একজন অপূর্বর গল্প 

২৭ পঠিত ... ৮ ঘন্টা ৩০ মিনিট আগে

লেখা: আসিফ বিন আলী

লেখাটি এনএসইউ’র ছাত্র অপূর্বকে নিয়ে। সাম্প্রতিক সময়ে সে কোরআন অবমাননার মতো একটি কাজ করেছে এবং ভিডিও করে নিজেই পোস্ট করেছে। বর্তমানে সে পুলিশ হেফাজতে আছে। তার এই কাজ সাম্প্রদায়িক সহিংসতার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, এবং তাকে বিনা বিচারে হত্যার জন্য প্রচারও চলছে। আমার লেখার উদ্দেশ্য কোনো পক্ষ নেওয়া নয়। আমি সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে অপূর্ব সম্পর্কে যা জানি, এবং সেই প্রেক্ষিতে কয়েকটি প্রশ্ন তুলতে চাই। প্রশ্নগুলোর উত্তর যদি আপনি জানেন তবে আমাকে জানাবেন।

অপূর্বর সঙ্গে আমার পরিচয় ২০২২ সালের, সমাজবিজ্ঞান ১০১ ক্লাসে। সমাজবিজ্ঞানের ক্লাসে অনেক বিষয় নিয়ে কথা হয়, যা হয়তো পাবলিক স্পেসে ‘ট্যাবু’ হিসেবে বিবেচিত হয়। অপূর্ব তখন ছিল অপূর্ব পাল—হিন্দু ধর্মাবলম্বী। ধর্ম নিয়ে নানা প্রশ্ন করত। শিক্ষক হিসেবে ক্লাসে যে ছাত্র প্রশ্ন করে, তাকে অনেকেই মনে রাখে। আমারও ওর কথা মনে ছিল। আমার মনে হয়েছিল ছেলেটির জানার আগ্রহ প্রবল, কিন্তু খুব আবেগপ্রবণ; যা বিশ্বাস করে তার বাইরে মতামত শুনতে আগ্রহী নয়।

যাই হোক, সেই সেমিস্টার শেষ হলো। ঠিক মনে নেই, ওকে কী গ্রেড দিয়েছিলাম। তবে রেজাল্ট প্রকাশের পর একদিন বন্ধুদের সঙ্গে আমার অফিসে এসে দেখা করল। বলল, ও সোশ্যাল সায়েন্স বা সাংবাদিকতা পড়তে চায়। এরপর আর খোঁজ নেওয়া হয়নি। প্রায় ছয় মাস পর দেখলাম, ও আমার আরেকটি কোর্সে ভর্তি হয়েছে—সেটি সাংবাদিকতা বিষয়ক। 

আমি খুব অবাক হলাম। ও তখন জোব্বা পরে এসেছে, মাথায় পাগড়ি, চোখে সুরমা, টাখনুর ওপরে কাপড়। কথার মধ্যে ‘আলহামদুলিল্লাহ’, ‘ইনশাআল্লাহ’ বলছে। আমি অবাক হলাম, কারণ জানতাম না ও কখন ইসলাম গ্রহণ করেছিল। ধর্ম পরিবর্তন তার ব্যক্তিগত অধিকার, তাই বিষয়টি নিয়ে আমি আলাদা করে আলোচনা করিনি বা প্রশ্ন করিনি। তবে লক্ষ্য করেছিলাম, ইসলাম নিয়ে ওর অবস্থান বেশ কঠোর, একরকম পিউরিটানিকাল। ক্লাসে ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন তুলত। কিন্তু যেহেতু সেই সাংবাদিকতা কোর্সে ধর্ম সংক্রান্ত কোনো বিষয় ছিল না, তাই এ নিয়ে আলোচনার তেমন সুযোগও ছিল না।

মিডটার্মের পরে দেখি অপূর্ব আর ক্লাসে আসে না। টানা কয়েকদিন অনুপস্থিত থাকায় আমি ওর বন্ধুদের জিজ্ঞেস করলাম, ও আসে না কেন। এক বন্ধু বলল, ‘স্যার, অপূর্ব এক মেয়ের প্রেমে পড়েছিল। মেয়েটি মুসলিম, এনএসইউ’র ছাত্রী। সে অপূর্বকে বলেছিল, ওর সঙ্গে প্রেম করতে হলে হিন্দু হিসেবে পারবে না—সমাজ মেনে নেবে না। তাই ধর্মান্তরিত হতে হবে।’

অপূর্ব ইসলাম গ্রহণ করে। কিন্তু কিছুদিন পর সেই মেয়েটি সম্পর্ক ভেঙে অন্য এক ছেলের সঙ্গে চলে যায়। ধর্ম পরিবর্তনের কারণে অপূর্বর পরিবারও তাকে ত্যাগ করে। বিষয়টি শুনে আমার খারাপ লাগল। একদিকে প্রেম হারানোর কষ্ট, অন্যদিকে ধর্মান্তরের কারণে পরিবার ও সমাজের প্রত্যাখ্যান—অপূর্বর জীবনে শুরু হলো বিচ্ছিন্নতার এক দুঃসহ অধ্যায়।

এরপর একদিন দেখি, ৮ নম্বর গেটে অপূর্ব গাঁজা খাচ্ছে—সঙ্গে সেই একই বন্ধু। কয়েকদিন পরে ও ক্লাসে ফিরে এলো। পোশাক আগের মতোই, কিন্তু আচরণে অসংলগ্নতা।

আমি ওকে অফিসে ডেকে বললাম, ‘তোমার অনেকগুলো ক্লাস মিস হয়েছে। এই অবস্থায় আমি তোমাকে পরীক্ষায় বসতে দিতে পারি না। তুমি একটা আবেদনপত্র লেখো।’ কিন্তু নিয়মের কথার বাইরে গিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কেমন আছ?’

ও খুব অসংলগ্নভাবে কথা বলছিল, হঠাৎ কাঁদতে শুরু করল। আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। মনে হলো, ওর বুকফাটা কান্নায় কষ্টে হারিয়ে যাওয়া এক তরুণের আর্তনাদ আছে। আমি চেষ্টা করলাম ওকে পরীক্ষায় বসানোর, যেমন সব ছাত্রের ক্ষেত্রেই করতাম। শেষ পর্যন্ত ও পরীক্ষা দিল, ফল খারাপ হলেও পাস করল।

এরপর আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক দায়িত্বে গেলাম। মাঝেমধ্যে ওর নামে অভিযোগ আসতে শুরু করল—যেমন, মসজিদে গিয়ে সবাইকে ‘ভুলভাবে ইসলাম পালন করছে’ বলে গণ্ডগোল করা, মানুষকে পর্দা করতে বলা, ক্লাসে শিক্ষকদের সঙ্গে অযথা তর্ক করা, বেআদব আচরণ করা।

একদিন ধর্ম নিয়ে মারামারির পর ও আমার রুমে এলো। খুব অস্থির, হাত-পা কাঁপছে, মুখ দিয়ে লালা পড়ছে, চিৎকার করছে। আমার অফিসের অফিসাররা সবাই আমার রুমের বাইরে ভিড় করল, ওরা ভয় পাচ্ছিল ও হয়তো আমাকে অ্যাটাক করবে। আমি ইশারায় সবাইকে চলে যেতে বললাম। একজন গার্ডও ইতোমধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে। ওকে চলে যেতে বললাম। গার্ড বলল, ‘স্যার, ও কিছু করলে?’ আমি বললাম, ‘ও আমার ছাত্র, আমি দেখছি।’

ওকে বসতে বললাম, টিস্যু দিলাম, পানি দিলাম। প্রায় ১৫ মিনিট ধরে কথা বলল—সব ধর্ম নিয়ে অভিযোগ, কেন মানুষ ঠিকভাবে ধর্ম পালন করে না। ধীরে ধীরে শান্ত হলে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে?’ ও বলল, ‘স্যার, আমি বুঝতে পারছি না, আমার কী হচ্ছে। মাজে মাঝে আমি কী করি আমার কিছু মনে থাকে না। আমার সাথে কেউ কথা বলে না। আমি কি ওদের খারাপ কিছু বলি। আপনি বলেন স্যার।’

এই বাক্যটাই যথেষ্ট ছিল ওর ভেতরের ভাঙন বোঝার জন্য। আমি ওর এক বন্ধুকে ফোন করে ডেকে আনলাম। সে আসতে চাইছিল না। আমি অনুরোধ করলাম। সে এসে ওকে নিয়ে গেল। এরপর থেকে ওর সঙ্গে আর দেখা হয়নি।

ততদিনে ওর গল্প বিশ্ববিদ্যালয়ের গসিপে ছড়িয়ে পড়েছে—পাগল, নেশাখোর, এইসব তকমা ওর নামের সঙ্গে জুড়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় শেষ পর্যন্ত ওকে বহিষ্কার করে।

একদিন বিকেলে অপূর্বর মা আমাকে ফোন করলেন। বয়স্ক একজন মানুষ, গলায় অপরাধবোধের কষ্ট। বললেন, স্যার, আমার ছেলে বিপথে গেছে। আমি জানি, ও দোষী। কিন্তু ও আমার একমাত্র ছেলে।

জানলাম, তিনি একটি সরকারি ব্যাংকে বড় পদে কাজ করেছেন। বললেন, অপূর্বর ছোটবেলায় ওর বাবা মারা যান। আমি একাই ওকে মানুষ করেছি। শ্বশুরবাড়ির কেউ পাশে দাঁড়ায়নি। মাসিরাই খোঁজ নিত। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত অফিসে থাকতে হত, ব্যাংকের চাকরি বলে কথা। সকাল আটটার সময় ছেলেকে তালা মেরে রেখে যেতাম স্যার, রাত নয়টায় ফিরে এসে দরজা খুলতাম। ও তখন একাই থাকত। আমার অপূর্ব শান্ত ছিল, কিন্তু একা থাকার কারণে পরে মানুষের সঙ্গে মিশতে পারত না। অনেক কষ্টে ওকে পড়াশোনা করিয়েছি। খুব ভয় পেত স্যার ও একা থাকতে। কী করব স্যার, ঐ চাকুরী না করলে ওকে মানুষ করব কেমন করে। এখন যদি বিশ্ববিদ্যালয় ওকে বের করে দেয়, ওর জীবন নষ্ট হয়ে যাবে।

তিনি আরও বললেন, স্যার, ও ধর্ম পরিবর্তন করেছে—এতে আমার কোনো ক্ষোভ নেই। কিন্তু সমাজ তো ওকে বুঝবে না, ও তো এখন আমাদের সমাজ ছাড়া স্যার। আমি কী করব বলেন?

আমি তাকে পরামর্শ দিলাম, অপূর্বর চিকিৎসার জন্য রিহ্যাবে পাঠাতে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ডিন স্যারের সঙ্গে কথা বলতে। শুনেছিলাম, ও রিহ্যাবে গিয়েছিল। বছরখানেক পরে বহিষ্কার উঠে গেলে ও ফিরে আসে, কিন্তু তখন আমি আমেরিকায় চলে এসেছি। আর খোঁজ রাখা হয়নি।

গতকাল অপূর্বর ভিডিও দেখলাম। শিউরে উঠেছি। ওর অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি, বরং আরও উদ্ভ্রান্ত হয়েছে। নিঃসন্দেহে ও ধর্ম অবমাননা করেছে, বহু ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে গভীরভাবে আঘাত দিয়েছে। ওর কাজের কোনো নৈতিক বা আইনি সাফাই নেই। দেশের পেনাল কোড অনুযায়ী ওর শাস্তি হবে, পাশাপাশি চিকিৎসাও প্রয়োজন।

কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই ঘটনার দায় কার?

ব্যক্তি অপূর্বর? নাকি সমাজের?

সেই হিন্দু সমাজের, যারা এক বিধবা মায়ের পাশে দাঁড়ায়নি?

সেই শ্বশুরবাড়ির, যারা অপূর্বর বাবার মৃত্যুর পর অপূর্বর বিধবা মায়ের কিংবা অপূর্বের কোনো খোঁজ নেয়নি?

সেই ব্যাংকের কর্মসংস্কৃতির, যেখানে ব্যাংকের চাকরিতে একজন মাকে সকাল ৮টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত আটকে রাখা হয়, কিন্তু শিশুর জন্য কোনো ডে-কেয়ারের ব্যবস্থা থাকে না?

সেই মুসলমান মেয়েটির, যে বলেছিল ধর্মান্তর না হলে প্রেম সম্ভব নয়, তার পরিবার মানবে না। শেষে অপূর্বকে ধর্মান্তরিত করে আর কথা রাখেনি। কিন্তু সমাজের চোখে বাহবা পেয়েছে একজনকে জান্নাতের রাস্তায় আনার জন্য।

নাকি দোষ সেই সমাজের, যেখানে ভিন্ন ধর্মের প্রেম এখনও গ্রহণযোগ্য নয়, তাই কাউকে না কাউকে নিজের বিশ্বাস ছাড়তে হয়?

নাকি দোষ সেই সেই ড্রাগ বিক্রেতাদের, যারা নর্থ সাউথ বা আইইউবির আশেপাশে ব্যবসা গড়ে তুলেছে, এবং অপূর্বর মতো তরুণদের ধ্বংস করছে?

নাকি দোষ সেই শিক্ষকদের, যারা ওকে ‘পাগল’, ‘অ্যাডিক্ট’ বলে গসিপ করেছে? মায়ার চোখে দেখেনি। ভয় পেয়েছে, এড়িয়ে গেছে?

নাকি দোষ এনএসইউ’র সেই ধর্মীয় সার্কেলগুলোর, যারা অপূর্বকে ধর্মান্তরিত করেছিল কিন্তু মানসিক বিপর্যয়ের সময় পাশে ছিল না?

নাকি দোষ সেই হিন্দু পরিবারের, যারা ধর্ম পরিবর্তনের কারণে নিজের আত্মীয়কে ত্যাগ করেছিল?

নাকি দোষ সেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের, যারা নিয়ম মেনে শাস্তি দিয়েছে কিন্তু চিকিৎসার জায়গা তৈরি করেনি?

অথবা দোষ সেই সহপাঠীদের, যারা ওর পাশে বসত না, ওকে ঘৃণা করত, পাগল বলত? উপহাস করত?

আমি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানি না। আপনি কি জানেন?

আজ যারা অপূর্বর বিনা বিচারে মৃত্যুর দাবিতে প্রচারণা চালাচ্ছেন, তারা হয়তো গভীরভাবে আহত হয়েছেন তাদের ধর্মীয় অনুভূতি থেকে। আর সেই কারণেই সর্বোচ্চ শাস্তি চাচ্ছেন।  কিন্তু ভেবে দেখেছেন, কোন পরিবেশে এমন এক অপূর্বর জন্ম হয়? কোন সমাজ এমন তরুণ তৈরি করে, যে একসময় নিজের ভেতরের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে?

আপনি একজন অপূর্বর জীবন শেষ করতে পারেন, কিন্তু এই সমাজ যে আরও শত শত অপূর্ব তৈরি করবে—তাদের কী করবেন?

আমাদের সমাজ এক নিষ্ঠুর সমাজ। এখানে আমরা সবাই কোনো না কোনোভাবে হিংস্রতার ভেতর বেঁচে আছি। এই হিংস্রতার স্বরূপ ভয়াবহ। ‘সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’-এর মতো, এখানে দুর্বলের পরাজয় আর সবলের জয়  নিত্যদিনের বাস্তবতা। এই সমাজে দুর্বলের কোনো স্থান নেই। সব কিছু চলে সবলের গায়ের জোরে। সমাজে এমন ঘুণ ধরে গেছে যে এখানে শুধু অপূর্বর জন্ম হয়, আর তার প্রতিপক্ষ—যে আবার অপূর্বর মতো মানুষকে মেরে ফেলতে চায়। একজন আরেকজনকে সমূলে ধ্বংস করতে চায়। এখানে দরদ নেই, সহানুভূতি নেই, আছে শুধু ঘৃণা। তীব্র ঘৃণা।

একবার নিজের পরিবারের দিকে তাকান। নিজের সন্তানের দিকে তাকান। দেখবেন, হয় সেখানে একজন অপূর্ব তৈরি হচ্ছে, অথবা এমন একজন, যে অপূর্বর মতো কাউকে ধ্বংস করতে চায়। প্রশ্ন হলো—মানুষ তৈরি হচ্ছে কি?

২৭ পঠিত ... ৮ ঘন্টা ৩০ মিনিট আগে

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top