসে দিয়ে যেতে চায়। দিন শেষে দুই মুরব্বি দম্পতি ট্রেনের জানলা দিয়ে আগ্রহ নিয়ে বাহিরে তাকালেন। যেদেশে সারাজীবন কাটিয়েছেন সেই দেশকেই কেমন বিদেশ মনে হচ্ছে।
ঠিক এরকম সময়ে টিভির শব্দে মাইনুল সাহেবের ঘুম ভেঙে গেল। রাতের স্বপ্নের কথা আর মনে থাকলো না। কেউ সকাল-সকাল টিভিতে রাজনৈতিক টকশো শুনছে, সেখানে কেউ বলছে, তরুণরা আন্দোলন করে দেশ স্বাধীন করেছে বলে কি তাদের দেশ ছেড়ে দিতে হবে নাকি, ক্ষমতায় আমরাই থাকবো…
লেখকের কথা: বেশিরভাগ উন্নত দেশ, যেমন ইউকে, জাপান, সিঙ্গাপুর, জার্মানি, ফ্রান্স, নিউজিল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড ইত্যাদি দেশে স্বাস্থসেবা বা চিকিৎসা ব্যবস্থা এইভাবেই হয়। যেমন ইউকে (ইংল্যান্ড) এর হাসপাতালে দূর থেকে রোগী আসলে তার আসার খরচ দিয়ে দেয়। এইসব দেশের পুলিশ অবশ্যই কেউ বড়লোক দেখেই তার পক্ষ নিবে না। তাদের শরীরে ক্যামেরা থাকবে, সব কাজ কম্পিউটারে হিসাব থাকবে। রাজনীতিবিদরা ক্ষমতা দেখায়ে কথা বলবে না, তারা দুর্নীতিগ্রস্থ না হলে দায়িত্ববান বিনয়ী মানুষের মতো কথা বলবে, কারণ তাদের জবাবদিহি করতে হয়। ক্ষমতা দেখায়ে কথা বলে দুর্নীতিগ্রস্থ মানুষেরা। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেই প্রতিবন্ধীরা ইউনিভার্সিটি তে পড়তে যায়, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রী ব্রেইলী টাইপ রাইটার নিয়ে ক্লাস করতে আসে এইটা গতশতাব্দীতেও সম্ভব ছিল।
২০ জুন, ফ্রাঙ্কফুর্ট।
পাঠকের মন্তব্য