ওমরাহর জন্য জমানো টাকা কিংবা দুর্গা পূজার জন্য জমানো টাকা বন্যার্তদের সাহায্য করার সংস্কৃতি আবহমান বাংলাদেশে সবসময়ই আছে। সম্পন্ন মুসলমান বাড়ির গৃহিণী পূজার আগে চালের ধামা জেলে পাড়ার হিন্দু রমণীকে উপহার দেওয়া কিংবা সম্পন্ন হিন্দু বাড়ির গৃহিণী ইদের আগে চালের ধামা মুন্সীপাড়ার মুসলমান পরিবারের রমণীকে উপহার দেবার আনন্দ জনপদ এই বাংলাদেশ।
এইখানে সম্পন্ন হিন্দু মসজিদ নির্মাণের জমি উপহার দেওয়া; সম্পন্ন মুসলমান মন্দির নির্মাণের জমি উপহার দেওয়া কোনো রুপকথা নয়।
হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি এমনই এখানে যে, শাহজালালের মাজারে হিন্দু নারী-পুরুষ; অনুকূল চন্দ্র ঠাকুরের আশ্রমে মুসলমান নারী-পুরুষের সিন্নি ও প্রসাদ চড়াতে যাবার সহজাত সংস্কৃতি বিরাজমান।
বাংলাদেশের প্রান্তিক এলাকার মসজিদের ঈমাম ও মন্দিরের পুরোহিত দুজনেই নৈতিকতা শিক্ষক হিসেবে শান্তির সমাজ প্রতিষ্ঠার কাজ করে যান।
১৭৯৩ সালে যে বৃটিশ কোলাবরেটরেরা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের হিন্দু জমিদার হয়ে উঠেছিল; ১৯৪৭ সালে যে পাকিস্তানি কোলাবরেটরেরা মুসলমান জমিদার হয়ে উঠেছিল; এরা আর্যস্বপ্নে বিভোর হয়ে পূর্ব বঙ্গের সম্পন্ন কৃষক-কারিগর-কবি-গায়ককে নিম্নবর্গের ও বেঁটে কালো বলে ছোটো করতে শুরু করেছিল। এরা উভয়েই আমাদের সাবহিউম্যান হিসেবে মনে করত। ভাবতে পারেন, আমাদের খেয়ে আমাদের পরে আমাদেরকেই লুট করে এরা নিজেদের আমাদের চেয়ে সুপিরিয়র হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল।
ঐ যে হিন্দু জমিদারের উন্নাসিকতা তা আওয়ামী লীগের সংস্কৃতি মামাদের সাংস্কৃতিক উপাদান। ঐ যে মুসলমান জমিদারের উন্নাসিকতা তা বিএনপির সংস্কৃতি মামাদের সাংস্কৃতিক উপাদান। এরা নিজেরাই ইনফেরিয়র কমপ্লেক্সে আক্রান্ত লোকজন। তাই সুপিরিয়র সেজে আমাদের এটা ওটার ইজম শেখাতে চেষ্টা করেছে।
বৃটিশ ও পাকিস্তানিদের ভাগিয়ে দেবার পর; এই হিন্দু-মুসলমান জমিদার মানসের সেই জামবাটিতে ফুঁ দিয়ে দিয়ে গরম দুধ খাওয়ার সময়টা চলে যায়। দুধ ও জামবাটি কিছুই নেই; তাই থাকে শুধু ফুঁটা।
স্বাধীন বাংলাদেশে এরা লীগ ও বিএনপির দুটি লালসালুর মাজারের খাদেম হয়ে বুবু ও ম্যাডামকে গদিনশীন করে; নতুন জমিদারি প্রকল্প তৈরি করে। এই জমিদারগুলো বৃটিশ ও পাকিস্তানি কোলাবরেটরদের সেকেন্ড ও থার্ড কপি; গুচি ব্যাগের নকল কপির মতো। দলের নমিনেশন নিয়ে এরা সংসদের জমিদারি সৃজন করে; টিনের ঘর থেকে প্রাসাদ-সেকেন্ড হোম, মোষের পিঠ থেকে পাজেরো-পোর্শ, পান্তা থেকে পাস্তা; গলি থেকে রাজপথে উঠে আসে এরা। দেশের নদী-বনভূমি-লোকালয় খেয়ে নধর নরভোজি সব। এরা ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তীর জন্য লেঠেল বা ফুটসোলজার পুষে। তাদেরকে চাঁদাবাজির লাইসেন্স দেয়। পুলিশ-প্রশাসন-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে প্রধানমন্ত্রী এই চাঁদাভাজির ভাগ পায়।
এরা দেশটাকে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি-বিপক্ষের শক্তি, মৌলবাদি-যৌগবাদী দিয়ে ভাগ করে বৃটিশের ডিভাইড অ্যান্ড রুল পদ্ধতি চালিয়ে যায়। যেহেতু মুজিববাদ-জিয়াবাদ, বুবুবাদ-ম্যাডামবাদ দিয়ে ইজমের খেলা কিছুতেই জমে না; তাই ঐ আদি ধর্মীয় বিভাজনের পাপ দিয়ে মাংসের কারবার করে। গরীব হিন্দু-মুসলমানের বাড়ি-জমি দখল করার ক্ষেত্রে দুটি ডাকাত দলের ভীষণ ঐক্য। ভারতে বাবরি মসজিদ ভেঙে হিন্দুত্ববাদীরা বাংলাদেশের ইসলামপন্থীদের দোলা দিলে; আওয়ামী লীগ হিন্দুর বাড়ি পাহারা দিয়ে বৃদ্ধাকে মাসিমা ডেকে নো ম্যানস ল্যান্ডে পৌঁছে দিয়ে আসে। বাড়িটা বিএনপির লোকের কাছে বিক্রি করে দিয়ে এরপর অসাম্প্রদায়িকতার লিপসার্ভিস দিয়ে বেড়ায়। মোদিকে খুশি করতে হাসিনা জঙ্গী বিরোধী অভিযানের নাটক শুরু করলে বিএনপির মাসলম্যান আক্রান্ত দাড়ি-টুপিওয়ালার বাড়ি-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বাঁচানোর নাটক করে; নামমাত্র দামে তা কেড়ে নিয়ে এরপর আওয়ামী লীগের মাসলম্যানের কাছে বিক্রি করে দেয়। এরপর বিসমিল্লাহর লিপসার্ভিস দিতে থাকে।
টিভিতে আওয়ামী লীগের মোজাম্মেল বাবুর জয় বাংলা জয় হিন্দের প্রেসক্রিপশন কিংবা বিএনপির মাহমুদুর রহমানের মুসলিম উম্মাহর স্বপ্ন; এসবই হিন্দু-মুসলমানের অনুভূতি নিয়ে খেলাধূলা করা। ভারতের প্রবাদপ্রতিম রাজনীতিক জ্যোতিবসু বলেছিলেন, একটি দেশের সরকার না চাইলে কখনও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হতে পারে না।
দিনের পর দিন লালসালুর দুটি মাজার হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে কৃত্রিম বিভাজন তৈরি করে; রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে হিন্দু ও মুসলমান কবি হিসেবে তুলে ধরে; হাজার বছর ধরে সুখে দুঃখে একসঙ্গে বসবাসরত হিন্দু-মুসলমানের সন্দেহ-অবিশ্বাস তৈরি করেছে।
কে মন্দিরে কোরআন রেখে যাচ্ছে; কে প্রতিমা ভাঙছে, কে মসজিদে ঢুকে মুসল্লী পেটাচ্ছে? আর কেউ নয় হিন্দু-মুসলমান বিভাজন জিইয়ে রেখে ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তী চায় যারা। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে ছাত্র শিবির থেকে পুলিশে আসা ছেলেটিকে হিন্দুদের বিরুদ্ধে বিষোদগারে ব্যবহার করে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে ইসকন থেকে আসা ছেলেটিকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিষোদগারে ব্যবহার করে। বিএনপির আমলে মুসলিম জমিদার গিন্নি সেজে টিভি ও সংসদ মাতান পাপিয়া আপা; আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে হিন্দু জমিদার গিন্নি সেজে সংসদ ও টিভি মাতান অপু উকিল দিদি।
বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গে ছিল-আছে-থাকবে। শুধু ফিরিয়ে নিতে হবে দ্বিদলীয় ঘাতককাঁটা।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন